যাত্রী আসতে দেরি হলেও কিছু মনে করে না রিকশাচালক রেহমান। তার এই মনে না করার কারণ অলসতা নয়, কাগজের ওপর তার হিজিবিজি কাটার সুযোগ নেওয়া।
রেহমান একজন রিকশাচালক হলেও কেবলই সাধারণ কোনো রিকশাচালক নন তিনি। তিনি একজন কবি। এ পর্যন্ত চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। বইগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে প্রায় ৪০০ কবিতা। এগুলোর বিষয় হিসেবে আছে জাতীয় ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য, দুর্নীতিসহ বহু বিষয়।
এই লেখকের পুরো নাম রেহমান আলি রেহমান। বাড়ি উত্তর প্রদেশের বাস্তি জেলার বদিবান গ্রামে। শৈশব থেকেই একজন কবি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছেন। গরিব কৃষকের সন্তান হওয়ায় দশম শ্রেণী পার করার পর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়লেও তিনি আজ একজন গুণী লেখক।
রেহমান বলেন, ‘কবিতা লেখা আমার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি আমাকে জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে অনুপ্রেরণা জোগায়। ’
তার কৃষক বাবার সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। যেটুকু ছিল সেটুকু তিনি ছেলেন পড়াশোনার জন্য বিক্রি করে দেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন এবং ভৃত্যের কাজ নেন। তার কোনো সম্পত্তি বা সময় কিছুই ছিল না, যা দিয়ে তিনি তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন। পরে তিনি কানপুর চলে যান ও সিনেমা হলে কাজ নেন।
সিনেমা হলে তিনি কাজের ফাঁকে ছবি দেখতেন। ছবি দেখার সময় তিনি গানগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং প্রয়োজনীয় কিছু শব্দ কাগজে টুকে রাখতেন। এরপর থেকে তিনি নিজে গান লেখার চেষ্টা করতেন। গান লেখার জন্য তিনি অল্প দিনের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। সিনেমা হলের লোকজন তার গান শুনতেন এবং তাকে কবিতা লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রথম দিকে তিনি প্রেমের গান লিখলেও পরে কবিতায় তিনি বিচিত্র বিষয় তুলে ধরেন।
রেহমান উল্লেখ করেন, ‘প্রজাতন্ত্র দিবসে কানপুর জেলা কারাগারে সিনেমা হলের একজন কর্মকর্তা আমাকে একটি অনুষ্ঠানে কাবতা আবৃত্তি করতে নিমন্ত্রণ করেন। ভাগ্যের কী খেলা, যিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণ লাল,একজন রসিক ও ব্যঙ্গ কবি। তিনি ছিলেন আমার প্রথম গুরু। এই অনুষ্ঠানে আমি কয়েকজন কবির সাথে পরিচিত হই যারা আমাকে কবিতা প্রকাশ করতে নির্দেশ দেন । ’
অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে রামকৃষ্ণ লাল কানপুর ‘মানস সঙ্গম’ নামের প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও সদস্যের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন । এই প্রতিষ্ঠানটি হিন্দি সাহিত্য বিস্তারের সাথে জড়িত। তাদের সহযোগিতায় তার প্রথম বই ‘কুচ কভিতাইন’ ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। তার আরো তিনটি বই ‘রেহমান র্যাম কা পায়েরা হো’ ‘মাৎ ভিয়ারথ করো পানি কো’ ও ‘কাইছে সামঝে হুয়া ভিয়ান’ নামে প্রকাশিত হয়েছে । তার একটি বই তার একজন যাত্রীর সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়েছিল।
মানস সঙ্গম প্রতিষ্ঠানের প্রধান বদরি নারায়ণ তিওয়ারি বলেন, ‘রহমান যে কোনো অর্থে বিস্ময়কর। প্রতিকূল অবস্থায় তার কবিতা লেখার ক্ষমতা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। তিনি তাদের জন্য একজন জীবন্ত উদাহরণ, যারা মনে করেন অর্থ ছাড়া লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না । ’
একসময় তিনি কানপুর থেকে গ্রামে চলে আসেন ও বিয়ে করেন। জীবিকার প্রয়োজনে রিকশাচালক হিসেবে কাজ করেন কিন্তু গান ও কবিতা লেখা চালিয়ে যান। রেহমান একটি ছোট ভাড়া ঘরে থাকেন কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কাছে তার কোনো অভিযোগ নেই। তার তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে এবং তিন ছেলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।
রেহমান বলেন,‘আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। যদিও আমি আমার ছয় ছেলেমেয়ের ভরণপোষন ঠিকমতো চালাতে পারছি না, তবু আমি আশা করি যে তারাও আমার মতো কঠোর পরিশ্রম করতে পারবে। ’
সূত্র : আইএনএস
বাংলাদেশ সময় ১৭০৬, জানুয়ারি ১৯, ২০১১