ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব

অলংকরণ : তৌহিন হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১১
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, দ্বিতীয় পর্ব

০৪. আর্য-পাঁচালি

তারা তো কোনোদিন গঙ্গার এই পারে যুদ্ধ করতে আসার সাহস পায়নি। যতবার এসেছে, তাড়া খেয়ে পালিয়েছে লেজগুটানো কুকুরের মতো।

তখন তারা এই বরেন্দি আর পুণ্ড্রতে এসেছে ভিার ঝুলি নিয়ে, আশ্রয়ের ছল নিয়ে, আর মনে লোভ ও অসীম পাপ নিয়ে। তারা আশ্রয় চেয়েছে, আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তারা আমাদের কাছে বসতের ভূমি চেয়েছে, চাষের জমি চেয়েছে, আমরা তাদের দিয়েছি। তারা জানত না কীভাবে মাটিতে ফসল ফলাতে হয়। কারণ তাদের কোনো মৃত্তিকাপ্রেম ছিল না। কারণ তারা মাটিকে পূজা করতে জানত না। জানত না ফসল ফলাতে। আমরাই তাদের শিখিয়েছি কীভাবে মাটির সাথে নিজেকে নিবেদন করে ফসল ফলাতে হয়। আমরা আত্মীয়জ্ঞানে তাদেরকে আমাদের সকল সম্পদের অংশ দিয়েছি, বুকে টেনে নিয়েছি। তারা একজন-দুইজন করে আমাদের বরেন্দিতে এসেছে, সংখ্যায় বেড়েছে, সঙ্গে এনেছে বিশ্বাসঘাতকতা আর গোপন সব মারাত্মক অস্ত্র। তারপর একদিন তারা ষড়যন্ত্র করে হত্যা করেছে আমাদের কুলপতি পৌণ্ড্রবরেন্দিকিরাতের রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে। একদিন হঠাৎ দেখলাম আমাদের ভূমি আর আমাদের নাই, আমাদের বায়ু-নদী, আমাদের বন-বনানী, আমাদের নিজেদের জীবনÑ কিছুই আর আমাদের নাই। আমাদের দেশে তারাই প্রভু, আর নিজেদের দেশে আমরা দাস। হায়, ছলনা ছাড়া আর কী আছে এইসব আর্য লোকদের!

আমাদের ভূমি আমাদের দেশ অন্যায়ভাবে কুগিত করে ওরা চালু করেছে মনুর বিধান। আমরা নাকি নীচু জাতি!
বাসুখুড়ো মনে করিয়ে দিতে থাকে পপীপকে কানীনস্তু পিতামহঃ সমভবৎ পিত্রাদয়ো গোলকাঃ যাদের পিতামহ ব্যাসদেব ছিল কুমারী মেয়ের গর্ভজাত পুত্র, আর বাপ-জ্যাঠারা ছিল বিধবার ছেলে(কারণ ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর বাবা বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গিয়েছিল, তাই ব্যাসের ঔরসেই ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর জন্ম); আবার তাদেরও ছেলে যুধিষ্ঠির-ভীমেরা সব হলো গিয়ে অন্য পুরুষের ব্যভিচারের ফল; যাদের পাঁচ ভাইয়ের একটিমাত্র বউ; এই রকম ব্যভিচারের কালিমাখা বংশের পুরুষ যাদের প্রধান পূজ্য দেবতার মর্যাদা পায়, তারা আবার কীসের সভ্য?

পুরাণ যুগের কবি বলেছেনÑ নদীনাঞ্চ ঋষীণাঞ্চ ভারতস্য কুলস্য চ। নদী, ঋষি আর ভরতবংশÑ এই তিনের মূল খুঁজতে যেয়ো না। খুঁজতে গেলে বিপদে পড়বে। কারণ পাণ্ডব-কৌরব, কৃষ্ণ, ব্যাসদেব, ভরদ্বাজÑ এতসব মহামতি পুরুষের বংশমূল খুঁজতে গেলে দেব-ভক্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

ভরতের পুত্র বলে যে ভরদ্বাজকে মহাঋষি মহামুণীর সম্মান দেওয়া হয়, সে কিন্তু পুরোপুরি জারজ-সন্তান। জন্মবৃত্তান্ত শুনলেই তা জানা যাবে। দেবরাজ বৃহস্পতির ঔরসে ভরদ্বাজের জন্ম। সেটি কীভাবে?

সেকালে উশিজ নামে এক ঋষি ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম মমতা। বায়ুপুরাণের বর্ণনামতে উশিজ মারা গিয়েছিলেন, আর অন্য পুরাণের মতে উশিজ বাড়ি ছেড়ে দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন। উশিজের ভাই দেবরাজ বৃহস্পতি। মমতা তখন আসন্নগর্ভা। পূর্ণ গর্ভবতী মমতার সৌন্দর্য কীভাবে যেন দেবরাজ বৃহস্পতিকে কামোন্মাদ করে ফেলল। তিনি মমতাকে ডেকে বললেনÑ তুমি এুণি খুব সুন্দর ভাবে প্রসাধন করে গহনা পরে আমার সামনে এসো। আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হবো। অলংকৃত্য তনুং স্বাং তু মৈথুনং দেহি মে শুভে।

মমতা বিপদাপন্ন কণ্ঠে বললেনÑ আমার গর্ভে যে তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পুত্রসন্তান। তার ওপর আমার প্রসব আসন্ন। আমি একেবারে ভরা পোয়াতি। আর আমার গর্ভস্থ শিশুও সামান্য কেউ নয়। সে গর্ভে থেকেই বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। বৃহস্পতি, আমি অনুনয় করে বলছি, তুমি অমোঘবীর্যÑ যা চাও তা হবেই, আমি শুধু অনুরোধ করছি আমার প্রসবের পরে তুমি যা চাইবে তাই হবে। এখন তুমি আমার সঙ্গে মিলিত হতে পারো না। ন মাং ভজিতুমর্হসি।
মমতার এত অনুনয়ের পরেও বৃহস্পতি নিজেকে সম্বরণ করতে রাজি নন। তিনি বললেন- তুমি আমাকে জ্ঞানদানের চেষ্টা করো না।
এই বলে তিনি ধর্ষমানঃ প্রসহৈনাং মৈথুনায়োচক্রমেÑ মমতাকে জাপটে ধরে মৈথুনের উপক্রম করলেন।
তখন মমতার গর্ভস্থ ভ্রƒণ কাতরকণ্ঠে বলে উঠলÑ দেবরাজ! আমি তো পূর্বাহ্নেই এই গর্ভে স্থান করে নিয়েছি। আপনার সঙ্গম তো কোনোমতেই ব্যর্থ হবার নয়। কিন্তু নাবকাশ ইহ দ্বয়োঃÑ এই গর্ভে তো দুইজনের স্থান সংকুলান হবে না।
ভ্রƒণের কথা শুনে বৃহস্পতির বীর্যস্খলনে ব্যাঘাত ঘটল। উন্মাদনার চরম মুহূর্তে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বৃহস্পতি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেনÑ সমস্ত জীবের সুখাবহ চরম এই মুহূর্তে তুই যখন আমাকে বাধা দিলি, তাই তুই অন্ধকার নিয়েই জন্মাবি অর্থাৎ অন্ধ হবি।
এভাবেই চির অন্ধত্ব নিয়ে ঋষি দীর্ঘতমার জন্ম।
আর বৃহস্পতির বীর্যস্খলন হলো মাটিতে, সেখানে জন্ম নিল এক শিশু। মমতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে ধর্ষণ করার ফলে বৃহস্পতির পরাবৃত্ত তেজ থেকে শিশুটি জন্ম নিল বলে তার প্রতি মমতার কোনো মমতা ছিল না। তিনি বললেনÑ ভর দ্বাজং বৃহস্পতে। দ্বাজ শব্দের অর্থ জারজ। এই জারজ সন্তানকে তুমিই লালন করো! বৃহস্পতিকে একথা বলে মমতা শিশুকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন।
ঠিক এই সময়েই মহারাজ ভরতের যজ্ঞাদি ক্রিয়া চলছিল। যজ্ঞে প্রীত হয়ে দেবতা ভরদ্বাজকে এনে দিলেন ভরতের হাতে। ভরদ্বাজ এখন ভরতের দত্তক পুত্র। তার থেকেই শুরু আর্যদের অনেক বড় বড় শাখা। তাদেরই বংশধররা হচ্ছে এইসব রাজা-রাজরা যারা আমাদের কাছ থেকে আবার পুণ্ড্র-বরেন্দি কেড়ে নিতে চায়।

পপীপকে ঘিরে থাকা মানুষগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল কথাগুলি। শুধু পুরুষরা নয়, বেশ কয়েকজন নারীও বসে আছে খড়ে-বোনো পাটির একধারে। সন্ধে তখন বেশ গাঢ়। তাই খুব ভালোভাবে পড়ে ওঠা যাচ্ছে না কার মুখে কী ভাব খেলে যাচ্ছে সেইসব ভাবের অনুবাদ। কিন্তু জমাট স্তব্ধতা অন্তত এটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের মনোযোগ অখণ্ড। তাদের আরো শোনার আগ্রহ খুব স্পষ্ট। এইসব কদর্য কথা মেয়েদের শোনা উচিত কি না এই প্রশ্ন একবারও ওঠে না কারো মনে। কৈবর্ত সমাজে এমনিতেই নারীরা পুরুষের সকল কাজের সহযাত্রী। নারী-পুরুষ ভেদ কোনোদিনই প্রকট হয়ে ওঠেনি তাদের সমাজে। পুরুষের কাজ পুরুষ করে, নারীর কাজ নারী করে। কার কাজের গুরুত্ব কম, বা কার কাজের গুরুত্ব বেশি তা নিয়ে কেউ কোনোদিন মাথা ঘামায়নি। তারা গাঁওদেব-গাঁওদেবীর পূজাও করে একসাথে, ফাগুয়ার পরবেও নাচে-গায় একসাথে, এমনকি রামপালের বিরুদ্ধে এখন যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধেও অংশ নিচ্ছে শত শত কৈবর্ত-নারী। তাই তাদের কাছে লুকানো-ছাপানোর মতো কোনো কিছু নাই। যে কথা শোনার অধিকার পুরুষের রয়েছে, সেকথা শোনার অধিকার রয়েছে কৈবর্ত-নারীরও।

পপীপের জানার বাসনা তখন প্রবল। কাজেই বাসুখুড়ো বলে চলে।
বৃহস্পতির শাপে চোখে অন্ধকার নিয়ে জন্মাল দীর্ঘতমা। সেই দীর্ঘতমা কেমন দুর্বৃত্ত ছিল জানিস?
সে এক ষাঁড়ের কাছে শিখেছিল যে ধর্ম-কর্ম, নীতি-রীতি সব শুধু দু’পেয়ে মানুষের জন্য। চতুষ্পদীরা যা খুশি তাই করতে পারে। ঋষি দীর্ঘতমা সেই মুহূর্তে দীা নিয়ে নিল ষণ্ডধর্মে। চতুষ্পদীরা যৌনকর্মে কোনো ভেদাভেদ করে না। মা-বোন-দিদিমা কেউই কারো অগম্যা নয়। দীর্ঘতমা তাই-ই করে বেড়াতে শুরু করল। ছোটভাই গৌতম ঋষির বউকে উত্যক্ত করতে শুরু করায় তাকে বের করে দেওয়া হলো তপোবন থেকে। এবার সে গিয়ে উঠল দৈত্যরাজ বলির রাজ্যে। রাজা বলির স্ত্রী সুদেষ্ণা আবার পুত্রহীনা। কিন্তু বলির যে কোনো মূল্যে পুত্র চাই। তখন ধার করা হলো ব্রাক্ষ্মণ দীর্ঘতমাকে। ত্রেজ পুত্র উৎপাদনের জন্য। ত্রেজ পুত্র মানে গোপনে অন্যের সাথে নিজের স্ত্রীর মিলন ঘটিয়ে নিজে বাহিরে বাহিরে একটি পুত্রের জনকত্ব দাবি করা।
এই প্রথার রীতি হলো, যে পুরুষ গর্ভাধান করবে তাকে কাজটি করতে হবে রাতের অন্ধকারে, কদাপি দিনের আলোতে নয়। সেই পুরুষের নিজের শরীরে মেখে নিতে হবে প্রচুর পরিমাণে ঘৃত, আর মিলনকালে কোনো কথা বলা চলবে নাÑ ঘৃতাক্তো বাগ্যতো নিশি। এসবের অনেক ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে ঘৃতে জ্যাবজেবে পুরুষের সঙ্গে দেহমিলনে কোনো নারীই প্রত্যাশিত রতি-আনন্দ পাবে না। সেই কারণেই এই ব্যবস্থা। তার ওপরে তার সঙ্গে প্রেম সম্ভাষণও যাতে সম্ভব না হয় সেই কারণেই পুরুষটির মৌনী থাকার বিধান।
রাজমহিষী সুদেষ্ণা অন্ধ এবং বৃদ্ধ দীর্ঘতমাকে দেখামাত্র ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত করে ফেললেন। তিনি ঘর থেকে চুপিসারে বেরিয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তার এক দাসীকে। ঋষি দীর্ঘতমা এই দাসীর গর্ভে বেশ কয়েকটি পুত্র উৎপাদন করলেন যারা পরবর্তীতে ব্রক্ষ্মবাদী মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বলে পরিচিত। রাজা বলি এতগুলি প্রাজ্ঞ ছেলে দেখে খুব পুলকিতÑ বাহ, আমার ছেলেরা তো খুবই জ্ঞানী। দীর্ঘতমা তখন পরিষ্কার করে বললÑ না, এরা আমার ছেলে। তোমার স্ত্রী আমাকে অন্ধ ও বৃদ্ধ দেখে আমার কাছে আসেনি। পাঠিয়ে দিয়েছিল তার দাসীকে। আমি অন্ধ হলেও তপোবলে বুঝতে পেরেছি। তাই এরা তোমার ছেলে নয়Ñ আমারই ছেলে।
রাজা বলি আবার স্ত্রীকে সালংকারে মনোমোহিনী সাজে সাজিয়ে ঋষির কাছে পাঠাতে বাধ্য হলো। সজ্জিতা রমণীকে কাছে পেয়ে দীর্ঘতমা বুঝতে পারল এই সেই রাজমহিষী সুদেষ্ণা। তাকে উপো করার জন্য সুদেষ্ণার ওপর চরম প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিল দীর্ঘতমা। তার শরীরে সেদিন ঘৃতের পরিবর্তে লেপন করা ছিল দধি। তার সঙ্গে মেশানো হয়েছিল লবণ আর মধু। সুদেষ্ণা পুত্রকামনায় দীর্ঘতমার কাছে এলে দীর্ঘতমা শর্ত দিলÑ আগে তোমাকে আমার এই দধি-লবণ-মধু মাখা দেহটি একটুও ঘৃণা প্রকাশ না করে পুরোপুরি লেহন করতে হবে। তবেই তোমার গর্ভে আমি পুত্র উৎপাদন করব।
সুদেষ্ণার উপায় নেই কোনো। ঘৃণা-লজ্জা ফেলে রেখে তিনি জিভ দিয়ে লেহন করলেন দীর্ঘতমার সর্বাঙ্গ। বাদ দিলেন শুধু দীর্ঘতমার উপস্থদেশ। দীর্ঘতমা নাছোড়Ñ আমার লিঙ্গও তোমাকে লেহন করতে হবে। কিন্তু সুদেষ্ণা পারলেন না সেখানে মুখ ছোঁয়াতে। তখন দীর্ঘতমা বললÑ বেশ তাহলে তোমাকে যে পুত্র দান করব, তার গুহ্যদেশ থাকবে না।
সুদেষ্ণা তখন তার পায়ে পড়লেন। কাতর অনুনয়ে একটু নরম হয়ে দীর্ঘতমা বললÑ আমার শাপ তো ফিরিয়ে নিতে পারব না। তবে এইটুকু করতে পারি যে তোমার পুত্রের বদলে এই অভিশাপকে পাঠিয়ে দিতে পারি তার পুত্রের কাছে। আর তুমি যেহেতু আমার লিঙ্গটি ছাড়া সমস্ত অঙ্গই লেহন করেছ, আমি মোটামুটি তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছি। তাই তোমাকে আমি দান করব একটি নয় পাঁচ-পাঁচটি পুত্র। আর তারা হবে দেবতাদের মতো ধার্মিক এবং সচ্চরিত্র।

ছি! খুব মৃদু কণ্ঠে উচ্চারিত হলেও ধিক্কার-ধ্বনিটির প্রাবল্য এত বেশি যে সবাই সেদিকে তাকাতে বাধ্য হলো। মেয়েদের মধ্য থেকে উচ্চারিত হয়েছে শব্দটি। কে বলেছে যদিও নিশ্চিত বোঝা গেল না, কিন্তু পপীপের মনে হয় এই শব্দটি কুরমির এসেছে মুখ থেকেই।
বিকৃতি নামে কোনো শব্দ নেই কৈবর্তদের ভাণ্ডারে। কারণ তাদের জীবনে প্রকৃতি থেকে কোনো বিকৃতি নেই। যা প্রাকৃতিক নয়, এমন কিছু কৈবর্তরা কখনোই মেনে নেয় না। তাই মেয়েদের মধ্য থেকে ছিটকে আসা শব্দটির সাথে পুরুষরা শুধু একটি কথা বলেই তাল মেলাতে পারেÑ ঘেন্না ঘেন্না!
হড়জন বলেÑ খারাপ কথা বেশি শুনতে নাই। ছোটকথা শুনলে নিজের মনটাও ছোট হয়ে যায়। কিন্তু এইগুলান আমাদের জানা দরকার। তা নাহলে সত্যি কথা চিরকাল গোপনই থেকে যাবে।
পপীপ তখন আবার বলতে শুরু করেÑ ছল-চাতুরি-মিথ্যাভাষণ-ব্যভিচার ওদের মজ্জাগত। কারণ ওদের দেব-দেবী সব নিজেরাই ছল-চাতুরিতে সবসময় মগ্ন। দেবতাদের পুরোহিত বৃহস্পতি একবার অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের রূপ ধরে এসে অসুরদের প্রবঞ্চনা করেছিলেন। অসুরদের তিনি শেখাচ্ছিলেন অহিংসার ধর্ম, যাতে তারা দেবতাদের হত্যা না করে।
সমুদ্র মন্থন করল অসুর ও দেবতারা মিলে। পরিশ্রম বেশি করেছিল অসুররাই। কিন্তু সমুদ্রমন্থনে যতটুকু অমৃত উঠল, যত সম্পদ পাওয়া গেল, অসুরদের প্রবঞ্চনা করে সবটুকু দিয়ে দেওয়া হলো দেবতাদের ভাগে। ওদের মতে জগতের পালক বলে যাকে মানা হয়, সেই বিষ্ণু কী অপকর্মটাই না করল! সমুদ্র থেকে ওঠামাত্র বিষ্ণু হাতিয়ে নিল স্বর্গসুন্দরী লক্ষ্মীকে। সমুদ্র থেকে ঐরাবত হাতি উঠল, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব উঠল, পারিজাত ফুল উঠলÑ সবগুলি দেবতারা আত্মসাৎ করল বিষ্ণু আর ইন্দ্রের ছল-চাতুরির সাহায্যে।
আর ব্যভিচার! তার তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এই যে এক দেবতাÑ চন্দ্র! সে পালাল গুরু বৃহস্পতির বউকে নিয়ে। দেবরাজ ইন্দ্র ধর্ষণ করল তারই গুরু গৌতমের সাধ্বী স্ত্রী অহল্যাকে। গুরু বৃহস্পতি, তার নিজের বউ কার সাথে পালাল সে খোঁজ নেই, সে তার ছোটভাইয়ের বউকে গর্ভবতী অবস্থায় বলাৎকার করে অন্ধ ছেলে হওয়ার অভিশাপ দিল।

স্তব্ধতা নেমে আসে হড়জনের আঙিনায়। পপীপ একটানা অনেকণ কথা বলে কান্ত। এবার সে সিদ্ধান্ত জানাতে চায়Ñ এইসব দেবতাদের যারা পূজা করে, এইসব নরাধম মানুষদের যারা বংশধর, তারা এতদিন আগ্রাসন চালিয়ে পদানত করে রেখেছিল আমাদের দেশকে। আমাদের জাতিকে। দিব্যোক আমাদের মুক্ত করেছেন। আমাদের উচিত সবকিছু দিয়ে ভীমকে সহযোগিতা করা। ঐসব আর্য-পিশাচের দল এখনো তৎপর আমাদের দেশকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবার জন্য। তাদেরকে প্রতিহত করতেই হবে আমাদের।
উসখুস করছিল কয়েকজন। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা তারা করেই ফেলল পপীপকেÑ তুই এইসব কথা জানতে পারলি কীভাবে?
পপীপ যেন জানত এই প্রশ্নটি উঠবে। সে হেসে বলেÑ ওদের শাস্ত্র পড়ে। ওদের পুঁথি পড়ে।
কে তোকে পড়তে শিখিয়েছে বটি?
আমার গুরু তিনজন। মল্লকাকা, ঊর্ণাবতী আর বাসুখুড়ো।
বাসু কে?
সে-ও ছিল আমাদের মতোন একজন ইুেেতর দাস।
সে কার কাছে শিখল?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল পপীপÑ সে অনেক বড় আর কষ্টের গল্প। দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর গল্পের মতো বাসুখুড়োও আর্যদের বিদ্যা চুরি করে এনেছিল কৈবর্ত-কোচ-মেচ-পোদ আর এই মাটির সকল ভূমিপুত্রকে বাঁচানোর জন্য।
আর্যরা সকলেই কি এইসব শাস্ত্রের কথা জানে?
না। জানে শুধু ব্রাক্ষ্মণরা। তারা বিধান দিয়েছে, ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া অন্য কেউ এই শাস্ত্র পড়লে সে রৌরব নরকে যাবে। ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া অন্য কেউ এই শাস্ত্র শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেই কারণে অন্য কেউ শাস্ত্র পড়তে পারে না। আর এই সুযোগে ব্রাক্ষ্মণরা যা খুশি বিধান দিয়ে নিজেদের উঁচু অবস্থান বজায় রাখে।
একটু হেসে বলল পপীপÑ আর আমি যে তোমাদের কাছে শাস্ত্রের কথা বললাম, তার শাস্তি হচ্ছে আমার জিহ্বা টেনে বের করে কাঠের সাথে কীলক দিয়ে গেঁথে রাখা।

০৫. অচেনা বাঁধন আজও বাধা হয়ে থাকে
এবার যেতে হবে।
প্রথমে মায়ের খোঁজে দেদ্দাপুর। তারপর ভীমের সাথে সাাতের জন্য রাজধানীতে। পিতৃভূমিকে রার জন্য যে আয়ুধ বাসুখুড়ো তুলে দিয়ে গেছে তার হাতে, যার জন্য তার কামরূপ থেকে এই কষ্টকর পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বরেন্দিতে পালিয়ে আসা, সেই আয়ুধ ব্যবহার করতে হবে ভীমের পরে যুদ্ধে। যেতে যে হবে, এ ব্যাপারে তার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু কুরমির ভাবনা কিছুতেই সরে যাচ্ছে না মন থেকে। মাঝে মাঝে কুরমি তাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে ফেলছে যে নিজের কর্তব্যকর্মগুলিকেও গৌণ বলে মনে হচ্ছে। এ তার জীবনে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিস্থিতি। এমন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে সে বিষয়ে তাকে বিন্দুমাত্র শিাদান তো দূরের কথা, কোনোদিন ইঙ্গিত পর্যন্ত করেনি গুরু। বাসুখুড়ো অবশ্য বলেছে জীবনে নানা রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় মানুষকে। তখন বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঠিক কী করা উচিত আর কী করা অনুচিত। কিন্তু সবচেয়ে বিপদের কথা হচ্ছে কুরমির ব্যাপারে পপীপের বুদ্ধি-বিবেচনা আদৌ কোনো কাজ করছে না। এখন বিবেচনা বলছে, তার এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু কুরমিকে ফেলে চলে যাবÑ  একথা ভাবতেই হাহাকার করে উঠছে তার বুক। কামরূপে রামশর্মার ইুেেত দীর্ঘ দাসজীবনে কত কিছুর জন্যই তো হাহাকার করে উঠেছে তার বুক। কিন্তু সেগুলি কোনোটাই এখনকার মতো নয়। সেইসব আবেগ এমন তীব্রও ছিল না, এমন যুক্তিহীনও ছিল না।
ঘরে আর ভালো লাগে না পপীপের। বাইরে বেরিয়ে আসে। তাকে উঠোনে নামতে দেখেই আখার পাশ থেকে হড়জনের বউ বলেÑ কিছু লাগবে রে বাপ?
না না কিছু লাগবে না। আমি একটু বাহিরে যাব। একটু ঘুরে আসি গ্রামটা।
এই রোদের মধ্যে যাবি?
কিছু হবে না মা। বৈদ্য তো বলেছে আমার আর কোনো অসুবিধা নাই।
একলা যাবি? কুরচি সাথে সাথে যাক!
দরকার নাই মা। কুরচি কাজ করছে, করুক।
হড়জন-পতœীর সামনে থেকে সরে আসতে পেরে, তার স্নেহের অত্যাচার থেকে একটু রেহাই পায় পপীপ। সে একটু দ্রুত পায়েই বেরিয়ে আসে বাড়ি ছেড়ে।
সেই একই রকম প্রায় সব বাড়ি। লালমাটি গেঁথে গেঁথে দেয়াল তোলা। মাথার উপর বাঁশের বাতার তৈরি খলপার ছাউনি। একদিকে ঢালু। দোচালা ঘর হলে মাঝখানের টুঁই থেকে দুইদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে খলপার চালা। খলপার উপর দিয়ে পুরু করে কাদা লেপে দেওয়া। এই কাদা বৃষ্টির জল ঠেকায়, গরমের সময় অতিরিক্ত রোদের আঁচ থেকে ঘরের মানুষকে বাঁচায়, আবার পৌষ-মাঘে শীতের কামড়ের তীব্রতা কমায় অনেকখানি। আনমনে হাঁটে পপীপ। দশ-পনেরো-কুড়ি ঘর নিয়ে এক-একটা গ্রাম। তারপরেই শস্যের তে। মুগ-মসুর-কাউনের মাঠ। এখানে দাঁড়িয়ে দূরে দণি দিকে তাকালে চোখে আসে লালাভ আগুনের মতো এক বিশাল আদিগন্তব্যাপী বিস্তার। সেই মালভূমি, যেখানে তাপদাহে মৃত্যুর মুখে পড়েছিল পপীপ। সেদিকে তাকিয়ে সেই ভয়াবহ স্মৃতি মনে ফিরে আসে পপীপের। মনে মনে শিউরে ওঠে সে একবার। দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সেদিক থেকে। লাল মালভূমি শেষ হয়ে যেখানে সবুজের শুরু, সেখান থেকেই গড়ে উঠেছে একটির পর একটি গ্রাম।
মাঠের পরে ঝোপ-ঝাড়ের বাধাহীন বিস্তার। ঢোলকলমি, দাঁতুন গাছ, রংচিতা, তেসরা মনসা, ফনিমনসা, নোনা আতা, নিশিন্দা, ভেরেণ্ডা, খয়ের, বাবলা, বনবাঁশ, বনবরই গাছের ফাঁকে ফাঁকে কত রকমের যে গুল্ম। মুথা, দূর্বা, চোরকাটা, কুচ, ভুঁই আঁকড়া, কাটানটে, আপাং, কালকেসুন্দি, হেলেঞ্চা, হাতিশুড়া, মুক্তাঝুরি, শেয়াকুল, গোহুর, ঢোলপাতা, লোয়ারি, কেশুটি, কন্টিকরি, শতমূলী, স্বর্ণলতা, তেলাকুচা, মাকাল, বিছুটি, বন কলমি, ঈশ্বরমূল, বেনা, গন্ধমূলের গাছ চিনতে পারে পপীপ। বাসুখুড়ো বলেছিল মানুষ ধরিত্রি থেকে ততদিন নিশ্চিহ্ন হবে না, যতদিন মাটির বুকে থাকবে উদ্ভিদের বরাভয়। উদ্ভিদ না থাকলে মানুষও থাকবে না। বৃ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৃকে চেনা মানে জীবনের অবলম্বনকে চেনা। তাই তাকে সাথে নিয়ে সেই ছোট্ট বয়স থেকে গাছ-লতা চেনাতে বেরিয়ে পড়ত বাসুখুড়ো।
হঠাৎ পায়ে সুড়সুড়ি। চমকে নিচের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে পপীপ। একটা কাঠবিড়ালি তার পায়ের উপর দিয়ে পথ পেরিয়ে আরেকদিকে ছুটে যাচ্ছে লেজ তুলে। কাঠবিড়ালিরা অকারণেই তিড়িং তিড়িং লাফিয়ে বেড়ায়। একদণ্ড চুপ করে থাকলেই যেন তাদের মহাতি হয়ে যাবে। হাসিমুখে কাঠবিড়ালির দিকে আরেকবার তাকায় পপীপ। একটা ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়তে দেখা গেল তার লেজের শেষপ্রান্তটুকু।

এবার ফেরার পথ ধরে পপীপ। ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে আলপথের মতো অস্পষ্ট পথ। জঙ্গলের পশু-পাখির চলাচলেই মূলত সৃষ্টি এইসব পথের। মানুষ বোধহয় তেমন একটা আসে না এদিকে। সেই অস্পষ্ট পথরেখা ধরে চলতে চলতে পপীপ একসময় বুঝতেই পারেনি সে অনেকটা ঘুরপথে চলে এসেছে। যে পথ দিয়ে সে এখানে এসেছিল, এই পথ সেই পথ নয়। বোঝা গেল যখন সে হঠাৎ তার সামনে দেখতে পেল অনেকখানি উঁচু একটা পুকুরের পাড়। আগে তো সে কোনো পুকুর দেখেনি! তার মানে সে ভুলপথে চলে এসেছে। হড়জনের বাড়ির ডোয়ারে সবচাইতে উঁচু পোয়ালের ঠিকা দেখে চিহ্ন ঠিক রেখেছে পপীপ। এবার মনে পড়ে ঠিকাটা তার বাম দিকে থাকার কথা ছিল, কিন্তু সেটি আছে এখন তার ডান দিকে। তার মনে হলো পুকুরটিকে অর্ধেক পরিভ্রমণ করলে সে ঠিক পথটিতে পৌঁছুতে পারবে। সে উঠে পড়ে বাঁধানো পুকুরের উঁচু পাড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়ায় বজ্রাহত বৃরে মতো।
তার থেকে কুড়ি-পঁচিশ হাত ডাইনে পুকুরের জলে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে গা ডলছে কুরমি।
এভাবে গোপনে কোনো স্নানরতা নারীকে দেখা স্পষ্টতই অন্যায়। বাসুখুড়োর শিা যে রুচি তৈরি করে দিয়েছে পপীপের মনে, সেই রুচি-বিবেক তাকে বলে অবিলম্বে এখান থেকে সরে যেতে।   কিন্তু নিজেকে সেখান থেকে সরাতে পারে না পপীপ কিছুতেই। তার পা যেন গেঁথে গেছে পুকুর-পাড়ের নরম মাটিতে। সে যেন সামনে কোনো জলপরীকে দেখছে! সে নড়তে ভুলে যায়। কিন্তু তার নিঃশ্বাস এত জোরে বইতে শুরু করে যে মনে হয় এত দূর থেকেও কুরমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ ঠিকই শুনতে পাবে। তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় কিনা কে জানে, কিছুণ পরে কুরমি হঠাৎ-ই ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় পপীপের দিকে। সে পপীপকে দেখে একটুও চমকায় না, থমকায় না। যেন সে জানত ঘাড় ফিরিয়ে সে পপীপকেই দেখতে পাবে। সে নিজের বুক থেকে খসে পড়া শাড়ির প্রান্তটি আলতোভাবে তুলে দেয় কাঁধে। তারপর তার জলপরীর মতো শারীরিক বৈভব নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পপীপের দিকে। তার চোখে কোনো ধিক্কার নেই, কোনো অনুরাগ নেই, এমনকি কোনো ভাষাই নেই। পপীপ ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায় সেই দৃষ্টির সামনে। সে চলে যাওয়ার জন্য নিজেকে ঘুরিয়ে নেয় কুরমির দিক থেকে। অনিচ্ছুক পা-কে বাধ্য করে সচল হতে। তখনই শুনতে পায় সে কুরমির আহ্বানÑ পপীপ!
পপীপ ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় কুরমির দুই চোখ থেকে অবিরল জল নামতে শুরু করেছে। সেই জল মিশে যাচ্ছে পুকুরের জলে।
পপীপ একপা একপা করে এগিয়ে আসে কুরমির দিকে। জলের কিনারে এসে থমকে দাঁড়ায়। তখন কুরমি তার দিকে আহ্বানের লীলায়িত ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দেয় দুই হাত।
পপীপ জলে নামে। জল ভেঙে এগিয়ে যায় কুরমির কাছে। কাছে গিয়ে তাকে আলিঙ্গনে নেয়। তাদের দুজনের দোলায়িত শরীরের কম্পনে একের এক অনিয়মিত ঢেউ উঠতে থাকে পুকুরের জলে। পপীপ চেটে খায় কুরমির চোখ থেকে ঝরা নোনাজল। তারপর চুমু খায় কুরমির চোখে। তার ঠোঁট নামতে নামতে একসময় আশ্রয় পায় কুরমির অপেমান ওষ্ঠে। এবার পপীপ পাঁজাকোলা করে তুলে নেয় কুরমিকে। তুলে আনে জল থেকে। তারপর শুইয়ে দেয় ঘাসের শয্যায়।

০৬. আবার পথে...
ঘনরসময়ী গভীর বক্রিমসুভগোপজীবিতা কবিভিঃ
অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গালবাণী চ। ।
(গঙ্গা ও বঙ্গালবাণী দুটিই প্রগাঢ় রসময়, গভীর, সুন্দরগতিভঙ্গময় এবং কবিদের উপজীব্য। দুটিতেই অবগাহন করলে পুণ্য হয়। )
বাসুখুড়োর শেখানো শ্লোক বলতে বলতে পথে নামে পপীপ। পথে নেমে দেখা যায় এবার তার সাথীর কোনো অভাব নেই। এত নির্ভয়ে কতদিন পথ চলতে পারেনি সে! দাসজীবনে ছিল পদে পদে দাসপ্রভু এবং তার অনুচরদের বিধি-নিষেধ। আর পালিয়ে আসার সময়টুকু তো তার জীবনের সবচাইতে দীর্ঘতম কয়েকটি দিন। এখন নির্ভার ভাবে দেদ্দাপুরের দিকে অগ্রসর হবার সময় তার পায়ে যেন ভর করেছে প্রজাপতির ডানার মতো হালকা ছন্দ। আসার সময় কুরমি তাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছে। মানকু এখন তার কাছে অতীত স্মৃতি। ভালোবাসা এসেছে আজ। সেখানে রীতির বন্ধন আপনাতেই শিথিল হয়ে গেছে। কুরমি কথা দিয়েছে সে পপীপের জন্য অপো করবে। এবং সেই অপোর কোনো সময়-সীমা বেঁধে দেয়নি সে। জানে পপীপের কাজটি কত গুরুত্বপূর্ণ। তার সফলতার জন্য সে কট্টলির কাছে প্রার্থনা করবে প্রতিদিন। হাম্মা-হাম্মির বংশধর তারা। তার বংশের উঁচু সম্মান রার জন্য কৈবর্তজাতি যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সেই সংগ্রামে কুরমি কেন পিছিয়ে থাকবে! এই যুদ্ধ কী আমারও যুদ্ধ লয়!
পথে পথে নতুন লোকের সাথে দেখা। কোনো তমালিকার ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া। তারপর আবার পথচলা। চলতে চলতে দেখা হয়ে গেল অদ্ভুত-দর্শন এক লোকের সাথে। শীর্ণকায় কঙ্কালসার দেহ। মাথায় কুণ্ডলী করা দীর্ঘ কেশ। নাভিমূল পর্যন্ত নেমে আসা অযতেœ বেড়ে ওঠা দাড়ি। কান লম্বা এবং সেই কানে লম্বালম্বিভাবে কাটা একটা দাগ। গলায় হাড়ের মালা। উপবীতের মতো যোগপট্ট। কোমড়ে কোপিন। কাঁধে ঝোলা, হাতে দ্বাদশী(লাঠি)। নিশ্চিতভাবেই লোকটি বৃদ্ধ। কিন্তু তার চলাফেরায় বার্ধক্যের জড়তার কোনো চিহ্ন নেই। তার চোখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো হোঁচট খায় পপীপ। এত নিস্পৃহ উদাসীন হতে পারে কোনো মানুষের চোখ! চারপাশের পৃথিবীর কোলাহল, পায়ের নিচের পথ, মাথার উপরের সূর্য, পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া পথিকের কৌতূহলী দৃষ্টিÑ কোনোকিছুই যেন স্পর্শ করছে না তাকে। চোখ দেখলে মনে হয় এই পৃথিবীর কোনো কিছুই তাকে আকৃষ্ট করে না; মনে হয় সে এই পৃথিবীর মানুষই নয়। লোকটি কি যোগী?
উত্তর পেতে হলে কথা বলতে হবে তার সাথে। কিন্তু পপীপ সেধে কথা বলতে গিয়েও বিফল হয়েছে। কারো সাথে বাক্যালাপে কোনো আগ্রহ নেই লোকটার। কিন্তু তার সঙ্গ ত্যাগ করতে মোটেই ইচ্ছা হচ্ছে না পপীপের। কী একটি যেন রহস্য আছে লোকটার মধ্যে! সেই রহস্যের টানে কিছুতেই তার সাথে থাকার লোভ সম্বরণ করতে পারছে না পপীপ। নাছোড় হয়ে সে লেগে থাকে যোগীর সঙ্গে সঙ্গে। তার আগ্রহ শেষ পর্যন্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে যোগীর। ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে তাকায় লোকটি তার দিকে। জিজ্ঞেস করেÑ তুই কেনে আমার পেছু পেছু আসছিস?
পপীপের কী হয়, হঠাৎ সে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত করে লোকটিকে। এবার স্পষ্ট বিরক্তি ঝরে পড়ে লোকটির কণ্ঠেÑ এসব ভণ্ডামি ছাড়! কী চাস তা-ই বল বটি!
আপনার মধ্যে আমার গুরুর ছায়া।
কে তোর গুরু?
আমার গুরু বাসু।
এবার তার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় যোগীÑ বাসু যার গুরু তার আর অন্যের কাছে আসার দরকার কী!
পপীপ হাতজোড় করে বলেÑ আমি অম শিষ্য। সবকিছু নিতে পারার আগেই গুরু দেহ রেখেছেন।
তুই সংস্কৃত জানা মানুষের মতোন কথা বলছিস কেনে?
গুরু বলেছিলেন সংস্কৃত জানা মানুষদের সাথে জ্ঞানযুদ্ধ করতে হলে ওদের অস্ত্রেই ওদের পরাজিত করতে হবে। তাই সংস্কৃত শিখিয়েছেন।
নরম হয়ে আসে যোগীর দৃষ্টি। বলেÑ কী জানতে চাস?
ব্রাক্ষ্মণরা যে সব সময় নিজেদের জন্য উপরের অবস্থান দাবি করে তার কি কোনো ভিত্তি আছে? যদি না থাকে তাহলে তাদের সম্পর্কে সত্য কথাটি আমাকে বলুন।
যোগী এবার শ্লোক আওড়ায়Ñ
ব্রক্ষ্মণেহি ম জানন্ত হি (ভেউ)
এমই পটিঅউ এ চঊবেউ। ...
কজ্জেঁ বিরহিঅ হুঅবহ হোমেঁ
অক্খি ডহাবিঅ কডুএঁ ধূমেঁ।
একদণ্ডী ত্রিদণ্ডী ভঅবঁ বেসে
বিণুআ হোইঅই হংস উএসেঁ।
মিচ্ছেহিঁ জগ বাহিঅ ভুলেঁ
ধম্মাধম্ম ণ জাণিঅ তুলেঁ।

‘ব্রাণেরা অধ্যাত্মরহস্য জানে না, শুধু শুধুই তারা চতুর্বেদ পড়ে। ... কাজকর্ম নেই। শুধু অগ্নিতে হোম করে করে তীব্র ধোঁয়ায় চোখের যন্ত্রণা পায়। একদণ্ডী, ত্রিদণ্ডী, ভগবদ্বেশ ধারণ করে জ্ঞানী সাজে, পরমহংস উপদেশ করে। মিথ্যায় জগৎ (এইভাবে) ভুলের পথে পরিচালিত হচ্ছে। (তারা) জানে না যে ধর্ম ও অধর্ম তুল্যমূল্য। ’

শ্লোকের ভাষা শুনে চমৎকৃত হয় পপীপ। সংস্কৃতকে বাদ দিয়ে নিজেদের মুখের ভাষার কাছাকাছি শব্দ দিয়েও যে শ্লোক তৈরি করা যায় তা আগে জানা ছিল না পপীপের। সে মনে মনে স্থির করে, এখন থেকে সে-ও এইরকম ভাষাতে শ্লোক রচনা করবে। এবার বৌদ্ধ-জৈনদের সম্পর্কে যোগীর সিদ্ধান্ত জানতে চায় সে। যোগী আবার শ্লোক আউড়ে চলে

চেলু ভিক্খু জে ত্থবির উদেসেঁ
বন্দেহিঁ অপব্বজিউ বেসেঁ।
কোই সুতন্ত বক্খাণ বইটঠো...

জই ণগ্গাবিঅ হোই মুত্তি তা সুণহ সিআলহ
লোমুপ্পাড়ণেঁ অত্থি সিদ্ধি তা জুবই-নিঅম্বহ।
পিচ্ছীগহণে দিট্ঠ মোক্খ মহু কিম্পি ণ ভাই
তত্তরহিঅ কা আণ তাব পর কেবর সাহই।

চেলা, ভিু, স্থবির উপবিষ্ট যারা এবং অপ্রব্রজিতের বেশ ধরে যারা বন্দিত হয় (তাদের) কেউ কেউ সূত্রান্ত ব্যাখ্যায় নিরত। কেউ আবার চিন্তা করতে করতে শুকিয়ে যায়। যদি নগ্ন হলে মুক্তি হয়, তবে কুকুর-শিয়ালের তা হয়েছে। লোম-উৎপাটনে যদি সিদ্ধি হয় তবে তা যুবতী-নিতম্বের হয়েছে। ময়ুরপুচ্ছ ধারণ করলে যদি মুক্তি হয় তবে হাতি-ঘোড়ার (মুক্তি) হয়েছে। ’
শ্লোক শুনে হেসে ফেলে পপীপ। তার হাসি দেখে যোগীর মুখেও খেলে যায় সামান্য সকৌতুক হাসির রেখা। মুখে বলে কৈবর্ত জাতির মুক্তি তার লিজের ধর্মে। আর্যের ধর্মে তার মুক্তি নেই। বুদ্ধের ধর্মেও তার গতি নেই। তুই এবার যা। তোর কাজ আলাদা, তোর পথ আলাদা।

তাকে রেখে যোগী হাঁটতে থাকে। পপীপ পেছন থেকে কাতরস্বরে বলেÑ গুরু আপনার পরিচয়টি অন্তত আমাকে জানান। আমি কী নামে আপনাকে স্মরণ করব?

একটুও শ্লথ হয় না যোগীর গতি। একবারও তাকায় না পেছনে ফিরে। চলতে চলতেই বাতাসে ভাসিয়ে দেয় একটি শব্দÑ তিলো।
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে পপীপ। এই সেই মহান কবি তিলো! তার কী সৌভাগ্য! এই মহান কবি তাকে নিজ মুখে নিজের রচিত শ্লোক শুনিয়েছেন। বাসুখুড়ো বলেছিল, এখানকার ভূমিপুত্ররা একদিন ঠিক ঠিক নিজের ভাষায় রচনা করবে নিজেদের শ্লোক, নিজেদের জ্ঞান লিখে রাখবে নিজেদের ভাষায়। সেই কাজ সবচেয়ে এগিয়ে নিচ্ছে যে কবি, তার নাম তিলো। কিন্তু কাজ এখনো অনেক বাকি। সবকিছুর জন্য চাই নিজেদের বর্ণমালা। সেই কাজে নিজেদের সঁপে দিতে হবে সব লেখাপড়া জানা ভূমিপুত্রদের। যদি নিজেদের স্বাধীনতা থাকে, নিজেদের কট্টলি নিজেদের হাতে থাকে, তবে সেই কাজ সম্ভব হবে সহজে। তাই যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে বরেন্দির স্বাধীনতা। সবকিছু নিয়ে এই যুদ্ধে দাঁড়াতে হবে ভীমের পাশে।

আনমনে পথ চলছে পপীপ। পথ যত গড়াচ্ছে তার মধ্যে আবেগ তত ঘন হয়ে আসছে। মন বলছে আর বেশি দূরে নেই তার গ্রামটি। কিন্তু তা যে এতটা কাছে, সেটি ভাবতে পারেনি পপীপ। হঠাৎ একটা লালমাটির টিলার ওপরে উঠে অস্থির হয়ে উঠল তার বুকের ভেতরটা। টিলা থেকে দেখা যাচ্ছে লালমাটির পথ সোজা নেমে গেছে গ্রামের দিকে। সেই গ্রামের ঝুপড়িগুলি অন্য কৈবর্তগ্রামের মতোই। কিন্তু এখানে কী যেন একটি বিশেষত্ব আছে! পপীপ চঞ্চল হয়ে ওঠে। এদিক-ওদিক তাকায়। এই মানসিক অস্থিরতার হেতু খোঁজার চেষ্টা করে। আশপাশে তাকিয়ে মানুষ খোঁজে এই জায়গার সুলুক-সন্ধান জানার জন্য। কিন্তু কাউকে দেখা যায় না আশপাশে। কোনো বয়স্ক পুরুষ মানুষ নেই, কোনো নারী নেই, এমনকি গাঁয়ের সামনের খোলা মাঠ কিংবা লাল ধুলোর রাস্তায় কোনো শিশু পর্যন্ত নেই। কেমন ভূতুড়ে মনে হচ্ছে পুরো গ্রামটিকে। গাঁয়ে ঢোকার মুখে গাঁওদেব-গাঁওদেবীর থানের পাশে তো কেউ না কেউ সবসময়ই থাকে। সেই কামরূপেও যে কোনো গাঁয়ে ঢোকার মুখে একটা না একটা সর্বজনীন মণ্ডপ তার চোখে পড়েছে সবসময়। মানুষের বসতি মানেই সেখানে প্রাণের সাড়া। কিন্তু এই গ্রামে কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন! তাকে এখন গ্রামেই ঢুকতে হবে খোঁজ নেবার জন্য। এক পা সামনে বাড়ায় পপীপ। তারপর অকস্মাৎ-ই যেন তার মনের চোখে জ্বলে ওঠে এক অপার্থিব আলো। কেউ বলেনি। বলার মতো কেউ তার আশপাশে নেই-ও। কিন্তু তার নিজের অন্তরাত্মা পপীপকে বলে দিয়েছেÑ এটাই তার দেদ্দাপুর! এই-ই তার জন্মমাটি! এই-ই তার মায়ের আবাস!

হঠাৎ-ই তার চোখের সামনে থেকে সরে যায় আঠারো বছরের একটি কালো পর্দা। নিজেকে সে দেখতে পায় আঠারো বছর আগের সেই সকালটিতে। তাকে একহাত ধরে টানছে দুই রাজপুরুষ। একপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ নিশ্চেষ্ট বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে গাঁয়ের মানুষ। কিশোর পপীপের আরেক হাত ধরে টানছে তার মা। মা তার বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁদছে পশুর মতো আর্ত শব্দ তুলে। কোনো অর্থ উদ্ধার করা যায় না সেইসব শব্দের। কিন্তু যে শোনে, তারই নাড়ি ছিঁড়ে যেতে চায় সেই শব্দের তীব্র আর্ততায়। মায়ের আরেকটি হাত একবার চাপড়াচ্ছে নিজের বুক, আরেকবার আেেপ আছড়ে পড়ছে লালমাটির গায়ে। পপীপ পুরো দৃশ্যটি স্পষ্ট দেখতে পায় এখানে দাঁড়িয়ে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে আঠারো বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটির খুঁটিনাটি। নিজের সেই সময়ের অসহায় মুখচ্ছবিটাও স্পষ্ট দেখতে পায় সে। তারপর মাটিতে আছড়ে পড়ে অসহায় বুক চাপড়াতে থাকা মায়ের মুখটি দেখতে চায় ভালো করে। কিন্তু পরিষ্কার দেখা যায় না কিছুতেই। কারণ ইতোমধ্যেই তার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে অঝোর বৃষ্টির মতো নেমে এসেছে চোখের জলের ধারা।
 
০৭. মায়ের কাছে ফেরা

কিন্তু কেউ নেই গাঁয়ে।

গোটা গ্রাম জুড়ে পোড়া ছাই। কোথাও স্তূপ হয়ে আছে ছাই। কোথাও সেগুলি রোদ-বৃষ্টিতে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে লাল মাটির ওপর ধূসর দাগ রেখে দিয়েছে। বোঝা যায় আগুন লেগেছিল গাঁয়ে। কিন্তু আগুনে সবটা পুড়ে শেষ হয়ে যায়নি। ঝুপড়ি ঘরগুলোর কোনো-কোনোটা এখনো কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে নিজের নিজের অবলম্বনের উপর ভর করে। কিন্তু তাদের সহনমতা  শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। সামান্য বাতাসের ধাক্কাতেই নড়বড় করছে। বরেন্দির আর একটা চৈতালি ঘূর্ণি কি তারা পাড়ি দিতে পারবে? মনে হয়Ñ পারবে না। কৈবর্ত-গ্রামে কেউ কোনোদিন দুয়ারে খিল এঁটে ঘুমায়নি। তাদের দরজা বাইরে থেকে কোনোদিন আটকানোর কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। তার প্রয়োজনও কেউ কোনোদিন বোঝেনি। কারো ঘর থেকে কোনোদিন কোনো জিনিস হারায়নি। চুরি করা কী জিনিস জানত না কৈবর্ত-কোচ-ভীল-শবর-নিষাদ জাতির কেউ। রাতে বা অন্য সময় কেবল দুয়ারের ঝাঁপটা ঠেলে দিত যাতে নিজেদের একান্ত রাতের জীবন অন্যের চোখে না পড়ে।

এখনো দেখা যাচ্ছে সবগুলি দুয়ার হাট করে খোলা। খুব মৃদু ঝাঁওয়াল এক দিক থেকে ঢুকে ঘরের আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় খোঁচ-খাঁচ শব্দ তুলছে। গরম বাতাস কিংবা লালধুলো উড়ে এলে কৈবর্তদের গাঁয়ের কুকুরগুলো যে বিরক্তির শব্দ করত মাঝে মাঝে, তেমন একটি শব্দও উঠছে না। কুকুরগুলোর কথা মনে আসতেই আবার স্বজন হারানোর বেদনা জেগে ওঠে পপীপের বুকে। গাঁয়ের কুকুর মানে গাঁয়েরই কুকুর। কোনো একবাড়ির নয়, কোনো একজনের নয়। গাঁয়ের সবাই সেগুলোর প্রভু। গাঁয়ের সবার সাথেই কুকুরগুলোর বন্ধুত্ব। যে যখন ডাকে, তার ডাকে তৎণাৎ সাড়া দেয়। যে শিশুই তাকে খেলতে ডাকে, তার সাথেই খেলায় মত্ত হয়ে পড়ে। যে দুয়ার থেকেই তার খাবার আসে, সেটাকেই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে। কিন্তু পপীপের এখন মনে পড়ছে বিশেষ একটা কুকুরের কথা। তার গায়ের রংটাও মনে পড়ছে। মরচে রঙের লোমের সাথে কালো কালো ফুটকি। ফুটকিগুলো এত বড় যে মাঝে মাঝে সেগুলোকে ডোরাকাটা দাগ বলে মনে হতো। গাঁয়ের কোনো কোনো বুড়ো বলত, ওর বাপ নিশ্চয়ই কোনো বাঘই ছিল। চিতা বাঘ হোক আর মেছো বাঘ হোক, নিশ্চয়ই ওটা বাঘেরই বংশধর। সেই কুকুরটাই ছিল তার খেলার সাথী। আচ্ছা তাকে যখন রাজপুরুষরা হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কোথায় ছিল কুকুরটা? মনে মনে আঠারো বছর আগের দিনটিতে কুকুরটাকে খোঁজে পপীপ। না। তাকে আশপাশে দেখা যায় না। কোনো কুকুরকেই দেখা যায় না। তখন মনে পড়ে, সেই বাঘা কুকুরটার সাথে অন্য সব কুকুরগুলোকে তখন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল একটা ঝুপড়িতে। মোড়লের ওপর এইরকমই নির্দেশ ছিল। রাজপুরুষ বা রাজার কোনো লোক গাঁয়ে আসতে চাইলে দূর থেকে সংকেত দেবে, আর সঙ্গে সঙ্গে কুকুরগুলোকে আটকে রাখতে হবে কোনো-না-কোনো ঘরে। তা নাহলে কোনো কুকুর ঘেউ ঘেউ করলেই রাজপুরুষরা হাতের বর্শা দিয়ে পেট ফুটো করে ফেলত তার। সেইসঙ্গে গাঁয়ের মোড়লকেও শাস্তি পেতে হতো কুকুর ছেড়ে রাখার অপরাধে। মনে মনে ভাবে পপীপ, সেই বাঘাটা সেদিন ছাড়া থাকলে তার হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে নিশ্চয়ই রাজপুরুষের পায়ের মাংস কামড়ে তুলে নিত। সেই কুকুরগুলো, বিশেষ করে বাঘাটার খোঁজে চঞ্চল চোখে এদিক-ওদিক তাকায় পপীপ। তারপরেই মনে পড়ে আঠারো বছর বাঁচে না কোনো কুকুর। যদি এখন সে কোনো কুকুরকে দেখতেও পায়, তাহলে সেটি হবে হয়তো আগের কুকুরগুলোর বংশধর। সে রকম কোনো কুকুরের দেখা পেলেও এখন তার চলে। এই মুহূর্তে তার এখন কাউকে দেখতে পাওয়া দরকার। সে মানুষই হোক কিংবা তাদের পোষা কুকুর হোক কী ছাগল হোক। সে সরু সরু গলি ধরে এবাড়ি-সেবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুরো গ্রামটি এক চক্কোর ঘুরে আসে। কিন্তু কয়েকটা ইঁদুর আর বনবিড়াল ছাড়া অন্য কোনো জনপ্রাণী দৃষ্টিপথে আসে না। আর গাঁয়ের পথটিও যেন দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার কারণে স্যাঁতলা-পরা চেহারা নিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় মুছেও গেছে পথের রেখা। সেই অস্পষ্ট পথরেখা ধরেও পপীপ তৃষ্ণার্ত চোখে ঘুরে বেড়ায় পুরো গ্রামের আনাচে-কানাচে। জনমনিষ্যির কোনো চিহ্ন না পেয়েও অদম্য আশা নিয়ে উঁকি দেয় সবগুলি ঘরের দরজায়। একবার বাতাসে স্বর মিলায় অনুচ্চেÑ মা! তারপর মাটির দিকে নুয়ে পড়ে ডাকেÑ মা! তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় চিৎকার করে ডাকেÑ মা! তারপর কণ্ঠের স্বর সর্বোচ্চে তুলে চিৎকার করে একই ভাবে ডেকে চলে সেÑ মা! মা! মা! জ্যোৎস্নার পাগল করা সৌন্দর্যে চাঁদে-পাওয়া কোনো কোনো কুকুর যেমন আকাশের দিকে মুখ তুলে অনবরত ডেকে ডেকে আকুল গোঙানি ছড়িয়ে দেয় বাতাসে, পপীপকে দেখতে এখন সেই রকম মনে হয়। কুকুরের অবিরাম চিৎকারের মধ্যে কোনো আশাবাদ থাকে কি না কেউ তা জানে না, কিন্তু পপীপ একটানা মা মা বলে ডেকে চললেও তার মন একটুখানি জায়গা খালি রেখেছে এই প্রত্যাশায় যে তার আকুল চিৎকারে কেউ একজন হয়তো পেছন থেকে এসে মমতার হাত রাখবে তার মাথায়।

কিন্তু অনেকণ এইভাবে কাটিয়ে দেবার পরেও পপীপের অপো নিষ্ফলাই থেকে যায়। একবার কানের পেছনের চুলগুলো দোল খেয়ে উঠলে তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল কেউ বোধহয় সত্যি সত্যি হাত রেখেছে তার মাথার চুলে। কিন্তু ভুল আশাটা বেশিণ স্থায়ী হতে পারেনি। কারণ পপীপ অচিরেই বুঝে গেছে যে তার চুলে কোনো মানুষের মমতার হাত পড়েনি। যেটাকে সে মানুষের স্পর্শ বলে মনে করেছিল, সেটা ছিল বরেন্দির থাকবন্দি মাটির সোপান বেয়ে ছুটে আসা বাতাস। এখানে বাতাসকে বাধা দেবার মতো তেমন কোনো দেয়াল নেই। তাই একেবারে গ্রামের প্রবেশমুখের লালমাটি থেকে কোনো বাতাস এগুতে শুরু করলে সেটি তেমন কোনো বাধা ছাড়াই পুরো গ্রাম অতিক্রম করে যেতে পারবে।

কিছুণ ফুঁপিয়ে কাঁদার পরে নিজেকে আবার নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে পারে পপীপ। কিন্তু একটি প্রশ্ন কিছুতেই তার মাথা ছেড়ে যেতে চায় না। তা হচ্ছে এই গ্রাম এইভাবে পরিত্যক্ত এবং জনমানবশূন্য হলো কেন? কেমন করে? বিশেষ করে মহীপালের শাসনকালেও ভট্টবামন, তার রাজপুরুষের দল, তাদের অত্যাচার, মঠ-মন্দিরের সেবায়েতদের অত্যাচার এবং শোষণের মুখেও যে গ্রামের মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে, সেই গ্রাম এখন এই কৈবর্ত-স্বাধীনতার কালে পরিত্যক্ত হলো কেমন করে?

কে দেবে উত্তর?

কিন্তু পরিপূর্ণ উত্তর না জেনে পপীপ এখান থেকে একধাপও নড়তে সম্মত নয়।
সে আবার পুরো গ্রাম ঘুরে আসে। তারপর প্রত্যেক ঝুপড়িতে ঢুকতে থাকে। তন্ন তন্ন করে খোঁজে। ঠিক কী খুঁজছে জানে না। কিন্তু খুঁজছে। একটা কোনো চিহ্ন। একটা কোনো সূত্র। প্রত্যেক ঝুপড়ি ভালো করে খুঁজে দেখার পরে পপীপ ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় গ্রামের প্রবেশমুখের টিলার ওপর। এখান থেকে নিচের সমতল উপত্যকায় গড়ে ওঠা পুরো গ্রামটিকে দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে পপীপ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার জন্মগ্রামের দিকে। মাথার ওপর সূর্য আগুন ঢালছে অবিরাম। কিন্তু পপীপ তবু ঠাঁইনাড়া হয় না। ছায়া খোঁজার জন্য অন্য কোথাও যায় না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। পেটের নাড়িগুলো এলোমেলো মোচড়ানি দিয়ে জানান দেয় যে তাদের এখন খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু পপীপ উপো করে চলে শরীরের সব দাবিকে। সে যেন অদৃশ্য কোনো এক সত্তার সাথে দ্বৈরথে নেমেছে। হয় সে তার উদ্দিষ্ট প্রিয়জনের সংবাদ জানবে, নয়তো এই অবস্থানে অনড় থেকে প্রয়োজনে দেহত্যাগ করবে। এতণ হাহাকারের অনুভূতিটাই প্রধান ছিল। এবার তার সাথে যোগ হয় অদ্ভুত এক অবুঝ অভিমান। অভিমানÑ মা কেন তার জন্য অপোয় না থেকে এভাবে হারিয়ে গেল! অভিমান সে মৃত্যুপথের মতো দুর্গম এতগুলি বাধা অতিক্রম করে এসেও কেন মায়ের দেখা পেল না!

সন্ধ্যা নামা টেরই পায়নি পপীপ। নিজের ছায়া এবং নিজের শরীর যে অন্ধকারে ঢেকে গেছে তা-ও বুঝতে পারেনি। কিন্তু সচকিত হয়ে ওঠে দূরে আগুনের শিখা জ্বলে উঠতে দেখে।
ওদের গ্রাম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বনের সীমানা। আগুন দেখা যাচ্ছে সেদিকেই। আগুন দেখামাত্র নিজের মনের মধ্যে আবার আশার আলো জ্বলে উঠেছে পপীপের। আগুন মানেই তার পাশে মানুষ আছে। আর গ্রামের এই প্রান্তসীমায় আগুন মানেই হয়তো এমন কোনো মানুষ আছে সেই আগুনের পাশে, যে এই গ্রামেরই মানুষ। অথবা এই গ্রামের লোকজনের সংবাদ-বৃত্তান্ত তাদের জানা।
পপীপ টিলা থেকে নেমে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। পায়ের নিচে গর্ত থাকতে পারে। এবরোথেবরো মাটি। যে কোনো সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া এবং আহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। কিন্তু পপীপ সে বিষয়ে বিন্দুমাত্রও সচেতন নয়। সে ঐ আগুনটিকে ধ্র“ব ল্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। সঙ্গে কোনো আলো নেই। আত্মরার মতো কোনো অস্ত্র তো দূরের কথা। তবু ভয়ের কোনো অনুভূতি ছাড়াই বনের মধ্যে ঢুকে পড়ে পপীপ। পায়ের নিচে বিষধর সাপ পড়তে পারে, ভালুক এসে পথ আটকে আক্রমণ শানাতে পারে, বুনো মোষের দল এসে শিং-এর এক আঘাতে ফেঁড়ে ফেলতে পারে তার বুক-পেট। কিন্তু সেসব কথা মনেই আসে না পপীপের। সে হেঁটে চলেছে আগুনের দিকে। অন্ধকারে মাঝে মাঝে ধাক্কা খাচ্ছে গাছের সঙ্গে। পা হড়কে যাচ্ছে পিছল বুনো শ্যাওলায়। উঁচু-নিচু বনপথ। বার তিনেক গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। কিন্তু আবার উঠে দাঁড়িয়েছে তৎণাৎ। হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশ কেটে-ছড়ে গেছে কি না সেদিকে ভ্রপেমাত্র না করে আবার আগুনের শিখাটিকে ল্য ধরে চলতে শুরু করেছে।
 
আক্রমণ আসে অতর্কিতেই। তখন কেবল পপীপের মনে হতে শুরু করেছে যে সে আগুনের উৎস থেকে এখন আর বেশি দূরে নেই। হঠাৎ তার শরীরকে আপাদমস্তক জড়িয়ে ধরে ভারি একটা কিছু। পপীপ প্রথমে ভাবে কোনো অজগর সাপ তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কিন্তু পরণেই মনে হয়, অজগর পেঁচিয়ে ধরলে তো তারা শরীরকে এইভাবে আচ্ছাদিত করে ফেলতে পারবে না! হাত দিয়ে নিজেকে বেষ্টন করে ফেলা জিনিসটির প্রকৃতি বুঝতে চেষ্টা করে পপীপ। তখন বুঝতে পারে, অজগর সাপ নয়, আসলে তার আপাদমস্তক আচ্ছাদন করে ফেলা হয়েছে জাল দিয়ে। নারকেলের দড়ি পাকিয়ে পাকিয়ে শক্ত করে বানানো জাল। এটা দিয়ে বাঘ ধরা হয়। বনের রাজা বাঘও এই জালে আটকা পড়লে পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়ে। যত আছাড়ি-পাছাড়ি করে তত আটকে যায় জালের কঠিন বাঁধনে। পপীপ নিজে কোনোদিন এই রকম পরিস্থিতিতে পড়েনি। দেখেও-নি কখনো। তবে গল্প শুনেছে অনেক। শোনা অভিজ্ঞতাকেও বুদ্ধিমানরা একসময় নিজেদের অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে পারে। পপীপ সেই শোনা জ্ঞানকে কাজে লাগায় এখন। সে কোনো টানা-হ্যাঁচড়ার চেষ্টা করে না। জানে, যতণ পর্যন্ত কেউ এসে তাকে মুক্ত না করছে, ততণ পর্যন্ত এই ফাঁদ থেকে বেরুনোর কোনো উপায় নেই। পপীপ জানে না সে ঠিক কোন ধরনের শত্র“র হাতে পড়েছে। কিন্তু এখন তো আর তা নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই। কেউ এসে তার শরীর থেকে জালের ফাঁদ খুলে না নেওয়া পর্যন্ত তাকে এইভাবেই অপো করতে হবে। সেই অপো যে কতণের হবে কে জানে! এমনও হতে পারে, সারাটা রাতই হয়তো তাকে এইভাবে জালবন্দি হয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকতে হবে। পপীপ মনে মনে প্রার্থনা করে, যে-ই তাকে জালবন্দি করে থাকুক, তারা যেন তাড়াতাড়ি আসে। তারপর তার ভাগ্যে যা থাকে ঘটবে!

পপীপের সৌভাগ্য যে বেশিণ তাকে অপো করতে হয় না। পাশেই কারো কারো নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যায়। কোনো বন্যজন্তু নয়। এই নড়াচড়া মানুষের। বনের মধ্যে বন্যজন্তু এবং মানুষের নড়াচড়ার মধ্যে পার্থক্য খুব সহজেই বোঝা যায়। কেউ একজন খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে পপীপের। কথা বলছে না। কিন্তু লোকটা যে উত্তেজিত তা তার ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দেই বোঝা যাচ্ছে। নিজের ওপর এখন রাগ হচ্ছে পপীপের। অন্যমনস্কতার কারণে এখন এই ফাঁদে পা দিতে হয়েছে তাকে। কে জানে কাদের পাতা ফাঁদে পড়েছে সে! কৈবর্ত বা অন্য কোনো ভূমিপুত্রদের দল যদি তাকে জালবন্দি করে থাকে, তাহলে হয়তো এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে যেতে পারে। আর যদি রামপালের আর্য-দস্যুদের হাতে পড়ে থাকে, তাহলে আজ তার মৃত্যু অনিবার্য। একটু পরেই পাথরে পাথর ঠোকার শব্দ ওঠে। চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালায় কেউ একজন। তারপরই দপ করে জ্বলে ওঠে একটা মশাল। মশাল হাতে ধরা লোকটা পপীপের দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলÑ পেয়েছি বটি! আজ শিকার একটা পেয়েছি।

তার পাশে ছায়ার মতো এসে দাঁড়িয়েছে আরেকজন। তার দিকে তাকিয়ে গর্বের সুরে বলে মশালধরা লোকটাÑ দেখেছিস মোর জাল ছোঁড়া কী অব্যর্থ! অন্ধকারেও ঠিক আটকে ফেলেছি একেবারে!

অপরজন কথা না বলে আরো এগিয়ে আসে পপীপের কাছে। তার হাতে ছোট ছোট দড়ির টুকরা। সে এসে কথা নাই বার্তা নাই রামধাক্কা লাগায় পপীপকে। এমনিতেই জাল জড়ানো অবস্থায় টলমল করছিল পপীপ। এবার ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যায় বনের মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের একজন বেঁধে ফেলে পপীপের দুই পা, আরেকজন বাঁধে দুই হাত। তারপর চ্যংদোলা করে তাকে নিয়ে চলে সেই আগুনের দিকে, যে আগুনটিকেই ল্যবস্তু রূপে নির্ধারণ করে গোঁয়াড়ের মতো কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বনপথে ঢুকে পড়েছিল পপীপ। এখন এই অবস্থাতেও মনে মনে হাসে সে। যেখানে যেতে চেয়েছিল সেখানেই তো সে যাচ্ছে। শুধু যেভাবে যাচ্ছিল সেইভাবে যাওয়া হচ্ছে না এই যা পার্থক্য।

আগুনের কাছে পৌঁছে দেখা গেল সেটা আসলে বড় একটা উনুনের আগুন। রান্না হচ্ছে। অনেক মানুষের সাড়া পাওয়া গেল আগুনকে ঘিরে। ধপাস করে পপীপকে মাটিতে আছড়ে ফেলে তাকে বয়ে আনা লোক দুজন। সঙ্গে সঙ্গে একটা শোরগোল। পপীপকে বেঁধে আনা লোক দুজন খুব গর্বের সাথে নিজেদের কৃতিত্বের বর্ণনা দিচ্ছে সঙ্গীদের কাছেÑ ‘একটা খোল ধরে এনেছি বটি। পেছন থেকে মোদের ঘাটির দিকে গুড়ি গুড়ি আসছিল বনপথ দিয়ে। ’ চারপাশে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে বেশ কয়েকজন লোক। আগুনের আভা এবং আলোতে তাদের অবয়ব পরিষ্কার দেখতে পেয়ে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে পপীপ। ওরা সবাই কৈবর্ত বলেই মনে হচ্ছে। তাকে ঘিরে বৃত্ত বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন। পেছন থেকে এগিয়ে আসে আরেকজন। সাধারণ কৈবর্তদের তুলনায় সে এক মাথা বেশি উঁচু। তাকে ভালোভাবে নিরীণ করে পপীপ। এবং তারপর নিজের অজান্তেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেÑ মল্লকাকা!

লম্বা সুদেহী মানুষটা আরো কাছে এগিয়ে আসে। আলো-আঁধারির মধ্যেও চোখ টানটান করে দৃষ্টিতে আরো তীèতা এনে চিনবার চেষ্টা করে মাটিতে ফেলে রাখা বন্দিকে। কিন্তু ঠিক চিনতে পারে না। অনিশ্চিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেÑ কে বটি তুই?
মল্লকাকা আমি পপীপ।

পপীপ? কোন পপীপ?

বট্যপের ব্যাটা পপীপ। সেই যে রামশর্মার ইুতে! আমি তোমার শিষ্য পপীপ। সেই যে আমাকে তুমি অর শিখিয়েছিলে? পরে রেখে এসেছিলে ঊর্ণাবতীর কাছে।

শশব্যস্তে এগিয়ে আসে মল্ল। হাঁক ছাড়ে সঙ্গীদের ল করেÑ এই শিগগির খুলে দে ওর বাঁধন!

হাত-পায়ের বাঁধন, আর আচ্ছাদিত করে রাখা জাল খুলে নেওয়ার পরে নিজের শক্তিতেই উঠে দাঁড়ায় পপীপ। যারা ওর হাত-পা বেঁধেছিল, তারা যে খুব দ এই কাজে, তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে পপীপ। এতই জোরে বাঁধা হয়েছিল তাকে যে এখন বাঁধন খুলে দেবার পরে মনে হচ্ছে তার চামড়া ভেদ করে মাংস কেটে বসে গিয়েছিল নারকেলের দড়ি। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন হঠাৎ করে রক্ত চলাচল বাড়তি বেগে শুরু হওয়ায় মনে হচ্ছে আগুন ধরে গেছে হাত-পায়ে। কিন্তু সেই তীব্র ব্যথা উপো করে সটান দাঁড়িয়ে থাকে পপীপ। শরীরের যন্ত্রণার চাইতে মনের খুশির জোর এখন অনেক বেশি।

তার সামনে এসে দাঁড়ায় মল্ল। একপাশে টেনে নিয়ে আগুনের আলোতে এমনভাবে দাঁড় করায়  পপীপকে যেন পুরোপুরি দেখতে পাওয়া যায় তার মুখমণ্ডল। দুই হাতে কাঁধে চাপ দিয়ে পপীপের মুখটাকে নিজের চোখের সোজাসুজি করে নেয় মল্ল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ল করে পপীপের মুখ। ছয় বছরের শিশুর মুখকে কী আর আঠারো বছর পরে চিনতে পারা যায়! কিন্তু তবুও মল্ল দেখছে তো দেখছেই। বোঝা যায়, পপীপের কথা শুনে তার মন থেকে পপীপের পরিচয় নিয়ে সমস্ত সংশয় আগেই দূর হয়ে গেছে তার। সে আসলে এখন পরিমাপ করছে যুবক পপীপের শারীরিক-গাঠনিক যোগ্যতাকে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার পরে তার চোখে প্রশংসার দৃষ্টি ফুটে ওঠে। মুখে বলেÑ যাক! লেখাপড়া শিখে ব্রাক্ষ্মণদের মতো পলকা হয়ে যাসনি তাহলে! কৈবর্তের রক্ত বইছে তো শরীরে। সেই তেজ থাকবেই শরীরে। আর সেই তেজের ঝলকানিও দেখা যাবে সময় এলেই।

এতণে আলিঙ্গন করে সে পপীপকে। এইবার পপীপের মনে হলো আঠারো বছর আগে যে বুকটা তার কাছে বরাভয় হয়ে দেখা দিয়েছিল, সেই বুকের স্পর্শই সে ফিরে পেয়েছে আবার। তাকে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে যায় মল্ল। প্রশংসার দৃষ্টি নিয়ে আবার পপীপকে দেখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। বিড়বিড় করে বলেÑ হ্যাঁ। আমি যেমনটি চেয়েছিলাম, ঠিক তেমনটি হয়েই তুই বেড়ে উঠেছিস বটি! তা আমাকে তুই চিনতে পারলি কেমন করে? এত বছর বাদে কীভাবে ঠিক ঠিক চিনে নিলি আমাকে?

হাসে পপীপ মল্ল কৈবর্তকে যে একবার দেখে, সে কী তাকে কখনো ভুলতে পারে! তুমি হুবহু আগের মতোই আছো মল্লকাকা।
দূর তা কি করে হয়? এতগুলান বছর পার হয়ে গেছে। তুই সেই শিশু পপীপÑ এখন পুরো যুবক হয়ে গেছিস। তাহলে আমি কি আর বুড়ো হইনি? হুবহু আগের মতো থাকি কেমন করে!
সত্যি বলছি মল্লকাকা তুমি এক ফোঁটাও বদলাও নি!

আচ্ছা আচ্ছা এসব কথা পরে শোনা যাবে বটি। আগে তুই একটু জিরিয়ে নিয়ে চারটে মুখে দে। তারপরে কথা হবে।
সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে মল্ল হা করে তাকিয়ে দেখছ কী? এ হচ্ছে মোর শিষ্য মোর পুত্র পপীপ। খাঁটি কৈবর্ত। সেই প্রাগজোতিষ-কামরূপ থেকে ও এসেছে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করবে বলে। আর সবচেয়ে কাজের যুদ্ধবিদ্যা শিখে এসেছে ছেলে আমার।   যাও, ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করো!

 [চলবে]

বাংলাদেশ সময় ২২২০, জানুয়ারি ১৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।