ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মাসুদ খানের প্রিয় ১০ কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১১
মাসুদ খানের প্রিয় ১০ কবিতা

[আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতায় একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়। বাংলাদেশের কবিতা, বিশেষত পূর্ববাংলার কবিতা, নিজস্বতা অর্জন করে পঞ্চাশ দশকের কবিদের হাতে।

তারপর ষাট-সত্তর পর্যন্ত এটি মূলধারা হিসেবে রাজত্ব করে একটি স্থির প্রতিষ্ঠানের রূপলাভ করে, যা একটি অচলায়তন তৈরি করে। ফলে কবিতার নতুন বোধ-ভাষার একটি সময়োচিত দাবি তৈরি হয়।

 ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বাঙালির যে দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাধনা, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশের কবিতা। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রামের অবসানের পর যেমন যোদ্ধাদের ভেতর এক ধরনের ক্লান্তি আসে, তারা যেমন নিজেদের অর্জিত নতুন বাস্তবতার সঙ্গেই খাপ খাওয়াতে গিয়ে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন, কিছু বিশিষ্ট ব্যতিক্রম বাদে, বাংলাদেশের কবিদের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে এমনটি ঘটেছে।

ফলে স্বাধীনতা-উত্তর নতুন সামরিক ও লুটেরা বাস্তবতা, স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ, প্রজন্মের আশা-হতাশা-স্বপ্ন আর পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগের আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বচিন্তার নতুনতর পাঠ ও বিবেচনা, নিজস্ব ঐতিহ্যর পুনর্পাঠ আশির দশকের তরুণ কবিদের কবিতায় নতুন পথে হাঁটার প্রণোদনা দেয়। যদিও এই পথহাঁটা প্রশ্নহীন নয়, তাদের অর্জনও এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট নয়।

মাসুদ খান এই প্রজন্মেরই কবি। বিজ্ঞান-মনস্কতা, কল্পনা ও বাস্তবতার অপূর্ব যোগসূত্র তৈরি, নিজস্ব ভাষাশৈলী, ছন্দোবোধ ও পাঠ সচেতনতা সম্ভবত এই কবির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

একসময়ের খুব সক্রিয় কবি মাসুদ খান এখন কানাডাপ্রবাসী। সম্ভবত লিখছেনও কম। কিন্তু মাসুদ খানের সৃষ্টিসম্ভার থেকে রসিক পাঠকের গ্রহণ করার এখনো আছে নানা রস-উপাদান। তাকে বোঝার জন্য যেমন, তার বিরোধিতার জন্যও তাকে পাঠ করা দরকার। তাই তার নিজের নির্বাচিত কিছু কবিতা থেকে একগুচ্ছ আমাদের পাঠকদের জন্য। -সৈকত হাবিব ]    
 
বৃষ্টি-২

বৃষ্টি হচ্ছে
বিদেশে
আরো কত কত আবছা ব্রহ্মদেশে, রঙ্গপুরে,
ব্যাপিত বগুড়াবর্ষে,
অনেক নিম্নের দেশে, ম্লেচ্ছাবর্তে,
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসা
বিকালের ব্রহ্মদেশে,
বৃষ্টি হচ্ছে।

এবং উপর্যুপরি এই বিজলিশাসনের নিচে
এই বৃষ্টিনির্ধারিত তৃতীয় প্রহরে
দেশে দেশে কত রাঙা ও রঙিন জাতি
অস্পষ্ট গঠন নিয়ে ফুটে উঠছে উৎফুল্ল ভেকের মতো
অজানা উৎক্ষেপে।

বৃষ্টি আর বিদ্যুতের এই সহিংস প্ররোচনাক্রমে
চূড়ান্ত প্রশ্রয়ে
প্রলোভনে
বৃষ্টির প্রবল ঘোর আর
ঘূর্ণির ভেতর
বাতাসের অন্ধকারে
পূর্বাঞ্চলে
আকাশের নিচে
একাংশে, বিশাল ফাঁকা মাঠে
বিস্তারিত কচুখামারের আড়ালে আড়ালে
প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে জায়মান নতুন-নতুন সব রাষ্ট্র
ডানাভাঙা উত্থানরহিত কত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র
তাদের ময়লা মানচিত্র
এবং অস্থির কাঁপা-কাঁপা ক্ষেত্রফল
অশোধিত আইন এবং সব অসহায় খর্বকায় ন্যায়পাল
এবং অপরিষ্কার কিছু কুচকাওয়াজসমেত জেগে উঠছে শুধুই
শুধু যমনির্দিষ্ট নিয়তি নিয়ে।

এইবার রাত্রি সমাপ্তির দিকে প্রবাহিত। এখন বৃষ্টিও নিভুনিভু-প্রায়।
ওইসব কথিত উল্লাসশীল জাতি আর বিকাশচঞ্চল রাষ্ট্র আর
তাদের শরীরে
গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে স্ফুটমান আর সদ্যফোঁটা কত-না বর্ণাঢ্য ধর্মরাজি
সবসহ অচিরে মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
ভোরের আলোয়। বিস্তারিত কচুপ্রান্তরের আড়ালে আড়ালে।

একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার

বনের কিনারে বাস, এক ছিল রূপবর্ণদাসী
আর ছিল, বনে বনে একা ঘোরে, সেই এক বিপিনবিহারী।
কন্যা তো সে নয় যেন বন্য মোম, নিশাদল-মাখা, বন্য আলোর বিদ্রূপ
রাতে মধ্যসমুদ্রে আগুন-লাগা জাহাজের রূপ
অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে-
দূর থেকে তা-ই দেখে কত রঙ্গে, কতরূপ ছলে ও কৌশলে
বেহুঁশ হয়ে যে যায়-যায়-প্রায় কত যে বামন গিরিধারী
আর যত অন্য-অন্য অর্বাচীন বিপিনবিহারী।

 কন্যা তো সে নয়, বুনো সুর, বুনো তান, আর উপমান অরণ্যশোভার।
আঁচলে কূজন আঁকা তার, সেই বহুবল্লভার।

বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তারা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।

একটি ভোরবেলা : সদ্য খসড়া-করা

ভোরের বাতাস আজ উন্নত দেশের
কাগজি টাকার মতো সপ্রতিভ-
একটানা সতেজ কখনো, কখনো-বা থেমে থেমে।

আর এই প্রভাতবেলায়
লালায়
রেশমসূত্রের গ্রন্থনায়
গাছে গাছে এখন গ্রন্থিত হয়ে আছে
প্রবন্ধের পাতার আকারে বহু উড়ন্ত জটিল পাতা
স্থগিত হয়ে থাকা কাণ্ডে, কাণ্ডজ্ঞানে,
অবাক বিন্যাসে যথা নদীর ওপারে।

কিছুক্ষণ আগেই এই তো
বেশ কিছু স্ফূর্তিশীল পাখি ও পতঙ্গ
তোলপাড় করছিল পৃথিবীর গাছে গাছে।
আকাশ তাদের জব্দ করে নিয়ে চলে গেছে অনেক উঁচুতে
মাখন-রাঙানো মেঘরাজ্যে
ওই ঝুরঝুর ঝরে পড়া চিকচিকে সোনালি চিনির দেশে-
মেঘে মেঘে প্রচারিত আজ তাই অনেক অচেনা কোলাহল।

অগ্রহায়ণের এই ভোরবেলা
দৃশ্য আর ঘটনার এই যে অসহ্য অতর্কিত রূপ
এসবের অন্তরালে, নিসর্গের কোন্ অভিপ্রায়,
সে-কোন্ প্রবাহে, ছকে, সে-কেমন ভাষ্যে, ব্যঞ্জনায়
কীভাবে যে মীমাংসিত হয়ে আছে!
ভোগী মানুষের অন্নগত প্রাণ আর
ব্যসনব্যঞ্জন উপলব্ধি দিয়ে যতদূর বোঝা যায়, বুঝি,
বুঝতে প্রয়াস পাই,
যতভাবে অনুভব করা যায়, করি।

আজ অগ্রহায়ণের এই তাক-লাগানো প্রভাতবেলা-
একা আমি বসে বসে ওইসব পাখিহারা স্তব্ধ গাছে গাছে
একটু একটু করে পাখি আর মৌমাছি মেশাই,
একটির পর একটি মৌচাক বসিয়ে যাই ডাল থেকে ডালে-
কিছুটা বিশেষ্য করে তুলি।

তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ

একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।

আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে..., কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়!

এ-মধুদিবসে আকাশে বাতাসে জাগে
ঘর ছাড়বার একটানা প্ররোচনা।
হারিয়ে পড়তে নদী মাঠ বায়ু ডাকে
ঘরে ঘরে তাই গোপন উন্মাদনা।

জগতের যত সংসারছাড়া লোক
ঘুরে ফিরে শেষে সরাইখানায় স্থিত।
এ-স্নেহবর্ষে তুমি কি চাও যে, হোক
ঘরছাড়া ফের ঘরেই প্রতিষ্ঠিত?

হারানো মানুষ সেই কত কাল ধ’রে
স্বজনের ভয়ে দেশ থেকে দেশে ঘোরে।
স্বজনেরা তবু নানান বাহানা ক’রে
বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে!

স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়।
স্বজন যখন নিরাশাদ্বীপের পথে
হারানো খুঁজছে নতুন এক অধ্যায়।

ছক

দশটি পথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, ক্ষয়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুন রাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।

একদিন আসা-যাওয়ার পথের ধারে মা কুড়িয়ে পেলেন আমার ভাইকে (আমি তখনো আসিনি আমার এই মায়ের কাছে)। কিন্তু কিছুকাল পর আমার সেই ভাই হঠাৎ গেল হারিয়ে। তারপর থেকে মা আমার ওই পথমোহনায় বসে তীব্র পুত্রশোকে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন।

একবার, গোধূলিরঙের লম্বা-লম্বা চুলদাড়িঅলা এক বুড়ো পথিক ক্ষণিকের জন্যে থামালেন তার পথচলা। মা-র কাছে সব শুনে বললেন, ‘কোথাও তো কিছু হারায় না মা এই মহাবিশ্বে! যাও খুঁজে দ্যাখো। ’ তারপর থেকে মা আমার উড়ে উড়ে বিশ্বসংসার তোলপাড় করে খুঁজে ফিরেছেন তার সন্তানকে। শেষে সপ্ত-আকাশের পরপারে আমাকে কুড়িয়ে পেয়ে, এবং তার সন্তানকেই পেয়েছেন মনে করে, উড়িয়ে নিয়ে এলেন এই মর্ত্যরে ধুলায়। আমি তখন সাত আসমানের ওপারে অনন্ত নত্রকুঞ্জের ঝাড়জঙ্গলের ধারে সোনালি খড়ের গাদায় বসে অনাথ শিশুর মতো কাঁদছিলাম একা একা, মাকে হারিয়ে।

দিন যাবে, মাস যাবে, ঘুরে আসবে বছর...
একদিন হয়তো আবার হারিয়ে যাব আমি এই নতুন পাওয়া মায়ের কাছ থেকে আর আমাকে খুঁজে পাবেন অন্য এক মা। তারও হারিয়েছে সন্তান। আমাকে পেয়ে ভাববেন, খুঁজে পেয়েছেন তারই হারানো ছেলেকে।

এইসব অনন্ত বিভ্রম আর বন্ধন
এই যে নিখিল ভুলবোঝাবুঝি
লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা আর হারানো-পাওয়া খেলা
এইসব নিরন্তর মায়া ও ম্যাজিক...
সবকিছু অমীমাংসিত রেখে দিয়ে,

কাটাকুটি ময়লা ডুপ্লিকেট নকশা একখানা জগৎসংসারের,
তা-ই মেলে ধরে অবাক উদাস হয়ে বসে আছেন জরিপকর্তা।

 নকশাটাতে একপাশে লেখা- স্বার/- অস্পষ্ট
নিচে তার চেয়েও অস্পষ্ট একটা সিল...

জ্বরের ঋতুতে

তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধস-নামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট...ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে...সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উতরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নাই, তাপাঙ্ক নাই...তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন বীর্যতরল।

তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। কেবল তাদের কিছুটা কদাকার দেখায়, কিছুটা পিশাচীর মতো।
যত রূপসী তত কদাকার...

একসময় মাথাফাটা থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চ’ড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি প্রিয়তরা পিশাচী আমার।

জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস...
মিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা রেতঃনির্যাস।
 
দূরের গ্রহে বসে...

অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে আকাশ ঢাকা
গায়ে তার জ্বলে কোটি-কোটি প্লাংক্টন
তারই মাঝে একা একটি শ্যামলা মেঘে
সহসা তোমার মুখের উদ্ভাসন।

 হয়তো এখন আকাশ নামছে ঝেঁপে
মেঘ ও মেঘনার ছেদরেখা বরাবরে
ঝাপসা একটি মানুষীর ছায়ারূপ
ঝিলিক দিয়েই মিলাচ্ছে অগোচরে।

দূর গ্রহে বসে ভাবছি তোমার কথা
এতটা দূরে যে, ভাবাও যায় না ভালো
ভাবনারা হিম-নিঃসীম ভ্যাকুয়ামে
শোধনে-শোষণে হয়ে যায় অগোছালো।

অথচ এখানে তোমারই শাসন চালু
তোমার নামেই বায়ু হয়ে আমি বই
তোমারই আবেশে মেঘে বিদ্যুৎ জাগে
তোমার রূপেই ময়ূর ফুটেছে ওই।

 মধুকর আজ ভুলে গিয়ে মাধুকরী
রূপ জপে তব কায়মনোগুঞ্জনে।
মনন করছে তোমারই বিম্বখানি
ধ্যানে ও শীলনে, স্মরণে, বিস্মরণে।

গন্ধকের এই গন্ধধারিণী গ্রহে
তটস্থ এক বিকল জীবের মনে
ক্ষার, নুন, চুন, অ্যাসিড-বাষ্প ফুঁড়ে
চমকিয়ে যাও থেকে-থেকে, ক্ষণে-ক্ষণে।  
 
শূন্য

নিখিলের হঠাৎ-বিগড়ে-যাওয়া সে-কোন গোপন সংখ্যামেশিনের থেকে অচেনা
অসুখের মতো, অজ্ঞাত গজবের মতো গলগল করে বেরিয়ে আসছে সব শূন্য।

সাধের মেশিন থেকে আশা ছিল বেরিয়ে আসবে কত-না বিচিত্র অঙ্ক আর সংখ্যা
আর ভরে যাবে এই দুখিনী দুনিয়া! তা নয়, কেবলই শূন্য।
তা-ও শূন্যগুলি সব দশমিকের ডানে বসা একটানা শূন্যের সিরিজ-
অর্থহীন উদ্বৃত্ত বন্ধ্যা ও হাহুতাশময়!

এক মহামেশিনের বিপুল ববিন থেকে, গোপন ও প্রকাশ্য সব স্লট থেকে
চিরতরে ছাড়া পাওয়া যেইমতো মাইল-মাইলব্যাপী সুতার বহর
সেইমতো এইসব খরস্রোতা শূন্যের নহর...

অন্য কোনো অঙ্ক নাই সংখ্যা নাই শুধু শূন্য উপচে উপচে আসা
লাফাংগার মতো লাফাতে লাফাতে আর গড়াতে গড়াতে আসা
বহরে বহরে পাতা আর পাতার বাহার করতে করতে আসা
ইঁদুর ও ভোঁদড়ের ভঙ্গি ধ’রে লীলা আর লাস্য করতে করতে আসা
চিকা আর চামচিকার মতো হাস্য ও রহস্য করতে করতেই
দিল্মে চাক্কুমারা পাগলা ও ভোলাভালা হাক্কু ও হাহাকার করতে করতে আসা
দশমিকের ডানে-বসা কানে-ঠসা কালা-নুলা নেলাফেলা খাটাশ-খবিশ নষ্ট-ভ্রষ্ট
ডাহা-ডাহা যত শূন্যের দল ভয়াবহ শূন্যের কাফেলা..............................

আর ওই যে বিকট বেঢপ অতিকায় এক শূন্য,
ওটাই পালের গোদা, আন্ধা-কালা কাফেলাসালার...
এসব কি স্রেফ বিগড়ে-যাওয়া সেই গূঢ় মেশিনের ঋতুবিভ্রম!
দশমিক-পরবর্তী শূন্যের প্রবাহ হয়ে মহাশূন্য ভরে ফেলছে ক্রমে

এমনিতেই জড়ের দুর্বহ দায়ভার
তদুপরি শূন্যের শাসন, অত্যাচার
কোথায় পালাবে তবে প্রাণ!
প্রাণী সব করে রব, ভয়ে-
বদ্ধ ও তটস্থ প্রাণিকুল
ফাজা আলাহুম কা’স ফিম্মাকুল।

ইতিমধ্যেই যে শূন্যস্থানগুলো তৈরি হয়ে আছে
সেগুলো তো পূরণ হচ্ছেই না, বরং তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন শূন্যস্থান
মহাশূন্য আরো মহা শূন্য হচ্ছে...

অবশেষে একসময় শূন্যস্থান দিয়েই, যাঃ, পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে
খসখসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, দিনদুনিয়ার।

ইতিহাস

কী করে সম্ভব তবে পৃথিবীর সঠিক ইতিহাস? কারণ, যিনি লিখেছেন, তিনি কে এবং কোথায়? কোন্ সময়ে, কোন্ অবস্থানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশ্যে লিখছেন, সে-সবের ওপর নির্ভর তার ইতিহাস। আর তা ছাড়া বিষয়টি বিষয়ীগত, সাবজেকটিভ।

তবে কি সত্যিই অসম্ভব সঠিক ইতিহাস?

-না। ভূমণ্ডল হতে এ যাবৎ যত আলো বিকীর্ণ  হয়ে চলে গেছে সে-সবের মধ্যেই মুদ্রিত হয়ে আছে পৃথিবীর ইতিহাস, কালানুক্রমিক। অর্থাৎ পৃথিবী হতে বিচ্ছুরিত আলোর ইতিহাসই পৃথিবীর ইতিহাস। আর তা-ই হচ্ছে প্রকৃত ইতিহাস, কেননা তা লিখিত প্রাকৃতিকভাবে। এই নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে বসে দূরবীণ দিয়ে সেগুলি টুকে নিচ্ছে হয়তো-বা কেউ কেউ-আমরা জানি না।

তবে সে-ও কি হবে সঠিক ইতিহাস? কেননা, ইতিহাসের সেই সব অধ্যায়, যেগুলি কালো এবং অন্ধকার? সব আলো শুষে নিয়ে নিয়ে যেগুলি কালো ও কলঙ্কিত হয়ে পড়ে আছে? যেগুলি থেকে কোনোকালেই আর বের হয়নি এবং হচ্ছে না কোনো আলো? সেইসব?

তা ছাড়া সেই সব মানুষদের ইতিহাস, যারা কালো এবং কালচে তামাটে?

 -হয়তো-বা দূরবীণে ঝাপসা হয়ে ধরা পড়ছে তাদের ইতিবৃত্ত, ঝাপসা মুদ্রিত হচ্ছে তাদের ইতিহাস-যেহেতু তারা যথাক্রমে কৃষ্ণ এবং ঊনকৃষ্ণ, যেহেতু তারা খুবই সামান্য আলো দিতে পারে বলে পৃথিবীতে প্রচারিত, বিচ্ছুরণে তারা প্রায় অক্ষম বলে প্রচারিত।

তাহলে কি কালো ও তামাটে মানুষদের ইতিহাস নিরন্তর ঝাপসাই থেকে যায়!? পৃথিবীতে!? এবং প্রকৃতিতে!? আলো নেই, তাই ইতিহাসও নেই!?
 
ফুটে থাকে রজনীস্পর্শা ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী

লক্ষ-লক্ষ মাইল উঁচুতে, মহাকাশে,
জনমানববিহীন ভাসমান একটি স্পেস-স্টেশনে পোস্টিং পেয়ে
এসে জয়েন করেছে একজন নভো-টেকনিশিয়ান।

একদিন একটি রকেট এসে প্রচুর বোঁচকা-বুঁচকিসহ তাকে নামিয়ে দিয়ে,
ফুয়েল-টুয়েল নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কোন আসমানের ওপারে...
সে-ও কতদিন আগে!

মৃত্যুরও অধিক হিম আর নির্জনতা...
মানুষটি একা-একা থাকে, খায়, ঘুমায়-ওজনহীন, নিঃসাড়, নির্ভার...
মাঝে মাঝে নভোপোশাক পরে বাইরে সাঁতার কেটে আসে শূন্যে,
লম্বা লাঙুলে বাঁধা, অ্যালুমিনিয়ামের; স্টেশনের মাস্তুলের সঙ্গে।

দুঃখে-অভিমানে কখনো কখনো গিয়ে হেগেও আসে মহাকাশে
জ্বলজ্বল করতে থাকে তার সেই স্বচ্ছ-সুগন্ধ পুরীষপিণ্ড,
স্ফটিকের মতো ফোঁটা-ফোঁটা মূত্ররাশি...

কাছে-দূরে কোত্থাও কেউ নাই,
কোনো প্রেত-প্রেতিনী, অথবা কোনো যম-যমী, জিন-পরি, ভগবান-ভগবতী,
ফেরেশতা-ইবলিশ কাঁহা কিচ্ছু নাই, কেউই ঘেঁষে না কাছে, যে,
তার সঙ্গে একটু কথা বলবে, কফি খাবে...
এমনকি মানুষটা যে একটু ভয় পাবে, তারও উপায় নাই...
নিজের সঙ্গেই তাই নিজেরই মিথুন ও মৈথুন, খুনসুটি, হাসাহাসি, সাপলুডু খেলা...

কেবল রজনীস্পর্শা, ভীষণবর্ণা এক গন্ধরাজ্ঞী ফুটে থাকে অবাধ, অনন্তরায়...
বহুকাল দূরে...

masud-khan

 

 

 

 

বাংলাদেশ সময় ২১৩৫, জানুয়ারি ১২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।