ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

প্রসঙ্গ জৈমিনি মহাভারত

সুব্রত কুমার দাস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১০
প্রসঙ্গ জৈমিনি মহাভারত

খ্রিস্টপূর্ব  ৩৫০০ থেকে  ১৫০০ সালের মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাভারত-এর লেখক হিসেবে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস ওরফে ব্যাসদেবকেই আমরা জানি। বাঙালি পাঠক মহাভারত বলতে প্রধানত বোঝেন কাশিদাসী মহাভারতকে।

বাজারে মোটামুটি ১২০০ পৃষ্ঠার মহাভারতের কাব্যানুবাদটি বিভিন্ন সংস্করণে লভ্য। কিন্তু আমরা কজন কাশীদাসী মহাভারত পড়েছি? অধিকাংশের দৌড় রাজশেখর বসুর সারানুবাদ পর্যন্ত। বোদ্ধাজনেরা যদিও কালীপ্রসন্ন সিংহ পর্যন্ত যেতেই পছন্দ করেন। তা না হলে নাকি মহাভারতের স্বাদ পাওয়া যায় না।

শৈশব থেকে আমরা পরিচিত হতে শুরু করি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের মহাভারতের সাথে। এভাবে এগুতে এগুতে ক্রমে কাশীদাসীতে যেয়ে ঠেকে। আর হরিদাস    সিদ্ধান্তবাগীশের ১৯ হাজার ৫৭২ পৃষ্ঠার ৪৩ খণ্ডের বঙ্গানুবাদটি তো খুব কম পাঠকের কাছেই পৌঁছায়! তবে এত সব মহাভারতের সব কটিই কিন্তু কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মূলকে আশ্রয় করে। তবে ভারতের অনেক অঞ্চলে জৈমিনির মহাভারত নামে মহাভারতের একটি সংস্করণ প্রচলিত আছে। সে মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি জৈমিনি।

প্রাচীন ভারতবর্ষের মীমাংসা দর্শনের অন্যতম প্রধান ঋষির নাম জৈমিনি। বেদব্যাসের পিতা ঋষি পরাশরের পুত্র জৈমিনি ছিলেন মহর্ষি বেদব্যাসের শিষ্য। বেদ চার ভাগে ভাগ করার দায়িত্ব যে চারজন মুনিকে দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে পৈইলা, বৈশম্পায়ন ও সমান্তুর সাথে জোতির্বিদ্যায় প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী জৈমিনিও ছিলেন। তাঁর ভাগে পড়েছিল সামবেদ। তিনি মার্কণ্ডেয় পুরাণেরও রচয়িতা। বাংলাভাষী অঞ্চলে যেমন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারত বিশেষ পরিচিত, তেমনি ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে জৈমিনি রচিত মহাভারতের জনপ্রিয়তা বেশি। জৈমিনির সে মহাভারতের প্রধান অংশ হলো অশ্বমেধিক পর্ব; যদিও জৈমিনি অন্যান্য পর্বেরও রচনা করেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু ঐ একটি পর্বই বর্তমানকাল পর্যন্ত পাঠকের কাছে লভ্য। মূল সংস্কৃত থেকে সে গ্রন্থটি জৈমিনি ভারত শিরোনামে রোহিনীনন্দন সরকারের গদ্য অনুবাদে বাংলাভাষায় ১২৯১ বঙ্গাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।

পৌরাণিক কাহিনিটি এমন যে বৈশম্পায়নের সাথে জৈমিনিও বেদব্যাসের নিকট থেকে মহাভারত শ্রবণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মহাকাব্যটির কিছু কিছু বিষয়ে জৈমিনির মধ্যে দ্বিধা জাগে। কিন্তু সে সময় বেদব্যাস উপস্থিত না থাকায় জৈমিনি সেকালের আরেক খ্যাতিমান ঋষি মার্কণ্ডেয়র কাছে যান। মার্কণ্ডেয় নিজেও তখন তীর্থযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তাই তিনি জৈমিনিকে বিন্ধ্যপর্বতে বাসরত চার পাখির কাছে যেতে নির্দেশ দেন। পিঙ্গ, বিবধ, সুপুত্র এবং সুমুখা নামের সে চার পাখি যেমন ছিল ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ বিষয়ে অবগত, তেমনি তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তারা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারত। জৈমিনির প্রধান প্রশ্ন ছিল দুটি : একটি দ্রৌপদীর পঞ্চবিবাহের সম্ভাবতা নিয়ে এবং অন্যটি দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রের অকাল মৃত্যুর গূঢ় কারণ নিয়ে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে এ সংক্রান্ত সংলাপ বর্তমান।

জৈমিনি ভারত-এ মোট ৬৮টি পর্ব রয়েছে। শুরু হয়েছে ‘মঙ্গলাচরণ, জনমেজয় প্রশ্ন, যুধিষ্ঠির বাক্য, অশ্বমেধ কল্পনা ও ভীমবাক্য’ দিয়ে আর শেষ হয়েছে ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপ্তি’ দিয়ে। বাংলা ভাষায় বইয়ের আকারে এ মহাভারতটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৩৮। এ মহাভারতেও শুরুতে নারায়ণ, সরস্বতী এবং ব্যাসদেবকে প্রণাম করা হয়েছে। এবং প্রথম অধ্যায়ে জনমেজয়ের প্রশ্ন রয়েছে জৈমিনির নিকট। প্রশ্নটি হলো, ‘আমার পূর্ব্ব পিতামহ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কীরূপে সবান্ধবে যজ্ঞপ্রধান অশ্বমেধের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, অনুকুম্পাপুরঃসর তাহা যথাবৎ কীর্ত্তন করিয়া আমার কৌতূহল চরিতার্থ করুন। ’ জনমেজয়ের সেই কৌতূহল চরিতার্থ করতেই জৈমিনির মহাভারত আখ্যান। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে কৈষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাভারতে কাহিনী বর্ণনার এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন বৈশম্পায়ণ, যিনি উপস্থিত ছিলেন জনমেজয়ের সর্পসত্রে।

বাংলা ভাষায় মহাভারত অনুবাদের প্রথম যুগে সঞ্জয়, কবীন্দ্র, শ্রীকর নন্দীসহ পরবর্তী অধিকাংশ অনুবাদকগণ জৈমিনি মহাভারতকে আশ্রয় করেছেন। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (৩য় পরিবর্ধিত সংস্করণ কলকাতা, ১৮৯৭) জানিয়েছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের তুলনায় জৈমিনি ভারতের বেশি গ্রাহ্যতার কারণ। ব্যাসকৃত মহাভারত বিশালাকায় হওয়া একটি প্রধান প্রতিবন্ধক কোনও সন্দেহ নেই। অন্য আরেকটি কারণ হলো হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানকারীদের মধ্যে জৈমিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাই মধ্যযুগের বাংলাদেশে জৈমিনি মহাভারতের কদর বৃদ্ধি পায় যেটি কাশীদাস কর্তৃক মহাভারতের অনুবাদের সাথে হ্রাস পাওয়া শুরু করে। সবশেষে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের গদ্যানুবাদের সাথে সাথে বাংলাভাষী অঞ্চলে যে মহাভারত সবচেয়ে বেশি আদৃত হয়েছে গত এক শতাব্দীর বেশি কাল ধরে সেটি হলো কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাভারত।  
[email protected]

বাংলাদেশ সময় ২০৩৫, ডিসেম্বর ২৯, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।