ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শফিক আলম মেহেদীর কবিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১০
শফিক আলম মেহেদীর কবিতা

একজন ক্রীতদাস ও একটি গাধার কাহিনী
 
আজকাল প্রায়শ এমন হয়
আমি আমার মাথা খুঁজে পাই না
মেরুদণ্ড, সে এখন দূর অতীতের স্মৃতি!
সতত প্রশ্ন জাগে, জন্মলগ্নে
আমি কি স্বাভাবিক মানবশিশু ছিলাম
নাকি মাথা ও মেরুদণ্ডহীন
সরীসৃপজাতীয় প্রাণী
ক্ষুধা ভিন্ন অন্য কোনো অনুভূতি
যাদের স্পর্শ করে না?

যদ্দুর মনে পড়ে
আমি মানুষ হয়েই জন্মেছিলাম
একদিন হিমালয়ের চূড়া
কাঞ্চনজংঘার সুউচ্চ শৃঙ্গ
অসীম আকাশ অতল সমুদ্রদেশ
এসব আমার নাগালের মধ্যে ছিল
আমি তখন মানুষ ছিলাম!

দারিদ্র্য দৈন্য বৈরী ভাগ্য
অথবা  মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা
আমার পিতা-মাতাকে
সন্তান মানুষ করার কঠিন অঙ্গীকার থেকে
একচুল বিচ্যুত করতে পারেনি
তাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য
পা-চাটা গোলামের
রাজসুখ নয়
উদয়াস্ত খেটে খাওয়া
শ্রমিক কৃষক অথবা ধীবরের
অবাধ উন্মুক্ত জীবন চেয়েছিলেন
হায় আমার দুর্ভাগা জনক-জননী
আমি আপনাদের যুগল স্বপ্নের
রূপকার হতে পারলাম না
আমার ব্যর্থতা ক্ষমা করবেন।

অভিজ্ঞতায় জেনেছি
মানুষের ভেতর যুগপৎ বাস করে
একজন চক্ষুষ্মান মানুষ
এবং
একজন অন্ধ অচেতন ক্রীতদাস
একটি সাহসী সিংহ
এবং
একটি ভীরু অসহায় গাধা
আমরা যাকে
আধুনিক শিক্ষা উঁচু পেশা
অথবা সম্ভ্রান্ত জীবনযাপন বলি
তা মানুষের ভেতরের অন্তর্লীন মানুষকে
ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে
গোপনে বেড়ে ওঠে ক্রীতদাস
একমাত্র ও প্রবল
এক সময় সিংহটি হেরে যায় গাধার কাছে
অবিশ্বাস্য অদ্ভুত নিয়মে    
আমি এখন একজন
নিপুণ ক্রীতদাস উৎকৃষ্ট গাধা
সরল অর্থে সফল আমলা!

এখন আমার মাথা নেই
মেরুদণ্ড নেই
বুকে ভর করে চলা প্রাণীর মতো
দিনগত পাপক্ষয়ে টিকে আছি
মানুষের মতো বেঁচে নেই!

আমাকে দেখে এখন
পাখিরা মুখ ফেরায়
ফুল ঝরে পড়ে
নদী ভোলে উৎসমুখ
হায়রে জীবন
একটাই জীবন
তুই আমার হাতছাড়া হয়ে গেলি!

        
কেবল তোমার কারণে
 
কী আশ্চর্য!
কেবল তোমার কারণে
রুগ্ন শ্রীহীন এ শহর
মুহূর্তে তিলোত্তমা হয়ে যায়!
তোমার শহর বলে
এখানে প্রতিদিন বসন্ত-উৎসব
চারদিকে গোলাপসভা
কামিনী ফুলের গন্ধ
রবীন্দ্রনাথ নজরুলের
যুগল বন্দনায়
অনুরোধের আসর
অর্কেস্ট্রার স্পন্দনে
সম্পন্ন নাগরিক জীবন
তোমার একান্ত ইচ্ছেয়
চোখের পলকে এ শহর
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহরের
শিরোপা পায়।



অথচ কী অদ্ভুত
তোমার অনুপস্থিতি!
যে কদিন ছিলে না তুমি
সূর্যকে আড়াল করেছে মেঘ
শহরে তখন
অনবরত লোডশেডিং
জনশূন্য রাজপথ
ম্রিয়মাণ অফিসপাড়া
সংবাদপত্রে শুধুই দুঃখসংবাদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার ধর্মঘট
পুষ্পপ্রদর্শনী কবিতাপাঠ
অথবা সঙ্গীতসন্ধ্যা
সহসা থেমে গিয়েছিল
নান্দনিক সুখের জন্য
একজনও প্রিয়দর্শিনী
তখন শহরে ছিল না
আলোহীন অসংস্কৃত শহর থেকে
সাময়িকী প্রত্যাহৃত হয়েছিল
সকল বিদেশী দূত!

তোমার বিরহে
বিরস বদনে পাখিরা
শহর ছেড়ে যায়
সবুজ বৃক্ষ হারায়
পত্রপুষ্প শোভা
অভিমানে প্রজাপতি
ফুলে বসে না
তোমার শূন্যতায়
বিষণ্ন বেহালা তখন
সারা শহর!


দ্বিধা রেখে

দ্বিধা রেখেই তোমার কাছে এসেছি
এসেছি সব ছেড়ে
ঋষির অটল একাগ্রতায় একখণ্ড গৈরিক বসনে !

যদি পারো সব দ্বিধা রেখে তুমিও এসো
এসো বৃক্ষের মতো আদিম শিকড় উপড়ে ফেলে
এসো জন্ম-মৃত্যুর মতো ধ্রুব সত্য হয়ে
অতিক্রান্ত অতীতের সব স্মৃতি সব ছায়া নিশ্চিহ্ন করে
শুদ্ধতার অগ্নিস্নান শেষে এসো তুমি
এসো আমার কাছে ভালোবাসার অভিষেকে।

দ্বিধার দ্বৈরথ ছেড়ে তুমি এলে দেখো
মুহূর্তেই থেমে যাবে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ
বুকের ভেতর নামবে রিমঝিম সুখের বৃষ্টি
পোড়োবাড়ির মতো ধসে যাবে ভুলের পৃথিবী !

তুমি এলে প্রিয়তমা
তোমাকে দেবো আমার অখণ্ড আকাশ অনন্ত নীলিমা
খুব কাছে এনে দেবো দূরের নদী সুদূর সমুদ্র
নিসর্গের পদাবলি দেবো
দেবো এনে শ্রাবণের মেঘমালা অজস্র সহস্রবার
তোমাকে নিয়ে যাবো
ঝলমলে বনানী দুপুর অপরূপ বিকেলের কাছে
গোধূলির মায়াবি আলোয় তিলোত্তমা তোমাকে
দেখবো অপলক নিবিড়-নিভৃতে
দিনশেষে করতলে গুঁজে দেবো রাশি রাশি সন্ধ্যাতারা
কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবো ধ্রুপদী স্বপ্নের চন্দ্রাবলী রাত !


আমার বিশ্বাসের কথা বলছি
  
রাত্রির দীর্ঘতা যত বৈরিতা করুক
কুয়াশা দৃষ্টিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধুক
বিবরবাসীরা আলোকে বাধা দিক
মেঘ কখনই সূর্যকে
আড়াল করতে পারে না।
ইতিহাস সাক্ষী আছে
দুর্জন যতই প্রাধান্য পাক
দুর্বৃত্তের যতই ক্ষমতা থাক
হিংসা যতই গর্জে উঠুক
মানবিকতার কোনো বিকল্প নেই
শ্রেয়োবোধের কোনো বিকল্প নেই।
আপাত দিকভ্রান্ত হলেও
আমার প্রবল বিশ্বাস
সরব বন্ধ্যাত্বের চেয়ে নীরব সৃষ্টি
খরার চেয়ে বৃষ্টি
চাতুর্যের চেয়ে হৃদয়বৃত্তিই
মানুষের চিরকালের গন্তব্য।

বাংলাদেশ সময় ১৭১৫, ডিসেম্বর ২০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।