ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ৬-৮

জাকির তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১০
ধারাবাহিক উপন্যাস : পিতৃগণ, প্রথম পর্ব, অধ্যায় ৬-৮

০৬. পিতা-পুত্র

চিনতে শেখার বয়স হওয়ার পর থেকে বাবা নামের কারো সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি পপীপের। এখন হুট করে একজন লোক তাকে বলছে সে তার বাবা, আর অমনি তাকে বাবা বলে মেনে নেয়া বেশ কঠিনই মনে হয় পপীপের কাছে।

বিশ্বাস-অবিশ্বাস নয়, পপীপের সামনে এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অপরিচয়। তাছাড়া কোনোদিন যা পাওয়া হয়নি, যার অস্তিত্ব আছে কিনা সেটিও জানা নেই, জানা হয়নি, তার জন্য অভাববোধ কিংবা পাওয়ার তৃষ্ণাও তৈরি হয়নি তার জীবনে। তাদের গাঁয়ে অন্য ছেলেমেয়েরা যখন তাদের পিতার কোলে উঠে বেড়াতে যেত, কিংবা কোনো পিতাকে যখন তার সন্তানকে আদর করতে দেখত পপীপ, তখন তার নিজের বাবা কোথায় সেই প্রশ্ন অবশ্য মনে এসেছে পপীপের। কিন্তু খুব বেশিণ মনে থাকেনি। বা খুব মন খারাপ হয়নি। আসলে তার বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি তার মা। তাছাড়া নিজেদের গাঁয়ে পপীপের ছিল নিজেদের ঝুপড়ি, নিজের মা, গাঁয়ের অন্য মেয়েরা কেউ ছিল তার খুড়ি কেউ কাকি কেউ পিসি, পুরুষরা খুড়ো-জ্যাঠা-কাকা, কেউবা দাদা। সেখানে তার বাবা নামের কেউ ছিল না। অবশ্য অদেখা এক বাবার নামে মাঝে মাঝে মাকে সে দেখেছে অশ্র“বর্ষণ করতে। তবে এই মানুষটাই যে সেই বাবা, তা চিনিয়ে দেবার জন্য মা-ও তো এই মুহূর্তে উপস্থিত নেই। তাই অপরিচয়ের দ্বিধা কাটতে চায় না পপীপের মন থেকে। অবশ্য তার  সহজাত প্রবৃত্তি বলছে, লোকটি তাকে যে আদর করছে তার সবটুকুই অন্তর থেকে উঠে আসা। এবং এই আদর, লোকটির বুকের সংস্পর্শ, তার ছোট্ট জীবনের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গত কয়েকদিনের লণ্ডভণ্ড ঝড়ের ধাক্কাকে কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে পারছে, নিজেকে গত কয়েকদিনের মতো আর অতখানি অনিরাপদ মনে হচ্ছে না। তবুও তার মনটা একটুখানি থিতু হওয়ার সুযোগ পাওয়ামাত্রই মায়ের জন্য হাহাকার করে উঠছে। তাই সে লোকটির দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবার চারপাশে তাকায় এবং অকস্মাৎ-ই ফুঁপিয়ে ওঠে মা বলে।
    তার কান্নার প্রতিক্রিয়ায় মানুষটির সজল চোখ আবারও জলে উপচে পড়ে। লোকটার বুকেও বোধহয় অনেক কান্নাই জমে আছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি সজল হয়ে উঠতে পারে না কারো চোখ। সে আবার বুকে টেনে নেয় পপীপকে। নিজের পিঠে রু, ছিন্নভিন্ন, কড়াপড়া, ফাটাফাটা হাতের স্পর্শ পায় পপীপ। অমসৃণ হাতের তালুর স্পর্শও এত আদরময় হতে পারে! পপীপের মন থেকে অপরিচয়ের সব দ্বিধা, সব দোদুল্যমানতা উবে যেতে চায় এই আদরের স্পর্শে। কিন্তু মায়ের জন্য হাহাকার তার ফুরায় নাÑ মায়ের কাছে যাব!
লোকটি, বট্যপ, দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে উদ্গত অশ্র“ আর অন্তরের অনিরুদ্ধ বেদনার আবেগ সামলানোর চেষ্টা করে প্রাণপণে। ভাঙাস্বরে বলেÑ যাবি রে সোনা! মায়ের কাছে যাবি তো বটি। এই তো আর কয়টাদিন। প্রভুর দ্রম্ম কয়টার প্রায়চ্চিত্তি করতে পারলেই তুই আর আমি চলে যাব। চলে যাব আমাদের বরিন্দের সেই কৈবর্তগাঁয়ে। তোর মায়ের কাছে। আমার ভাইদের কাছে। আমাদের লিজেদের মানুষদের কাছে।
    কিছুণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করেÑ মা তোরে খুব ভালোবাসে, লয়?
    মাথা ঝাঁকায় পপীপ।
    তা তো বাসবেই। মায়ের কত কষ্টের নাড়িছেঁড়া ধন যে তুই!
    আবার জিজ্ঞাসাÑ তোর মন মায়ের তরে খুব টানে, লয়?
    পপীপ নির্দ্বিধ মাথা ঝাঁকায়।
    তোরা... তুই আর তোর মা রোজ কী খেতিস রে পপীপ?
    এটা কোনো প্রশ্ন হলো! পান্তা, সোরা, খরগোসের মাংস, কুলবড়ই, আম আরও কত কী!
    রোজ রোজ খেতে পাস রে তোরা?
    এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধায় পড়ে পপীপ। রোজ কি তারা খেতে পায়? তার জন্য কিছু না কিছু তো মা রোজই যোগাড় করে আনে যেভাবে পারে। কিন্তু মা রোজ খেয়েছে কিনা সেটা তো কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। আসলে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন আছে কি না সেটাও কখনো ভাবা হয়নি।
    মোদের গাঁয়ের আর সবাই কেমন আছে রে পপীপ?
    আর সবাই মানে?
    ঐ যে পরভু, দয়াল, পিতু, তোর খুড়িমা... সবাই ভালো আছে রে?
    পিতু জ্যাঠা মরে গেছে।
    নিজের বড় ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ এতদিন পরে এই প্রথম শুনতে পায় বট্যপ। বড় দাদার সঙ্গে তার যে খুব কথা চালাচালি হতো তা নয়। এমনকি কামরূপে চলে আসতে বাধ্য হবার পর থেকে দাদার কথা খুব যে একটা মনে পড়ত, তা বলা যাবে না। তার বুক জুড়ে ছিল স্ত্রী বিবানি আর একদিনের সন্তান পপীপ। কিন্তু এখন দাদার মৃত্যুসংবাদ শুনে তার বুকটা খুব খালি খালি ঠেকে, মোচড় দিয়ে ওঠে। গলার স্বর আবারও ভেঙে আসতে চায় কান্নার চাপে। মানুষের মনের মধ্যে কোন গোপন খুপড়িতে কে যে কোন জায়গা জুড়ে বসে থাকে!
    তখন দ্রগড়(ঘণ্টা) বাজে।
    চমকে উঠে বট্যপের বুকে সেঁটে আসে পপীপÑ উটি কীসের শব্দ বটি?
    খেতে যাওয়ার জন্যে মোদের ঐ ঘন্টি বাজিয়ে ডাকছে। খেতে যাওয়ার সময় হয়েছে রে বাপ। চল আমরা খেতে যাই।
    এরা এমনি এমনি মোদের খেতে দিবে?
    তিক্ত হাসি ফোটে বট্যপের মুখে। কিন্তু কোনো কথা বলে না উত্তরে। বরং আবার তাড়া দেয়Ñ দেরি হয়ে যাচ্ছে রে বাপ। চল, খেতে চল! খেয়ে এসে আবার ঘুম যাবি।
    তাদের মতো সারি সারি ঝুপড়ি থেকে বেড়িয়ে আসছে মানুষ। পপীপ প্রত্যুষের আলোতে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। ভেতর থেকে ঝুপড়িগুলিকে তাদের কৈবর্তগ্রামের ঝুপড়ির মতো মনে হলেও আদতে সেরকম নয়। আকারে মিল রয়েছে ঠিকই। তবে তাদের গাঁয়ের মতো সেগুলি শুধু পাতা বা খড়ে ছাওয়া নয়। ওহালি(বাঁশের বাতা) দিয়ে তৈরি চালা এবং দেওয়াল। চালা আর দেওয়ালের  ওপর পুরু করে লেপে দেওয়া মাটি। ফলে ঝড়ির(বর্ষা) সময় চালা ফেঁড়ে বৃষ্টির জল ঢুকতে পারে না ঝুপড়িতে। বাঁশ আর মাটি মিলিয়ে বানানো দেওয়াল খুবই শক্ত। এই রকম দেওয়াল থাকলে যখন-তখন বনের জন্তু-জানোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে না। তাছাড়া, বট্যপ জানায়, মাটির পুরু আস্তর দেওয়া থাকায় গরমকালে কম গরম, আর শীতকালে কম ঠাণ্ডা লাগে ঘরগুলিতে। আমরা বরেন্দিতে যখন ফিরে যাব, ঠিক এই রকম করে মোদের ঘর বানিয়ে নিব রে বেটা। তাহলে আমরা বাপ-বেটা-মায়ে মিলে থাকতে পারব সুখে। গরমের কালেও, শীতের কালেও, আবার ঝড়ির কালেও।
    যে ঘরে তাদের খেতে দেওয়া হলো, সেটি লম্বায় অনেক বড়। ওপরে শুধু চালা। চারপাশে কোনো দেওয়াল নেই। তকতকে লেপা মেঝে। বট্যপ জানায়, দিনে অন্তত দুইবার এই মেঝে লেপা-পোঁছার কাজ করে গোলগোমীরা(ঘর পরিষ্কার করার দাসী)।
    সেই মেঝেতে দুই সারিতে খেতে বসে ভূমিদাসরা। মাটির মালসায় প্রথমে আসে সূক্ত(ছাতু)। সঙ্গে লবণ মেশানো জল। সেগুলো খাওয়া শেষ হলে আসে ফেনাভাত, নলতে শাক, কচু, অলাবুর তরকারি। মাছ-মাংস এখানে অচল। রামশর্মা নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ। তার ভূস্বামীত্বে মাছ-মাংস ঢুকবে না। খাওয়ার পরে জলের ঘটি নিয়ে যেতে হয় ইন্দারায়। বড় বালতি থেকে একজন জল ঢেলে দেয় প্রত্যেকের ঘটিতে। প্রথমে সেই জল খেয়ে তেষ্টা মেটানো। তারপর বাকি জল দিয়ে মালসা পরিষ্কার করে রেখে আসতে হবে খাবার-চালার নির্দিষ্ট জায়গায়। আগে এই অস্পৃশ্য ভূমিদাসদের নিয়ে শাস্ত্রীয় সমস্যায় পড়তে হয়েছিল রামশর্মাকে। সেই পতঞ্জলি-মনুর সময় থেকে চলে আসছে তিন ধরনের শূদ্র-বিচার। এক রকম হচ্ছে ‘যজ্ঞাদনিরবসিতানাম’। যজ্ঞস্থান থেকে বিতাড়িত নয় যারা। এরা যজ্ঞের বিভিন্ন ধরনের কাজে যোগালির কাজ করতে পারে। যেমন ত(ছুতার), অয়স্কার(কামার), রজক, তন্তুবায়। এরা সৎশূদ্র। অর্থাৎ জল-চল। জল-অচলদের শূদ্রদের মধ্যে আছে দুই রকম। ‘পাত্রদনিরবসিতানাম’। এরা আর্যদের বাসন-কোসন ব্যবহার করতে পারে। ব্যবহারের পরে পাত্র ফেলে দিতে হয় না। অন্ত্যজ তৃতীয় শ্রেণীর শূদ্র হচ্ছে ‘নিরবসিত’। এরা একবারেই নিম্নস্তরের। এরা কোনো বাসনপত্র ব্যবহার করলে সেই বাসনপত্র আর শুদ্ধ করে নেওয়া যায় না। ফেলে দিতে হয় দূরে, যাতে সেগুলো ব্রাক্ষ্মণের স্পর্শদোষ ঘটাতে না পারে।
    কৈবর্তরা তো আর্যদের দৃষ্টিতে শুধুমাত্র শূদ্রই নয়, তারা রাস অনাস বয়াংসি। এদেরকে যে কোন স্তরে ফেলা হবে তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে।   তবে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক চিন্তাটিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। রোজ রোজ এদেরকে নতুন পাত্র দিলে ব্যাপক ব্যয় হয়ে যায়। এমনকি এটিকে অপব্যয়ও বলা চলে। শেষ পর্যন্ত অনেক পুঁজি-পাতি ঘেঁটে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এদের এঁটোপাত্র ফেলে দেওয়া হবে না। ভালো করে ধুয়ে গঙ্গাজলের ছিটে দিলে পুনঃব্যবহারযোগ্য হবে।   তবে তা শুধু ব্রাক্ষ্মণেতর শ্রেণীর মানুষের জন্য। কোনো ব্রাক্ষ্মণ বা উচ্চবংশের মানুষ এই সব পাত্র ব্যবহার করতে পারবে না।
    তখন থেকে এই নিয়ম চলছে।
    খাওয়া এবং জলপানের পরে আবার দ্রগড় বাজে।
    এবার কাজে যেতে হবে।
    বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে পপীপের দিকে তাকিয়ে থাকে বট্যপ। ছেলেকে নিয়ে কী করতে হবে সেরকম কোনো নির্দেশ এখনো এসে পৌঁছায়নি তার কাছে। সে তাই বলেÑ তুই ঘরেই থাক রে বাপ। একটু পরেই রোদের বড় ঝাঁঝ বেড়ে যাবে। তখন বাইরে থাকলে তোর কষ্ট হবে। বাইরে যাস না। এই ঘটি নে। জল ভরে দিচ্ছি। ঘরে রেখে দে। তেষ্টা পেলে জল খাবি।
    আর খিদে পেলে?
    এই প্রশ্নে আরো বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অসহায় পিতা। এখানে সূর্যাস্তের আগে আর খাদ্যবস্তু জোটার কোনো উপায় আছে কিনা এত বছরেও তা জানা হয়নি তার। তাদের তো দিনে দুইবারই শুধু খেতে দেওয়া হয়। একবার সকালে কাজে যাবার পূর্বে, আর একবার সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পরে। কিন্তু কচিপেটের শিশু। তার তো ঘন ঘন খিদে পাওয়ারই কথা। তখন কী হবে! ভাবতে গিয়ে ঘেমে ওঠে বট্যপ। সন্তান তার খিদের জ্বালায় কাঁদছে, এমন দৃশ্য মনের মধ্যে ভেসে ওঠায় বুক মুচড়ে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায় আবারও।
    তুমি কখন ঘরে ফিরবে?
    ছেলের প্রশ্নের উত্তরে সূর্যের দিকে ইঙ্গিত করে পপীপÑ ওটা ঘুরে গেলে।
    তাহলে আমার যে খিদা লাগবে!
    খিদা লাগলে... খিদা লাগলে ঐ জলটাই খাবি বাপ! বেশি বেশি করে খাবি। তাহলে দেখবি খিদা মরে গেছে।
শব্দ কয়টি ছেলেকে ল করে ছুঁড়ে দেয় বটে পিতা, কিন্তু মনে হয় শব্দের ধাক্কায় সে নিজেই পেছন ফিরে ছুটতে শুরু করেছে।
 
আজ বট্যপকে কাজ করতে হবে আখের জমিতে। এখানে আখের চাষ খুবই লাভজনক। আখের রস থেকেই গুড়। গুড় ছাড়া তো কোনো মিষ্টান্ন কল্পনাই করা যায় না। আবার মিষ্টান্নকে বাদ দিলে হিন্দুদের কোনো পূজারই কল্পনা করা যায় না। কেননা মিষ্টান্ন ছাড়া দেবতার ভোগ হয় না। তাই বাজারে তোলামাত্র বিক্রি হয়ে যায় গুড়ের পাটালিগুলো। ঝোলাগুড় চোলাই করে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট আসব। সোমরস। সোমরস ছাড়া আর্য হিন্দুদের কোনো বিনোদন হয় না। কোনো যজ্ঞও হয় না। তাই রামশর্মা আখের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বুঝে তার নালভূমির এক বিরাট অংশে গড়ে তুলেছেন আখের তে। সারা কামরূপ রাজ্যে তার চেয়ে বড় আখের চাষভূমি আর কারো নেই। এই আখ-সাম্রাজ্য নিয়ে রামশর্মা ও তার পরিজনরা তো গর্ব করেই, কখনো কখনো গর্ব করে ভূমিদাসরাও। তাদের খেতের আখের গুড়ের পাটালি ও ঝোলাগুড়ের সুনাম সর্বত্র। এই গুড় কামরূপের সর্বত্র নিয়ে যায় সার্থবাহরা। আবার অন্য রাজ্যেও ভীষণ চাহিদা তাদের এই গুড়ের। এই রাজ্যের নদীগুলি সদানীরা (সারা বছর জল থাকে এমন নদী)। তাই নৌযান চলে সারাবছর। নৌযানগুলি নদীর জলে ভেসে ভেসে দূরের-দূরের দেশে বয়ে নিয়ে যায় কৈবর্তভূমিদাসদের রক্ত-ঘামে ফলানো রামশর্মার েেতর আখের গুড় ও ঝোলাগুড়। কামরূপের ঝোলাগুড় আর সুগন্ধি করঞ্জের তেল নিতে পৃথিবীর অন্য পার  থেকে আরব থেকে চীন থেকে সার্থবাহরা আসে সাগর পাড়ি দিয়ে।
আজ বট্যপের হাত চলে খুব দ্রুত। এমনিতেই কৈবর্তরা কাজে ফাঁকি দিতে জানে না। চাষের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে তাদের নাড়ির সম্পর্ক। চাষের কাজ পেলে, মাটি ও শস্য সম্ভাবনার কোনো চিহ্ন দেখতে পেলেই তারা তার সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে। যে জমিতে কাজ করছে, সেটি নিজের জমি না অন্যের জমি তা নিয়ে মাথা ঘামানোর বিন্দুমাত্র অবসর তাদের থাকে না। তারা তখন পৃথিবী ও মৃত্তিকার উপাসনায় মগ্ন। মৃত্তিকার সাথে তাদের এই অদ্ভুত একাত্মতা দেখে আর্য পণ্ডিতরা পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যায়। তারা বলে, এসব অসুর জাতির মৃত্তিকাপ্রেম তাদের জাতির উৎপত্তির সাথে সংশিষ্ট। তারা বলে, বরাহরূপী বিষ্ণুর ঔরসে পৃথিবীর গর্ভে নরক-অসুর জন্ম নিয়ে অঙ্গ-বঙ্গ-পুণ্ড্র-গৌড় অঞ্চলে ভৌম বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর্যাবর্তের সব বিখ্যাত আর্যবংশ সবই সুর্য ও চন্দ্র, অর্থাৎ জ্যোতির্ময় দেবাংশ থেকে উৎপন্ন। কিন্তু এইসব অঞ্চলের অনার্যদের উৎপত্তি আকাশের জ্যোতিষ্কে নয়, মাটির গর্ভে Ñ নরকাসুরের বীর্যে।
বট্যপের রক্তে-মাংসে-হৃদয়ে-কল্পনায় সেই একই মৃত্তিকাপ্রেম। তাই নালেেত্র সে মনপ্রাণ ঢেলেই কাজ করে সবসময়। কিন্তু আজ তার কাজের গতি আরো বেড়ে যায়। সাত বছরের নিঃসঙ্গতার পরে তার আত্মজ আজ তার বুকের পাশে। সেই সন্তানের মঙ্গল কামনায় সে যেন আজ মৃত্তিকাকে উৎসর্গ করতে থাকে আরো বেশি দেহজ ও মনজ শ্রম।
দ্বিপ্রহরে পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। রোজই এটা ঘটে। শরীর এখন কিছু খাদ্য চায়। কিন্তু বট্যপ জানে একটু পরেই ধীরে ধীরে পেটের এই মোচড় দিয়ে ওঠা কমে যাবে। থাকবে শুধু একটু ভোঁতা চিনচিনে ব্যথা। একটু পর পর সেই ব্যথা ঝিলিক দিয়ে তীব্র হয়ে উঠে তাকে মনে করিয়ে দেবে তার পেট এখন খাদ্য চায়। তবে এই দাবি অস্বীকার করে দিন কাটিয়ে দেবার অভ্যাস তৈরি হয়েছে বট্যপের। নির্বিকারে এটিকে সঙ্গী করেই দিন কাটিয়ে দিতে পারে। প্রকৃতপে কিছুণ পরেই তার মন থেকে মুছে যাবে এই চিনচিনে ব্যথার ভিন্ন তাৎপর্য। তার মনে হতে থাকবে এটি তার নৈমিত্তিক সঙ্গী। কিন্তু আজ আর কিছুতেই মন থেকে ব্যথাটিকে তাড়াতে পারে না বট্যপ। তার মনে পড়ে, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে শিশু পপীপেরও। ঝুপড়ির মধ্যে খিদের যন্ত্রণা নিয়ে পেট চেপে বসে আছে অসহায় একটি শিশু, দৃশ্যটি মনের পর্দায় ভেসে উঠতেই হাহাকারে ভরে ওঠে বট্যপের বুক। থেমে যায় তার হাতের খনিত্র। পাশে কাজ করছিল ভিগু। সে ল করে বট্যপের ভাবান্তর। জিজ্ঞেস করেÑ কী হলোরে বট্যপ?
ছেলেটা!
কী হয়েছে ছেলেটার? সকালে তো ভালোই দেখে এলাম তোদের বাপ-বেটাকে।
ছেলেটা খিদায় কষ্ট পাচ্ছে ভিগু!
তাইতো! ভিগুরও যেন খেয়াল হয় ব্যাপারটা।
তা কী করবি বটি এখন?
কী করব ভিগু?
এদিক-ওদিক তাকায় ভিগু। আখেেতর পরে পুকুর। তার ওপারে বাঁশবন। সেদিকে ইশারা করে ভিগুÑ ঐদিগে যা। বাঁশঝাড়ে কোণ্ডক(বাঁশের কোঁড়) পাবি। না পেলে পুকুরের জল থেকে সলুপ্য(শালুক) তুলে ছেলেটাকে দিয়ে আয়।
ইতস্তত করে বট্যপÑ কিন্তু প্রভুর অনুমতি...
ভিগু তাচ্ছিল্যে হাত নাড়েÑ ও জন্য অনুমতি লাগবে কেনে? ওসব তো এখেনে পড়েই থাকে। কেউ খায় না। যা দিয়ে আয়। ছেলেটা টুকুন খেয়ে পেটের আগুন নিভাক।
কিন্তু কাজ ছেড়ে যাব!
এইটুকুন সময়ে আর কী মহাতি হবে! ঝমঝম যাবি আর আসবি। ফিরে এসে দুইদণ্ড জোরে হাত চালালেই হয়ে যাবে।

শালুক এবং বাঁশের কচি কোঁড়Ñ দুটোই তুলে আনে বট্যপ। অনেকগুলিই আনে। সে জানে ভারি খুশি হবে ছেলেটা এগুলো পেলে। সে নিজেও শিশুবয়সে এসব পেলে পান্তাভাতও খেতে চাইত না।
ঝুপড়ির দরজায় এসে ডাকেÑ পপীপ!
কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।
ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি ছেলেটা?
বট্যপ এবার ঝাঁপ ঠেলে ভেতরে ঢোকে। বাইরের ঝাঁ ঝাঁ রোদের আলো থেকে ঝুপড়িতে ঢুকলে প্রথমে কিছুণ থাকে শুধু সোঁদা অন্ধকার। সেই অন্ধকার চোখে সয়ে এলে বট্যপ হড়াশ্ শব্দ করা বুক আর হতাশ্বাসভরা চোখ নিয়ে দেখে ঘরে কেউ নেই!
ছেলেটা গেল কোথায়?
বাইরে আসে বট্যপ। তাকায় এদিক-ওদিক।
কোথাও ছায়ামাত্র দেখা যায় না শিশুর। সে তখন গলা চড়িয়ে ডাকেÑ পপীপ! পপীপরে! বাপ পপীপ!
প্রতি ডাকে গলা চড়তে থাকে।
কিন্তু কোনো প্রতিধ্বনি ওঠে না। দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ যেন বট্যপের কণ্ঠ চিরে বেরুনো শব্দগুলোকে নিজের ঝাঁঝালো উদরে মুহূর্তেই শুষে নিচ্ছে।
ডাকতে ডাকতে বট্যপের শুকনো গলা যখন প্রায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম, তখন তাদের খাবার ঘরের মেঝে লেপছিল যে গোলগোমী, সে বেরিয়ে আসেÑ এত চ্যাঁচাও কেনে? কারে ডাকো?
আমার ছেলেটা। পপীপ!
ও, ঐ যে ছেলেটা যে কাল রাতে এখানে এসেছে!
হ্যাঁ গো।
তাকে তো কাজে পাঠানো হয়েছে। ঐ উত্তরের সব্জি খেতে।
ক্বে... কে পাঠিয়েছে বটি?
কে আবার! প্রভু। তা মনে হলো বাজ পড়েছে তোমার মাথায় কথাটা শুনে! তাকে কি এখানে এম্নি এম্নি আনিয়েছে প্রভু? কাজ করার জন্যে লয়? কাজ করার জন্যেই তো বটি। আর কাজ না করলে তোমার ঋণটা শোধ কীভাবে হবে বলো দিকিনি?
মাথায় বাজ-পড়া খাড়া শবদেহের মতোই একহাতে শালুক, অন্যহাতে কচি বাঁশের কোঁড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নির্মম সত্যাহত বট্যপ।

০৭. নাটক এবং নাটকের মধ্যে নাটক
“হে সোম তুমি মত্ততার উৎপাদনকারী দীপ্তিমান কর্মপটু, তুমি যারপর নাই মধুপূর্ণ হয়ে ইন্দ্রের জন্য রিত হও! বৃষ্টি বর্ষণকারী ইন্দ্র তোমাকে পান করে বৃষের ন্যায় বলবান হন। তোমাকে পান করে ইন্দ্রের বুদ্ধি সুন্দর রূপে স্ফুর্তিযুক্ত হয়, যেরূপ ঘোটক যুদ্ধে যায় তিনি সেরূপ শত্র“র আহার্যসামগ্রী লুণ্ঠন করতে যান। হে সোম, তোমার ন্যায় উজ্জ্বল আর কিছু নাই! তুমি যখন রিত হও তখন দেববংশজাত সকল ব্যক্তিকে অমরত্বের দিকে আহ্বান জানাতে থাকো। ”
    মঞ্চের ঠিক মাঝখানে বিশাল এক সিংহাসনে বসে আছে বিশালদেহী একটা লোক। তার মুখমণ্ডল, গলা, বাহু,  শালের মতো প্রশস্ত নগ্নব, আর বিশাল জয়ঢাকের মতো উদর সোনালি রঙে রঞ্জিত। তার মাথার চুল কাঁধ ছাপিয়ে নামায় সেটাকে দেখাচ্ছে সিংহের কেশরের মতো। তার শ্মশ্রƒ নেমে এসেছে নাভিমূল পর্যন্ত। সে দুই হাতে বিশাল স্বর্ণপাত্র ধরে রেখেছে। তা থেকে মুখে ঢালছে সোমরস। সোমপানের সময় আন্দোলিত হচ্ছে তার কেশ ও শ্মশ্রƒ। ইন্দ্রবেশী এই মানুষটিকে ল করেই স্তোত্রপাঠ হচ্ছে নেপথ্য থেকে।
    এরপর মঞ্চে এল দুই অপ্সরা। তারা এতই স্বল্পবসনা এবং স্বচ্ছবসনা যে তাদের দেহলাবণ্য মঞ্চারূঢ় ইন্দ্র তো বটেই, দর্শকসারির শেষ ব্যক্তিটির কাছেও সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত। দুই অপ্সরা এসে করজোড়ে শুরু করল ইন্দ্রের ন্তবÑ হে হিরন্ময় হিরণ্যবাহু ইন্দ্র! তোমার স্বর্ণনির্মিত রথ ভেদ করতে পারে স্বর্গ-নরক-পাতাল, বজ্র তোমার অস্ত্র, ঝড়-বৃষ্টি-প্লাবন সংঘটিত হয় তোমার ইচ্ছায়, তুমি শম্বর দৈত্যের উনশতটি পুরি ধ্বংস করেছ, তাই তোমার বিরুদ(উপাধি) ‘পুরন্দর’, আজ তোমারই জন্য আহুত হয়েছে এই ভোজসভা। স্বয়ং বিষ্ণু তোমার পাচক, তোমার জন্য রন্ধন করা হয়েছে একশত মহিষ, তৈরি করা হয়েছে এক সহস্র পুরোডাস(ছাগলের মাংসের তৈরি পিঠা), সোমরসে পূর্ণ করা হয়েছে তিনটি নদী। তুমি আমাদের আহুতি গ্রহণ করো!
    ইন্দ্ররূপী বিশাল পুরুষ হুংকার ছাড়েÑ তোমাদের মুখ থেকে বচন নয়, সঙ্গীত চাই! তোমাদের অঙ্গ থেকে চৈত্রের ঘূর্ণিতে কেঁপে ওঠা সদানীরা নদীর উত্তাল হিল্লোল চাই!
    সঙ্গে সঙ্গে দুই অপ্সরা শুরু করল সঙ্গীত এবং নৃত্য। সঙ্গীতের বাক্যগুলি যেন কামকলার শব্দানুবাদ, আর নৃত্য যেন বাৎসায়নের রতিআসনের পুঙ্খানুপুঙ্খ শারীরিক অনুবাদ।

    ভট্টবামনের নাটমণ্ডপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ইন্দ্রপ্রশস্তি’ নাটক। নগরীর অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষই কেবলমাত্র সেখানে দর্শক হবার সৌভাগ্য লাভ করে। তারা সবাই নাটকের সাথে একাত্ম। নর্তকী অপ্সরা তিনজন তুমুল সঙ্গমভঙ্গিমায় দেহে হিল্লোল তোলামাত্র অস্ফুট কামার্ত ধ্বনি বেরিয়ে আসছে দর্শকদের মুখ চিরে। দর্শক আসনে বিপদাপন্ন চেহারা নিয়ে পাংশু মুখে বসে আছেন হরিভদ্র, উপগুপ্ত, প্রিয়রতি, সুভদ্র, বিনয়পালিত। এই অশ্লীল গর্ভস্রাব চাুষ করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। সেই বেদনায় প্রত্যেকেই লজ্জা এবং আত্মধিক্কারে মুহ্যমান। এই নাটকের দৃশ্য দেখে তাদের শরীর রি রি করছে। ইচ্ছা হচ্ছে এখনই সরোবরে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীর এবং মন থেকে এই পঙ্কিলতা ঘষে ঘষে তুলে ফেলে। অন্তত এই মুহূর্তেই এই নাটমণ্ডপ ত্যাগ করতে পারলেও কথঞ্চিৎ শান্তি হয়তো পাওয়া যেত। কিন্তু তাদের ওঠার উপায় নেই। তাই স্থানুর মতোই বসে থাকতে হয়। এখান থেকে উঠে গেলে সেটাকে ভট্টবামন তার ব্যক্তিগত অপমান হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন। তাহলেই সর্বনাশ!
মহারাজের সাাতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে আবেদনপত্র পাঠানোর তিনদিনের মধ্যেই পাঁচ বৌদ্ধ-আচার্যকে অবাক করে ভট্টবামন জানালেন যে তিনি নিজেই এই সাাতের আয়োজন করে দিতে চান।
কবে?
যেদিন আচার্যরা চাইবেন।
আজকে সেই দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। মহারাজ আচার্যদের সঙ্গে দেখা করবেন আজ রাতে। তাদের সাথে তিনি নৈশভোজেও মিলিত হতে চান। তাই ততণে তাদের আপ্যায়ন করতে চান ভট্টবামন নিজে। তাদের সম্মানেই ভট্টবামনের নাটমণ্ডপে আয়োজন করা হয়েছে এই নাট্য প্রদর্শনীর।
ভট্টবামনের কাছ থেকে এমন ইতিবাচক এবং আন্তরিক অভ্যর্থনা পেয়ে প্রায় হতভম্ব হবার দশা তাদের প্রত্যেকেরই। হরিভদ্র, উপগুপ্ত, প্রিয়রতি,সুভদ্র, বিনয়পালিতÑ প্রত্যেকেই গত কয়েকটি রাত্রি কাটিয়েছেন বিনিদ্র। তাঁরা কথোপকথনের নামে বির্তকের ছক কেটেছেন; যাতে ভট্টবামন কোনোক্রমেই মহারাজাধিরাজ মহীপালের সঙ্গে তাদের একান্ত সাাতের পথ রুদ্ধ করতে না পারেন। কিন্তু তারা পাঁচজন মহামাত্যের কার্যালয়ে প্রবেশ করামাত্র জানতে পারলেন যে ভট্টবামন তাদের সঙ্গে মহারাজের সাাতের সুচারু ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
পাঁচ বিহারের অধ্য একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। ভট্টবামন খেয়ালই করেন না যেন  তাদের দ্বিধা। নাটক শেষ হওয়ার পরে তিনি জানান, মহারাজ একান্তেই যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে কথা বলবেন বৌদ্ধ ধর্মনেতাদের সঙ্গে। ততণ তিনি নিজে সম্মানীত অতিথিদের আপ্যায়ন করে ধন্য হতে চান।
তা আপনারা ঠিক কোন বিষয়ে আলোচনা করতে চান মহারাজের সঙ্গে?
প্রিয়রতি কিছুটা স্খলিত বিহ্বল স্বরে উত্তর দেনÑ আমাদের আলোচনা আর কী নিয়ে হবে মহামাত্য! ধর্ম-কর্ম ছাড়া আমাদের জীবনের পরিধিতে আর কিছুই নেই। তাই আমাদের আলোচনাও এই ধর্ম-কর্ম সম্পর্কেই আর কী।
সে তো বটেই। সে তো বটেই। আপনারা মহাত্মা বুদ্ধের পায়ে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন সম্পূর্ণরূপে। ধর্ম তো আপনাদের ধ্যান-জ্ঞান হবেই। আমারও ইচ্ছে করে নিজেকে ধর্মকাজে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাখতে। কিন্তুÑ বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ভট্টবামনÑ জাগতিক যে গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে অর্পিত, তা পালনের জন্য অষ্টপ্রহর নিয়োজিত রাখতে হয় নিজের শ্রম-মেধাসহ সবকিছু। শুধু যখন আপনাদের মতো ধর্মাত্মাদের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য লাভ করি কিছুণের জন্য, কেবলমাত্র তখনই আমি পাই চিত্তের প্রশান্তি,  আত্মার বিশ্রাম। তাই আমি মনে মনে সবসময় লালায়িত হয়ে থাকি আপনাদের মতো মহাত্মাদের সঙ্গ পাওয়ার জন্য।
সৌজন্যতার পরাকাষ্টা দেখে পাঁচ অধ্য একটু বিহ্বলই হয়ে পড়েন। এতটা বিনয়ের পরিপ্রেেিত ঠিক কোন উত্তর দেওয়া উচিত, তা ভেবে বের করতে সময় লাগে।
কিন্তু তারা কথা বলার আগেই আবার নিজের কথার খেই ধরেন ভট্টবামনÑ এই অরাজক দেশে, ইতর প্রাণীদের মতো অসুর-অনাস-ম্লেচ্ছভূমিতে দেবচিন্তা বয়ে এনেছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম। প্রকৃতপে মহান এই দুই ধর্মে কোনো বিভেদ তো নেই। দুই ধর্ম যেন বিশ্বপিতার ঔরসে জন্ম নেওয়া দুই সহোদর। আর এখনতো দুই ধর্ম দিনে দিনে প্রায় এক হয়ে এসেছে। চান্দ্রব্যাকরণের বৃত্তিকার ধর্মদাস কী সুন্দর লিখেছেন Ñ
রুদ্রো বিশ্বেশ্বরো দেবো যুষ্মাকং কুলদেবতা।
মারজিদ্ ভগবান্ বুদ্ধঃ অস্মাকং কুলনন্দনঃ। ।
(রূদ্র বিশ্বেশ্বর দেব তোমাদের বংশের ঠাকুর। মার-জয়কারী ভগবান বুদ্ধ আমাদের বংশের আনন্দবর্ধন। )
সিংহলের রাজা পরাক্রমবাহু যাকে ‘বৌদ্ধাগমচক্রবর্তী’ উপাধি দিয়েছেন, সেই রামচন্দ্র কবিভারতী লিখেছেনÑ
জ্ঞানং যস্য সমস্তবস্তুবিষয়ং যস্যানবদং বচো
যম্মিন রাগলবোহপি নৈবন পুনর্দ্বেষো ন মোহস্তথা।
যস্যাহেতুর নন্তসত্ত্বসুখদানল্পা কৃপামাধুরী
বুদ্ধো বা গিরিশোহথবা স ভগবংস্তস্মৈ নমস্কুর্মহে। ।
(জ্ঞান যাঁর সমস্ত বস্তু ও বিষয় ব্যাপী, বাক্য যাঁর নির্মল, চিত্তে যাঁর আসক্তির কণামাত্র নেই এবং দ্বেষ ও মোহও নেই, যাঁর হেতু অজস্র কৃপামাধুরী অনন্ত সুখ দান করছেÑ তাঁকে বুদ্ধই বলি অথবা গিরিশই বলিÑ সেই ভগবানকে আমরা নমস্কার করি। )

থরে থরে খাদ্যবস্তু নিয়ে আসে গৃহভৃত্যেরা। চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়।
পাঁচ আচার্য একটু জড়োসড়ো হনÑ মহারাজের সঙ্গে যদি নৈশভোজে যোগ দিতে হয় তাহলে এমন অসময়ে খাদ্যগ্রহণ...
ভট্টবামন জোড়করে দাঁড়ানÑ একটু সেবা করুন! নয়তো গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। তাছাড়া মহারাজের নৈশভোজে অনেক বিলম্ব ঘটে। প্রায়শই তিনি রাজকার্যে ব্যস্ত থাকার দরুণ নৈশভোজে বিলম্ব করে থাকেন। ততণে এইটুকু খাদ্যবস্তু আপনাদের পাকস্থলি জীর্ণ করে ফেলবে।
ভৃত্যদের পরিবেশনের ইঙ্গিত করলেন তিনি।
খাওয়া শেষে পালা আসে বহুমূল্য পরসুক পান করার (বন্য দ্রাার রস)। স্বচ্ছ স্ফটিকসুলভ কাচপাত্রে এই পানীয় স্বর্গীয় বর্ণ ধারণ করে। পাঁচ আচার্য জানেন না এই পানীয়ের নাম। কিন্তু তারা কেউই দৃষ্টি ফেরাতে পারছেন না পানপাত্রের দিক থেকে। তাদের আপ্লুত বিহ্বল মুখাবয়ব দেখে মনে মনে হাসলেন ভট্টবামন। বললেনÑ এই পানীয় এসেছে বহু সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রোম নামক ম্লেচ্ছদের দেশ থেকে। এর নামই পরসুক।
নাম শুনেই চমকে উঠলেন পাঁচ আচার্য। এই সেই পরসুক! ভূ-পর্যটক শ্রমণদের কাছে তারা শুনেছেন, পৃথিবীতে পরসুকের চাইতে উন্নত কোনো পানীয় নেই। স্বচ্ছতম ঝরনার জল, বিশুদ্ধতম সৈন্ধব লবণ, আম্রপালির বনের মধু, কামধেনুর প্রথম প্রত্যুষের দুগ্ধ, পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম দ্রাারসের পাতনের সংমিশ্রণে যে পানীয় প্রস্তুত হয়, তার নাম পরসুক। এই নির্দোষ কিন্তু মহামূল্য পানীয়ের কথা চিরকাল শুনেই এসেছেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। আজ পান করার সুযোগ পেয়ে তারা সারাজীবনের একটি বিরাট অতৃপ্তি প্রশমিত করার অনুভূতি লাভ করলেন।
এবার ভট্টবামন নিজে তাদের সঙ্গে নিয়ে চললেন মহারাজের প্রাসাদে। যাপ্যযানে (পালকি) চড়ে তারা রওনা দিলেন প্রাসাদের দিকে।

সেখানেও তারা চমকের পরে চমকে চমকিত। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে স্বয়ং মহারাজ এসেছেন প্রাসাদের সিংহদরজায়! মুহূর্তে বিগলিত হয়ে গেল পাঁচ অধ্যরে বিুব্ধ হৃদয়।
মন্ত্রণাকে নয়, একেবারে মহারাজের নিজস্ব বিশ্রামকে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের।
আশীর্বচন, কুশলাদি বিনিময়ের পরে কাজের কথা ।
আবেদন জানানোমাত্র একযোগে সম্মতি দিলেন মহারাজ এবং মহামাত্য। এতদিন বিভিন্ন ব্যস্ততায় বিহারের দিকে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন মহারাজ। এসব ব্যাপার তাঁকে মনে করিয়ে দেবার কিছুটা দায়িত্ব বর্তায় অবশ্যই মহামাত্যের কাঁধে। তিনি সেই দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিতে পারেননি তাই নিজেও লজ্জিত বলে জানালেন ভট্টবামন। কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তি। এখন কী করা যায়। তাৎণিকভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা দান করা হলো প্রতিটি বিহারের বর্তমান প্রয়োজন মেটানোর জন্য। আর সেই সঙ্গে প্রত্যেক বিহারের জন্য বরাদ্দ করা হলো দশটি করে গ্রাম। আগামীকাল প্রভাতেই তাম্রফলকের দানপত্রে নিজের নামাঙ্কিত মুদ্রার ছাপ দিয়ে দেবেন মহারাজ। পাঁচ অধ্যই মহা খুশি।
কিন্তু আরো প্রাপ্তির বিস্ময় অপো করছিল তাদের জন্য। মহারাজ জনালেন, বরেন্দ্রভূমিতে প্রতিষ্ঠা করা হবে এক মহাবিহার। যা হবে নালন্দার সমতুল্য। মহারাজা ও মহামাত্য এ ব্যাপারে পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন। সেই মহাবিহারের নকশা প্রস্তুত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে বিশ্বের স্থপতিকুলশিরোমণি ধীমান এবং তার সুযোগ্য পুত্র বীতপালের ওপর। বরেন্দ্রভূমির সোমপুরে টিলার ওপরে এই মহাবিহার নির্মিত হবে। মাঝখানের মন্দিরে থাকবে অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। সেখানে থাকবে একশত শ্রেণীক, ও দশ হাজার ভিু শিার্থীর থাকার ব্যবস্থা। প্রত্যেক মাসে মহাবিহারে আয়োজন করা হবে কমপে একটি করে শিা ও ধর্মীয় উৎসব।
একটি বড়-সড় গ্রামের মতো বিশাল স্থান জুড়ে তৈরি হবে আটটি মঠ। প্রতিটি মঠের ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রদান করা হবে একশত কুড়ি পাটক করে ভুমি। প্রত্যেক মঠে অধ্যাপক ও ছাত্ররা ছাড়াও থাকবেন একজন করে গণক, একজন কায়স্থ (হিসাবরক), চারজন মালাকার, দুইজন তৈলিক, দুই কুম্ভকার, পাঁচজন কাহলিক (ঢোলবাদক), দুইজন শঙ্খবাদক, দুইজন ঢক্কাবাদক, চারজন দ্রগড়বাদক (সময় জ্ঞাপক ঘণ্টা), কর্মকর ও চর্মকার মিলে বাইশজন, একজন নট, দুইজন সুত্রধর, দুই স্থপতি, দুই কর্মকার, আটজন  বেট্টিক (চাকর)। অধ্যাপক সম্মানী হিসাবে পাবেন দশ দ্রোণ দশ পাটক জমির আয়, প্রত্যেক শিার্থীর ‘পালিফুট্টাকার্থং’ (খাদ্যসহ ব্যয় নির্বাহ) বাবত এক পাটক জমির আয়, অতিথিসেবার জন্য পাঁচ পাটক ভূমির আয়। এছাড়া ভাণ্ডারি ব্রাক্ষ্মণের জন্য এক পাটক জমির আয়, গনকের জন্য এক পাটক জমির আয় এবং কায়স্থের জন্য আড়াই পাটক জমির আয়। মালাকার তৈলিক কুম্ভকার কাহলিক শঙ্খবাদক ঢক্কাবাদক দ্রগড়িক কর্মকর চর্মকার প্রত্যেকে অর্ধ পাটক, নট দুই পাটক, সুত্রধর ও স্থপতি প্রত্যেকে দুই পাটক এবং প্রত্যেক বেট্টিক পৌণে এক পাটক ভুমির আয় পাবে। ভাঙ্গা এবং ফুটো চালাগুলি সারানোর জন্য দশ পাটক এবং নতুন কোনো নির্মাণ কাজের জন্য সাতচল্লিশ পাটক ভূমির আয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মহাবিহারে যাতে কখনোই কোনো জলকষ্ট না হয় সেই জন্য খনন করা হবে যথেষ্ট সংখ্যক গভীর কূপ। তবে পাশাপাশি পানীয় জল রান্নাঘরে এবং প্রত্যেক অধ্যাপকের কে পৌঁছে দেবার জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বারিক (জলবাহক)। বারিকের বেতন বাবদ বরাদ্দ করা হয়েছে দেড় পাটক ভূমির আয়।
সাধু! সাধু!
পাঁচ অধ্য অভিভূত। এছাড়া আর কোনো বাক্য নিঃসৃত হতে পারে না তাদের কণ্ঠ থেকে। কৃতজ্ঞতা জানানোর আর কোনো ভাষা তারা খুঁজে পান না। একবার শুধু বলেনÑ এর জন্য যে অনেকগুলি গ্রাম সম্প্রদান করতে হবে মহাবিহারের নামে!
সে বিষয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেইÑ অম্লানবদনে আশ্বাস দেন ভট্টবামনÑ বরেন্দ্রীতে আর যাই হোক, নালভূমির অপর্যাপ্ততা নেই। অসভ্য কৈবর্তরা অনেক খিলত্রেকে (পরিত্যক্ত ভুমি) অন্তত শস্য ফলানোর উপযোগী করে গড়ে তুলতে পেরেছে। সেই কারণেই তো আমরা সোমপুর মহাবিহার প্রতিষ্ঠার জন্য বরেন্দ্রভূমিকেই বেছে নিয়েছি। কৈবর্তরা অনন্তকাল চালিয়ে যাবে মহাবিহারের ব্যয়নির্বাহের কাজ। বিনিময়ে তাদের অসুরযোনীতে জন্মগ্রহণের পাপ অন্তত মোচন হবে কিছুটা।
মহামাত্যের দূরদর্শিতা তো সর্বজনবিদিত। তার আর নতুন করে প্রশংসা জানানোর দরকার কী? তবুও পঞ্চ আচার্য পঞ্চমুখে প্রশংসা শুরু করলেন ভট্টবামনের নিখুঁত পরিকল্পনার। স্মিতমুখে তাদের প্রশংসাবাক্যগুলি গ্রহণ করলেন মহামাত্য। তারপরই ঈষৎ গ¤ী¢র হয়ে উঠল তার চেহারা। ভারি কণ্ঠে বললেনÑ অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধ ও তাঁর সংঘের সেবায় যৎকিঞ্চিৎ অবদান রাখতে পেরে আমরা যারপরনাই আনন্দিত। কিন্তু বিনিময়ে আমরা, মানে এই পাল সাম্রাজ্য, আপনাদের কাছে কিঞ্চিৎ সাহায্য যাচঞা করছি।
মুহূর্তে ভারি হয়ে ওঠে করে পরিবেশ। পাঁচ আচার্য অস্বস্তির সাথে পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করেন। তারপর অপো করতে থাকেন মহামাত্যের পরবর্তী উচ্চারণের।
ভট্টবামন বলেন- আপনাদের কাছে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা কোনো কৈবর্ত বা চণ্ডালকে বুদ্ধের সংঘে গ্রহণ করবেন না।
কেন?
আর্যরক্তের শুদ্ধতা রা করার জন্য আমাদের সর্বান্তঃকরণে সচেষ্ট থাকতে হবে।
একথা বলার পরে তীèদৃষ্টিতে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকান ভট্টবামন। বোঝার চেষ্টা করেন সবার প্রতিক্রিয়া। তারপরে ফের সূত্র ধরেন আগে বলা বাক্যেরÑ আমি আগেই বলেছি, এই ভূখণ্ডের বৌদ্ধ এবং হিন্দু উভয়েই আর্য রক্তের ধারা বহন করছে। পিতৃ-উত্তরাধিকারের দিক থেকে তারা মূলত এক। আমরা হিন্দুরা, আমাদের শাস্ত্রের স্যা পেয়েছি একথার সত্যতা প্রমাণে। এমনকি হিন্দুরা বিষ্ণুর যে দশ অবতারকে শ্রেষ্ঠ জেনে পূজা করেন, তাঁদের মধ্যেও গৌতম বুদ্ধ রয়েছেন। আপনারা বোধহয় জানেন যে এই দশাবতার হচ্ছেন মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, শ্রীরাম, বলরাম, বুদ্ধ এবং কল্কি। আপনারা যদি হিন্দুদের পাশপত মঠে যান, সেখানে যে শিবমূর্তি দেখতে পাবেন, সেই শিবের মাথার উপরে দেখবেন বরাভয় মুদ্রাধারী বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব। সেখানে প্রায়শ্চিত্তকারীরা পাপমুক্তির যজ্ঞ করতে গিয়ে যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তা হচ্ছেÑ
জগদুপকৃতিরেব বুদ্ধপূজা
তদপকৃতি স্তব লেনাকনাথ পীড়া।
জিন জগদপকৃৎ কথং লজ্জে
গতিতুমহং তব পাদপঙ্কজভক্তঃ। ।
(জগতের উপকারসাধনই বুদ্ধের পূজা। তার অপকারসাধনই, হে লোকনাথ, তোমার পীড়া। হে জিন, জগতের অপকারী আমি কেন লজ্জা বোধ করছি না এই কথা উচ্চারণ করতে যে আমি তোমার পাদপঙ্কজের ভক্ত। )
হরিভদ্র মৃদুকণ্ঠে বলেনÑ জানি। এসব কথা আমরা জানি। কিন্তু...
তার বাক্য শেষ করা সম্ভব হয় না। এবার বাধা দেন স্বয়ং মহারাজ। বলেনÑ আপনার দ্বিধার কোনো কারণ নেই আচার্য। মহামাত্য যা বলেছেন, যুক্তিযুক্ত জেনে আমার সঙ্গে পরামর্শক্রমেই বলেছেন। দয়া করে তার অবশিষ্ট কথাগুলিও শুনুন।
ভট্টবামন ফের বলতে শুরু করেনÑ আমাদের রক্তের বিশুদ্ধতা নষ্ট হচ্ছে দুই ধরনের বিবাহের কারণে। অনুলোম বিবাহ (ব্রাক্ষ্মণ ও অন্য দ্বিজদের সাথে নিম্নবর্ণের নারীদের বিবাহ) এবং প্রতিলোম বিবাহ (ব্রাক্ষ্মণ কন্যার সাথে নিম্নবর্ণের পুরুষের বিবাহ)। এতে সৃষ্টি হচ্ছে বর্ণশংকর, পারশব এবং চণ্ডালদের। এদের মধ্যে চণ্ডালরা (ব্রাক্ষ্মণীর গর্ভে শূদ্র পুরুষের বীর্যে উৎপন্ন সন্তান) হচ্ছে আমাদের সমাজের ভয়ঙ্কর এক সমস্যার নাম। এদের সম্পর্কে মনুর বিধানে লেখা আছেÑ চণ্ডালদের আশ্রয়স্থল হতে হবে গ্রামের বাহিরে। তাদের অপপাত্র করবে (জলপাত্রাদি দেবে না), এদের ধন বলতে থাকবে কুকুর ও গাধা। এদের পরিধেয় বস্ত্র হবে শববস্ত্র, ভোজন ভগ্নপাত্রে, অলংকার লোহার বেড়ি। ধর্মানুষ্ঠানকারী  লোক তাদের সাথে দর্শনাদি আলোচনা করবেন না। তাদের ঋণদানাদি পরস্পর (নিজেদের মধ্যে) হবে, এবং বিবাহ হবে শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই। এদের অন্ন পরাধীন (অর্থাৎ ভদ্রজন সরাসরি এদের হাতে বা থালায় অন্ন তুলে দেবেন না, দেবেন ভৃত্যের মাধ্যমে), অন্ন দিতে হবে ভগ্নপাত্রে, তারা রাত্রিকালে কোনোমতেই কোনো নগরে ও ভদ্রগ্রামে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি দিনের বেলাতে প্রবেশ করে তাহলেও সেখানে রাজার অনুমতিতে কোনো চিহ্নে চিহ্নিত হয়ে দ্বিজদের স্পর্শদোষ না ঘটিয়ে বিচরণ করবে এবং অনাথ শব লোকালয় থেকে বাহিরে বহন করে নিয়ে যাবে।
জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ কৌটিল্যের একটি সাবধান বাণী মনে রাখবেনÑ যে রাজ্য শূদ্রবহুল, শস্তিকাকীর্ণ ও দ্বিজহীন, সেই রাজ্য দুর্ভি ও মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে শীঘ্রই বিনষ্ট হয়।
জন্মের বিচারে দেখুন, অসুর-বীর্যে পৃথিবীর গর্ভে  কৈবর্ত জাতির জন্ম। এরা চণ্ডালের সমগোত্র। কাজেই এদের জন্য যদি আপনারা বোধিসত্ত্বের শরণ উন্মুক্ত করে দেন, তাহলে ওরা বেশি বেশি মিশে যেতে থাকবে আর্যদের সঙ্গে। আরো বেশি করে সৃষ্টি হবে ঘৃণীত শঙ্কর জাতির। তাতে রাজ্যবিনষ্টির সমূহ আশংকা। তাই অনুরোধ, ব্রক্ষ্মার পদতল থেকে যাদের সৃষ্টি, তাদের চিরকাল পদাবনতই রাখতে হবে, ভগবান প্রকৃতির এই নিয়ম মেনে নিয়ে নিয়মটিকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকুন। কোনোমতেই, আবার বলি, কোনোমতেই প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না কৈবর্তদের।
কৈবর্তদের যে কতটা ঘৃণা করেন ভট্টবামন তা বোঝা যাচ্ছিল, প্রতিবারই কৈবর্ত শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার চু ও নাসিকার তীব্র কুঞ্চন দেখে।


০৮. ওলান ঠাকুর কথা বলেন
দিব্যোকের কার্যালয়ের সামনে শত শত মানুষ। বরেন্দির সবগুলি গ্রামের মণ্ডল, কুলিক, অষ্টগ্রামিক, দশগ্রামিক, কৈবর্ত-পুরোহিত সবাই একসঙ্গে ধরনা দিতে এসেছে আজ। সবাই বিুব্ধ। কৈবর্তদের কি মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে চায় মহারাজা মহীপাল আর তার লোকজন? তা নইলে কেন দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে অত্যাচার?
দিব্যোকের মন্ত্রণাকে এত লোকের স্থান সংকুলান হবে না। তাই সকলকে নিয়ে কার্যালয়-চত্বরের গাছের ছায়ায় বাঁশের চাঁচের পাটি বিছিয়ে আলোচনায় বসে দিব্যোক। শুনতে চায় সমস্যার কথা।
সমস্যা তো সেই ভূমি, সেই ভূমিকর, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, সেই বেগার। রাজা একের পর এক গ্রাম দান করে চলেছেন পুণ্যের নামে। আর তার সম্পূর্ণ হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে কৈবর্তপ্রজাদের। সেই সাথে কোল, ভিল, কোচ, রাজবংশীরাও সমান ভুক্তভোগী।
শনিয়া মণ্ডল প্রথমেই শুরু করেÑ আমরা এখন কার প্রজা বটি?
কার প্রজা মানে? মহারাজাধিরাজ মহীপালের প্রজা।
আমরা কার লিয়মে চলব?
রাজার লিয়মে।
বুধিয়া মণ্ডল এবার কথা বলে ওঠেÑ তা সেই রাজার লিয়মটা কী?
কেউ কোনো কথা বলে না বেশ কিছুণ। আঙিনার ছায়ার বাইরে রোদে পুড়ে পুড়ে আরো তামাটে হয়ে যাচ্ছে বরেন্দির মাটি। মাঝে মাঝে রোদে তেতে ওঠা বাতাসের ঝাঁওয়াল কালো নাঙা শরীরগুলোর গায়ে দমকায় দমকায় গরমের  হলকা ছিটিয়ে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। অষ্টপ্রহর ঘামতে থাকা শরীরগুলো থেকে এই বাতাস ঘাম শুষে তো নেয়-ই না, বরং ঘামের ধারা এবং গায়ের জ্বালা আরো বাড়িয়ে দেয়। তবে এই মুহূর্তে প্রকৃতির গরমের চাইতে অন্তরের রাগ-ঝালের গরমেই বরং টগবগ করে ফুটছে মানুষগুলো। বেশ কিছুটা সময় উত্তরের জন্য অপো করেও দিব্যোকের মুখ খোলার লণ না দেখে বুধিয়া নিজেই আবার মুখ খোলেÑ রাজার লিয়মে আমরা আমাদের ভুঁই চষি, ধান ফলাই, ফসল কাটি, ঝেড়ে-মেপে ঘরে তুলি। আর বছর অন্তর অন্তর তার ছয় ভাগের এক ভাগ তুলে দিই রাজার লোকের হাতে। ঠিক কি না?
হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক!
এই লিয়ম মোদের বাপ-ঠাকুরদার আমলের। ঠিক কি না?
হ্যাঁ ঠিক বটি।
তুমি দিব্যোক, তুমি যখন বরেন্দির রাজা হলে...
না, আমি রাজা লইÑ দিব্যোক বলেনÑ রাজার লোক বটি।
হ্যাঁ, যখন রাজার লোক হলে, তখনও তো সেই আগের লিয়মই।
হ্যাঁ, সেই লিয়মই।
কিন্তু এখন যে এক এক গাঁয়ে এক এক লিয়ম। এখন অনেক গাঁয়ে আর রাজার লিয়ম নাই। কোনো গাঁয়ে বামুনঠাকুরের লিয়ম, কোনো গাঁয়ে অশোক শ্রীজ্ঞানের লিয়ম। আমরা এখন কোনটা মানি?
এ কথার উত্তর দিব্যোকের অজানা। রাজা যে মহাবিহার এবং মন্দিরের জন্য একের পর এক গ্রাম দান করে চলেছেন, তার ফলে কৈবর্তদের বড় অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু অনেক ভাবনা-চিন্তা করেও সে উপযুক্ত কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারেনি।
দশগ্রামিক ভোয়ীল খুবই অভিজ্ঞ মানুষ। বহুদিন ধরে রাজ-কার্যালয় এবং কৈবর্তপ্রজাদের মধ্যবর্তী হিসাবে কাজ করে আসছেন। মধ্যবর্তিতা যে করে, প্রকৃতিগতভাবেই তাকে ঠাণ্ডা স্বভাবের হতে হয়। সেই ভোয়ীলকেও আজ বিুব্ধ মনে হয়Ñ এ কী অনাচার বাপু! লিয়ম ছিল কর দিতে হবে ফসলের আট ভাগের এক ভাগ। পরে বাড়িয়ে করল ছয় ভাগের এক ভাগ। এখন সেটিও শুধু আছে লিয়মের নামে। আসলে নিয়ে যাচ্ছে যা খুশি সেই পরিমাণ। তাহলে আমাদের খাওয়ার জন্যে থাকলটা কী? এ কি অনাচার লয়?
খালি কি জমি?Ñ উঠে দাঁড়ায় মৎস্যজীবী কিছু কৈবর্তÑ চিরকাল শুনেছি খাল-বিল-নদী-হাওড় সব ওলান ঠাকুরের সম্পত্তি। যে সব গাঁয়ের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে, খাল ঢুকেছে যেসব গাঁয়ের পেট চিরে, সেই সক্কল গাঁয়ের মানুষের জন্য ধরতি মা অধিকার দিয়েছে জলের-মাছের-গুগলি-শামুকের। চিরকাল শুনে আসছি আমাদের বাপ-ঠাকুদ্দার সময় থেকে, কেউ কুনোদিন নদী-খালের ওপর অন্যায্য হাত বাড়ায়নি। এতদিন সেই জলের ফসলই আমাদের মুখের অন্ন যুগিয়েছে। আর এখন? এখন  ঘাটে ঘাটে বসিয়েছে ঘাটক। তারা বলেÑ দিতে হবে জলকর। বলে একবার ডোঙা-জাল নিয়ে জলে নামলে দিতে হবে আধা কার্ষাপণ। দিতে না পারলেই কেড়ে নেবে মাছ জাল সবকিছু।
আর হঠাৎ হঠাৎ মঠ থেকে, বিহার থেকে, মন্দির থেকে, আজ্ঞা নিয়ে আসবে রাজপুরুষ। আসবে সেই সূর্যের আলো ওলান ঠাকুরের গায়ে পড়ার আগেই। যাকে যাকে ইচ্ছে হবে, আদেশ দিবে, তাকে যেতে হবে বিষ্টি (পারিশ্রমিক ছাড়া বেগার) দিতে। খেতের কাজ ফেলে, মাঠের কাজ ফেলে, ঘরের কাজ ফেলে তখন যাও বিষ্টি দিতে। যাব না বললেই পিঠে পড়ে কাঁটালাগানো লাঠির বাড়ি। দগদগে গা হয়ে যায় পিঠে। পিছন ফিরে পিঠ দেখা রে তোরা। মোদের রাজার মানুষ দিব্যোক দেখুক তার জাতির মানুষের পিঠগুলোতে রাজার কেমন চিহ্ন আঁকা করা আছে।
বনে যাই যদি একটা হরিণ-খরগোস কিছু পাওয়া যায়। তাতে অন্তত মাংসের সোয়াদ কিছু হলেও মনে রাখতে পারে ঘরের ছেলে-মেয়েরা। এখন সেখানেও রী বসিয়েছে। বনকরের কার্ষাপণ না দিয়ে বনে ঢোকা বারণ।
আরে শিকার তো শিকার! মেয়েরা যে কাঠ-পাতা টোকাতে যায় বনে, সেটি পর্যন্ত করার যো নেই। তাদের সাফ কথা, বনে ঢুকতে হলে কড়ি ফেলতে হবে। আর ঝোপ-ঝাড়ের আবডাল পেলে সোমত্ত মেয়েদের ওপর হামলে পড়া তো আছেই।
তবে হ্যাঁ! আমাদের মেয়েগুলোনও ওলান ঠাকুরের যোগ্য কন্যা বটি! কুকুরের বমির মতোন ফ্যাকফেকে  সাদা চামড়ার লোক তাদের দিকে হাত বাড়ালেই টাঙ্গি দিয়ে এমন কোপ মারে যে ডাকাতগুলো পালানোর পথ পায় না। গিয়ে দ্যাখো, সবগুলো বনরীর গায়ে-হাতে-বুকে টাঙ্গির কোপের দগদগে ঘা।
কৈবত-মেয়েদের বীরত্বের গর্বে সকলের চেহারা কিছুণের জন্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তবে বেশিণ সেই মৌতাত টেকে না। ওরা আবার নিজেদের ফিরিয়ে আনে মূল আলোচনায়-
ওরা নাকি ধম্ম করে। এগুলো কি ধম্ম না অধম্ম?
অধম্ম! অধম্ম! সম্মিলিত শব্দ ওঠে।
ভোয়ীল আবার বলে ওঠেÑ দিব্যোক, আমরা রাজা-মহারাজা-মন্ত্রী এইসব কিছু বুঝি না। আমরা বুঝি তুমি আমাদের লিজের মানুষ। আমাদের জাতির মাথা। আমরা তাই বলছি তুমি এইসবের বিহিত করো।
হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি এইসবের বিহিত করো! আবারো সমস্বর কাঁপিয়ে দেয় পুরো চত্বর। সেই সমস্বর এত জোরে বেজে ওঠে যে গরম বাতাসের একটা কুণ্ডলি সেই শব্দের সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজেকে কেন্দ্র করে কয়েক পাক ঘুরে আকাশের দিকে উঠে যায়।
কিন্তু দিব্যোক চুপ। মাথা নিচু করে বসা।
রা করছ না কেনে দিব্যেক? বিহিত কর তুমি এইসব অধম্মের।
আমি তো চেষ্টার ত্র“টি করিনি। পত্রের পর পত্র পাঠিয়েছি মহাসন্ধিবিগ্রহিকের কাছে, পুস্তপালের কাছে, অমাত্য-মহামাত্যের কাছে। এমনকি মহারাজের কাছেও। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ফল হয়নি।
বুধিয়া মণ্ডল বলেÑ আরে ছোঃ! ওসব লিখা-আঁকার কী কুনো ফল হয়! পত্রে লিখে আর কতটুকুন বলা যায়? আসল হলো মুখের কথা। তুমি মহারাজের কাছে যাও। মুখে মুখে কথা বলো!
সমস্বরে সমর্থন আসেÑ হ্যাঁ হ্যাঁ মুখে মুখে কথা বলো!
আমি মহারাজের সাাতের অনুমতি প্রার্থনা করেও পত্র লিখেছি। কিন্তু সেই আবেদনেরও  কোনো সাড়া পাইনি।
দিব্যোকের কণ্ঠে অসহায়তা।
এ-ও তো সেই লিখা-আঁকার কথাই বলছে দিব্যোক। আরে জলজ্যান্ত মানুষ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেসব কথা বলতে পারে, লিখা-আঁকা তো আর তা পারে না। তাছাড়া কাগজ বলো আর তালপত্র বলো, যাতেই লিখা হোক না কেন, সেই জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে কে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষকে তো আর কেউ ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। এই সাধারণ কথাটা কি ভুলে গেছে দিব্যোক? রাজার লোকের সাথে উঠা-বসা করতে করতে সে-ও এখন কি হয়ে গেছে রাজার লোকদের মতো? তা নাহলে মুখে মুখে কথা বলার পরিবর্তে বার বার কেন লিখা-আঁকার কথা বলছে?
সমবেত কৈবর্ত মোড়লরা একটু বিরক্তই হয় দিব্যোকের উপর। সেই বিরক্তি কীভাবে প্রকাশ করবে ভাবতে একটু সময় লাগে তাদের। ফলে কিছুণের জন্য একটা স্তব্ধতা নেমে আসে সভায়।
হঠাৎ প্রচণ্ড এক চিৎকার চিরে ফেলে স্বল্পকালীন স্তব্ধতার পর্দাÑ কট্টলি! কট্টলি!
শব্দটি শোনামাত্র উপস্থিত সবার দেহের মধ্য দিয়ে যেন চড়াৎ করে বিজলি বয়ে যায়।
কে বলে এই কথা! কে ধরতি-মাতাকে ডাকে এই নাম ধরে!

মুকেন্দে ঠাকুর উদ্বাহু নাচছে। ওলান দেবতার পুরোহিত মুকেন্দে। পুরো কৈবর্ত সমাজের প্রধান ওঝা। তাকে আকাশের দিকে দুই হাত তুলে নাচতে দেখে এবং চিৎকার করতে শুনে সবার রোম খাড়া হয়ে যায়। ভর উঠেছে মুকেন্দে ঠাকুরের। স্বয়ং ওলান দেবতা এখন ভর করেছে তার ওপর। সে এখন আর শুধু মানষ নয়, সাাৎ দেবতা। তার কণ্ঠে কথা বলবে ওলান ঠাকুর।
কট্টলি! কট্টলি!
বরেন্দির আদি নাম কট্টলি। বয়স্করা জানে। কিন্তু সবাই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে বরেন্দি নামেই। আজ এত বছর পরে বিস্মৃতির পর্দা সরিয়ে ফেলে সেই নামকে কেন পুনরুজ্জীবিত করছে ওলান ঠাকুর!
আমি আমার কট্টলিকে চাই! ফিরিয়ে দে আমার কট্টলিকে!
সভার সবচেয়ে সদস্য বয়স্ক শনিয়া মণ্ডল করজোড়ে সামনে দাঁড়ায়Ñ এই তো তোমার কট্টলি বাবা! আমরা সবাই তো কট্টলিতেই আছি।
আমি কৈবর্তদের জন্যে যে কট্টলি বানিয়েছিলাম, তোরা সেই কট্টলিকে ফিরিয়ে আন।
এই কি কট্টলি সেই কট্টলি লয় বাবা?
না। আমার কট্টলি ফিরিয়ে আন।
এবার হতভম্ব হয়ে পড়ে সবাই। কোন দেশের কথা বলছে ওলান ঠাকুর মুকেন্দের মুখ দিয়ে?
এই দেশটা কাদের? কৈবর্তদের। কৈবর্তদের জন্যে বানিয়েছিলাম আমি। এই লাল মাটি, এই উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি, এই লাল নদী, এই বন-জঙ্গল, পাখি-পাখলা, এই মাটির ওপর দিয়ে নদীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া লু বাতাসÑ সব কৈবর্তের জন্যে। সবকিছু শুধু কৈবর্তের জন্যে।
এই পর্যন্ত বলেই হাহাকার ফুটে উঠে মুকেন্দের কণ্ঠেÑ আমার সন্ততিগুলির জন্যে আর কিছু নাই রে! যে মাটি ছেনে যাদের বানিয়েছি, সেই মাটি আর তাদের নাই রে!
এলোমেলো পা ফেলে ঘুরতে থাকে মাকেন্দে। কারো কারো সামনে দাঁড়ায় দুই-এক মুহূর্তের জন্য হয়তো। যার সামনে দাঁড়ায়, তারই চোখের সামনে আঙুল তুলে ইঙ্গিত করে মাটির দিকে তাকাতে, আকাশের দিকে তাকাতে, তার গাত্রবর্ণের দিকে তাকাতে। তারা নির্দেশিত জিনিসগুলির দিকে তাকায়। কিছু একটা অনুভব করে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না মুকেন্দের ইঙ্গিতের পূর্ণ অর্থ। মুকেন্দে ভ্রƒপে করে না। সে ঘুরেই চলে। ঘূর্ণি বাতাসের মতো পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে চলে। আঙিনায় মেলে রাখা অঞ্জনলক্ষ্মী ধানে কৈবর্তনারীরা যেভাবে ঘুরে ঘুরে পা দিয়ে মলন দেয়, সেভাবে ঘুরতে থাকে মুকেন্দে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে মুকেন্দে চলে যায় একেবারে দিব্যোকের সামনে। টকটকে লাল চোখ মেলে তাকায় দিব্যোকের চোখে। কাঁপা কাঁপা আঙ্গুল তোলে তার দিকেÑ যা কট্টলিকে ফিরিয়ে লিয়ে আয়!
দিব্যোক কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু তাকে সেই সময় দেয় না মুকেন্দে। আরো জোরে চিৎকার করে ওঠেÑ যা কট্টলিকে ফিরিয়ে লিয়ে আয়!
তারপর ঝটিতে সরে যায় দিব্যোকের সামনে থেকে। তার ঘূর্ণিগতি এতটাই বেড়ে ওঠে যে কেউ আর পুরো অবয়বের মুকেন্দেকে দেখতে পায় না। শুধু দেখতে পায় কোমরে সাদা কাপড় জড়ানো কালো একটা কাঠামো চৈত্রের ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে বনবন করে ঘুরছে।
হঠাৎ করেই থেমে যায় সেই ঘূর্ণি। পাক খাওয়া বন্ধ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছুণ ঝড়ে-পাওয়া গাছের মতো টলতে থাকে মুকেন্দে। তারপর দড়াম করে আছড়ে পড়ে রোদতপ্ত লালমাটিতে। খিঁচুনি ওঠে তার। মুখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে আসে সাদা গ্যাঁজলা। আক্ষেপে কেঁপে কেঁপে উঠে তার শরীর কয়েকবার। তারপর স্থির হয়ে যায়। লোকজন কাছে গিয়ে দেখে, ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে মুকেন্দের মুখাবয়বের কষ্টের রেখাগুলি। শান্ত স্থির হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। শান্তির ঘুম।
দেবতার আদেশ এসেছে!
ফিস ফিস শব্দ ওঠে চারপাশে। তার মানে যুদ্ধ করতে হবে।
না!
দিব্যোক পরিষ্কার জানিয়ে দেয়Ñ যুদ্ধ এখন করা যাবে না।
তাহলে আমরা কী করব? যদি এখন যুদ্ধ না করি, তাহলে কি দেবতার কথা অমান্য করা হয় না?
দিব্যোক বলেÑ আগে আমরা মহারাজের কাছে ধরনা দিব। বুঝিয়ে বলব আমাদের কষ্টের কথা।
তা সেই মহারাজকে আমরা পাচ্ছি কোথায়?
গৌড়ে। রাজধানীতে যাব আমরা।
সবাই? সব কৈবর্ত?
না। সবার যাওয়ার দরকার নাই। যাব আমি। যাবে আমার ভাই রুদোক। সঙ্গে যাবে দশগ্রামিক আর মণ্ডলরা।
সবাই গেলে তিটা কী?
দিব্যোক বোঝানোর চেষ্টা করেÑ আমাদের তো ঘোড়া নেই। তাই গৌড়ে যেতে হবে হেঁটে, নয়তো গরুর গাড়িতে। তাহলে গৌড়ে গিয়ে পৌঁছুতেই আমাদের লাগবে এক হপ্তা। ফিরে আসতেও তাই। আর মহারাজের সাাৎ পেতে যে কত দিন সময় লাগবে তার ঠিক নেই। তাহলে যদি ধরো, পুরো এক মাস বরেন্দির সব পুরুষ বাইরে থাকে তাহলে েেতর কাজ করবে কে? গরু-ছাগলের দেখা-শোনা করবে কে? বিপদে আপদে নারী ও শিশুদের রা করবে কে?
মাথা নাড়ে কেউ কেউÑ কথা তো অন্যায্য লয়!
ঠিক হয় প্রতিনিধিদল যাত্রা শুরু করবে তুষ্যা পরবের শেষে ওলান ঠাকুরের পূজা শেষ করার পরে।
ততদিন কী করা হবে?
মুচকি হাসে দিব্যোক। বলে- মাঝে মাঝে আমরা শিকার পরব করব।
সঙ্গে সঙ্গে খুশির শব্দ ভেসে আসে জনসমাবেশ থেকে।               [চলবে]


বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬৪০, ডিসেম্বর ০৪, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।