ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

মারিও ভার্গাস য়োসার কপটতা

ভিসেন্তে নাভারো | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১০
মারিও ভার্গাস য়োসার কপটতা

[যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ভিসেন্তে নাভারো পাবলিক ও সোশ্যাল পলিসি পড়ান। লেখালেখি করেন।

এছাড়া স্পেনের পম্পু ফাব্রা বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ে পড়ান। চলতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া সাহিত্যিক মারিও ভার্গাস য়োসার ওপর সমালোচনামূলক নাভারোর এই লেখাটি গত ১৭ নভেম্বর কাউন্টারপাঞ্চ.কম-এ প্রকাশিত হয়। তিনি মনে করেন, য়োসার ‘মানবতাবাদ’ আসলে তার আপসকামিতা আর মার্কিনপন্থারই অন্য চেহারা। বাংলানিউজের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন রানা রায়হান]

২০১০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকে রণশীল-উদারনৈতিক সব গণমাধ্যমেই মারিও ভার্গাস য়োসার গুণকীর্তন আমরা দেখেছি। তাকে সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় মানবাধিকার রার লড়াইয়ে একজন যোদ্ধা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একের পর এক প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাকে মহান মানবাধিকার কর্মী বলেও অভিহিত করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, মানবাধিকারের প্রতি মারিও ভার্গাস য়োসার প্রতিশ্রুতি চূড়ান্ত পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট। তিনি হুগো শাভেজের সরকারের ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ সব ধরনের স্বাধীনতা শ্যাভেজ দমিয়ে রেখেছেন। তাকে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। তার অভিযোগ, শ্যাভেজ ও তার সরকার বিরোধী দলের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতায় কর্ণপাত করেননি বা এমনকি উস্কে দিয়েছেন। একই ধরনের সমালোচনার আঙুল তিনি বলিভিয়ায় ইভো মোরালেসের সরকারের দিকে তাক করে আছেন।

লক্ষণীয়ভাবে কলম্বিয়ায় আলভারো উরিবে ও তার সরকারের মানবাধিবার লঙ্ঘনের ব্যাপারে ভার্গাস য়োসা চুপচাপ রয়েছেন। উরিবের সেনাবাহিনী প্রায় এক হাজার লোককে হত্যা করেছে। খুন হওয়ার আগে এসব মানুষকে যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই ‘সন্ত্রাসী’ (সচরাচর এরকম তকমাই এঁটে দেওয়া হয়) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে ভার্গাস য়োসা কিছু বলেননি। এই কলম্বিয়াতেই বিশ্বের সব দেশের চেয়ে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক সংগঠনের কর্মীদের গোপনে হত্যা করা হয়েছে। তিনি কিছুই বলেননি। হন্ডুরাসের বর্তমান সরকার এসেছে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই সরকার বিরোধী দল, সাংবাদিক ও শ্রমিক সংগঠনের কর্মীদের হত্যা করছে অথচ ভার্গাস য়োসা এ নিয়ে টুঁ-শব্দও করেননি। সত্যি বলতে কি তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের পইে ছিলেন। ভেনিজুয়েলা ও বলিভিয়ায় গণমাধ্যমের বহুমুখী স্বাধীনতা রয়েছে, যা কলম্বিয়া ও হন্ডুরাসে নেই, এ ব্যাপারেও ভার্গাস চুপচাপ। এক্ষেত্রে বরং তিনি শেষোক্ত দেশ দুটিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরে শক্তি বলেও উল্লেখ করেছেন।

একটি বিষয় পরিষ্কার যে, মারিও ভার্গাস য়োসা মানবাধিকার ইস্যুকে ব্যবহার করছেন বামপন্থী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে, ডানপন্থীদের পক্ষে আদতে তিনি স্পেনের (তার স্পেনের নাগরিকত্ব রয়েছে) কট্টর ডানপন্থী পপুলার পার্টির (পিপি) সদস্য ছিলেন। এই পার্টির প্রতিষ্ঠা করে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের সদস্যরা।

এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন, ফ্রাঙ্কোর একনায়ক শাসনের সময় সংঘটিত সব ধরনের অপরাধ স্পেনের সুপ্রিম কোর্টে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করেন বিচারক গার্সোন। আর এই ‘অপরাধে’ গার্সোনের বিরুদ্ধে চলা বিচারকে সমর্থন করে পপুলার পার্টি। ভার্গাস য়োসা এই দলেরই সদস্য ছিলেন। ফ্যাসিস্ট দল লাক্ষ ফালানজের সম্পর্কে নিন্দাসূচক কথাবার্তা বললে গার্সোনের বিরুদ্ধে এই মামলা হয়। বিচার প্রক্রিয়ার পুরো সময়েই ভার্গাস য়োসা নিশ্চুপ ছিলেন।

তিনি স্পেনের আসনার সরকারেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পিপির নেতা আসনার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাক আগ্রাসনের সমর্থক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থী টি পার্টির ঘোর সমর্থক পিপি। ভার্গাস য়োসা আসনারকে বিশ শতকের একজন মহান নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন তার এক লেখায় (টোয়েন্টি মিনিটস পত্রিকা, মাদ্রিদ, ৬ জুলাই, ২০০৭)। অর্থনীতি ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসনার চূড়ান্ত রকমের প্রতিক্রিয়াশীল। আশ্চর্য হলেও ইউএস জার্নালে তাকে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে পাঁচজন প্রেসিডেন্টের একজন বিবেচনা করে প্রতিবেদন ছাপে। আসনারের প্রশংসাকারী ভার্গাস য়োসা আমেরিকার এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর রণশীল প্রতিষ্ঠান) আরভিং ক্রিস্টল পুরস্কার নিয়েছেন। ইকোনোমিস্ট যে লিখেছে, স্পেনে মধ্য বামপন্থীদের প্রতি ভার্গাস য়োসা সহমর্মী, এটি আসলে সত্যের অপলাপ মাত্র। (এর মধ্য দিয়ে এই উদারনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকাটির অযোগ্যতা ও পক্ষপাতিত্বই প্রকাশ পেয়েছে। )

চার্চের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ভার্গাস য়োসা সম্প্রতি পিপি ছেড়ে এসেছেন। এখন জ্যাকোবিন পার্টির সদস্য। এই পার্টি এখন স্পেনের সর্বত্র স্প্যানিশ ভাষা (কাস্তিলিয়ান) চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে এমনকি যেখানে মাতৃভাষা স্প্যানিশ নয়, সেখানেও।   স্পেনের বহুত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে এই পার্টি। কাতালোনিয়া ও বাস্ক অঞ্চলের মাতৃভাষা স্প্যানিশ নয়। কাতালোনিয়ার ভাষা কাতালান। আমার জন্ম এখানে। আমার শৈশবের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৪৪ সালে আমার বয়স সাত। মাতৃভাষা কাতালানে কথা বলার সময় একজন পুলিশ আমার গালে চড় মারে। আমি প্রতি-উত্তরে তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেই। পুলিশটি চিৎকার করে ওঠে, ‘কুকুরের ভাষায় কথা বলো না। স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের ভাষায় কথা বলো (তা অবশ্যই স্প্যানিশ)। এ অপরাধে আমাকে বার্সেলোনার পুলিশ সদর দপ্তরে নেওয়া হয়েছিল।

সম্প্রতি, স্পেনের পার্লামেন্ট কাতালোনিয়ার জন্য নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছে। কাতালান ভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্পেনকে দ্বিভাষিক দেশ হিসেবে করা হয়েছে এতে। ভার্গাস য়োসা যে পার্টির সদস্য সেই পার্টি এই সংবিধানকে নাকচ করে দিয়েছে। কাতালান ভাষাকেই অস্বীকার করেছে। আর ভার্গাস য়োসা কাস্তিলিয়ান ভাষাকে কাতালোনিয়া জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ কারণে দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকা তাকে সমর্থন জানিয়ে প্রশংসা করে লেখে: ‘দেশের মধ্যে পেটি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন তিনি। ’ অথচ মাতৃভাষায় কথা বলার মতো মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, কিছু সংস্কৃতি আছে যেগুলো অন্য সংস্কৃতির ওপর আধিপত্যকারী। এভাবে স্প্যানিশের কাছে কাতালান দ্বিতীয় সারির ভাষা। লক্ষণীয়, আর তিনিই হচ্ছেন মানবাধিকারের মহান রক্ষক!

যেন এগুলো যথেষ্ট নয়, ভার্গাস য়োসা যুক্তরাষ্ট্রের টি পার্টির পক্ষে স্পেনের গণমাধ্যমগুলোতে লেখেন : ‘অনেক ভুলত্রুটি সত্ত্বেও এটা একটি সুস্থ স্বাধীনতাকামী আন্দোলন, যা গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক ও রাষ্ট্রবিরোধী। ’ য়োসা সব সময় অতিউদারনৈতিক পন্থার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে আসছেন। তিনি বড় অঙ্কের অর্থের স্বার্থের পক্ষ নিয়েছেন। এ কারণেই তিনি নিজেকে টি পার্টির রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম ভাবতে পারেন। এই হচ্ছে আমাদের নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভার্গাস য়োসা। স্বাধীনতার মহান রকের পরিচয়।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৬৪৬, নভেম্বর ২২, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।