ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লিবিডো : গত শতকের কবিতা

কামাল রাহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১০
লিবিডো : গত শতকের কবিতা

লিবিডো বিষয়ে লেখার শুরুতে স্বাভাবিকভাবে ফ্রয়েডের নাম এসে যায়, মানুষের সব কর্মকাণ্ডের পেছনে এই মনোবিকলন-শাস্ত্রগুরু প্রকাশ্য অথবা সুপ্ত যৌনচেতনার উপস্থিতি দেখেছেন। নিরেট যৌনচেতনা নয়, ‘লিবিডো’ শব্দটিকে তিনি ব্যপক অর্থে ব্যবহার করেন।

দেহের যেমন রয়েছে ক্ষুধা, সেভাবেই লিবিডো, শৈশবে এর শুরু, নিজের শরীরে জন্ম, এবং পরে বহির্বৃত্তীয়। জীবন ও মৃত্যুমুখী, পরস্পর দুই শক্তি কাজ করে মানুষের অর্ন্তজগতে। জীবনমুখী শক্তির বিকাশ দু ভাবে, আত্মরা ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে, মানুষের সকল কর্মকাণ্ড, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, অপত্য, সবকিছুর ভেতরই প্রচ্ছন্ন রয়েছে এ দুই প্রবৃত্তি। জীবনমুখী এই প্রবৃত্তি দুটোর পেছনের শক্তিকে ফ্রয়েড বলেছেন Eros (এরোস), এবং মানুষের মৃত্যুমুখী প্রবৃত্তি Thanatos (থ্যানাটোস), দুদিকে প্রবহমান এ শক্তি আত্মঘাতী ও পরঘাতী, উভয়ই হতে পারে। ফ্রয়েডের বিবেচনায় মানুষের জীবনমুখী শক্তি এরোসই লিবিডোর নিয়ন্তা, লিবিডো ও যৌনপ্রবৃত্তি প্রায় সমার্থক, ভালোবাসা অথবা আকর্ষণের মাধ্যমে এটার প্রকাশ। আত্মমুখী অথবা বহির্মুখী, দুরকমই হতে পারে লিবিডো। যখন আত্মমুখী, তখন এটাকে নার্সিসাস এষণা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। আবার এখানেই সীমিত থাকে না এটা, আত্মরামূলক প্রবৃত্তিও লিবিডো! এটা যখন পরমুখী, তখন উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি, মোটা দাগে এটুকু মেনে নেওয়া যায়। মনের উদ্দেশ্যসমূহের উৎসকে আবার তিন স্তরে বিভক্ত করেন ফ্রয়েড, Id (অডস), Ego (অহং) ও Superego (অধ্যহং)। অহং এবং অধ্যহং শক্তি সঞ্চয় করে অডস স্তর থেকে। ব্যক্তিত্বের নিগূঢ়তম স্তর এই অডস, এবং এরই অংশ বাস্তবতার নিরিখে অহং-এ পরিণত হয়। অহং শেষ পর্যন্ত অডস-এরই অংশ, অডস শব্দটি সম্ভবত নিৎসে থেকে গ্রহণ করেছেন ফ্রয়েড। অডস-এর শক্তিকেই তিনি বলেছেন লিবিডো বা কামপ্রেরণা। পৃথিবীর তাবৎ কবিতার উৎস এই কামপ্রেরণা! গত শতকের কিছু কবিতায় এই কামপ্রেরণা কবিমনের নিগূঢ়তম স্তরে কীভাবে কাজ করেছে দেখা যাক :

        স্নান করো বিম্ববতী-
              স্নান করো প্রাণের ধারায়
        শীতল সুতীক্ষ্ম প্রবাহের চাপ
        অঙ্গ থেকে ধুয়ে দিক অতনু-উত্তাপ।
        চতুরস্র নিতম্বের প্রতিস্পর্ধী কোমল ত্রিভুজ
        সাবিত্রী সহায় হয়ে
        যজ্ঞব্রতী চতুর্মুখ করুন রক্ষণ-
        সৃষ্টির রহস্য তীর্থ।

        জল ঢালো নিম্নোদরে ত্রিবলী-প্রাকারে-
        ক্রমশ উপরে ওঠো।
        নাভি ও নিতম্ব কূপে। শ্রোণীর ফলকে
        ঢালো পুণ্য জলধারা।
        ঊর্ধ্ব অঙ্গ ক্রমশ উদার- স্তব্ধ
        বাহুকূপ স্কন্ধ গ্রীবা পৃষ্ঠ বাক্ষেদেশ
        -সুবৃত্ত-যুগল
        চন্দ্রদেব সুরক্ষিত রাখুন সর্বদা।

আটাশি পঙক্তির দীর্ঘ কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলানো গেল, গত শতকের দ্বিতীয় দশকে পশ্চিমবঙ্গের নারী-কবিদের মধ্যে আধুনিক কবিতায় সম্ভবত উমা দেবীই প্রথম এমন সাহসী পঙক্তিমালা উচ্চারণ করেন! শুরু থেকেই এক আশ্চর্য আকর্ষণ রয়েছে কবিতাটির-

           স্নান করো বিম্ববতী
        এ দুপুর বড়ই নির্জন-
        এই ঘর নির্জন এখন।
        একে একে আবরণ উন্মোচন করো-
        শাড়ি সায়া চোলি ও পট্টিকা
        দূর করো অঙ্গ থেকে-
             স্নান করো বিম্ববতী।

এরপর শেষ পঙক্তি পর্যন্ত না পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বিরহী রাধার আকুলতায় আছে পেয়ে হারানোর বেদনায় মর্মরিত দীর্ঘশ্বাস, পুনঃপ্রাপ্তির বাসনা, ভালোবাসার সঙ্গে মিশে রয়েছে ভক্তি ও সমর্পণের নিখাদ আকুতি। ‘স্নান করো বিম্ববতী’তে সরাসরি আহ্বান নেই, কিন্তু প্রত্যাশার তীব্রতা আলোপিপাসী পতঙ্গের মতো পাঠককে কাছে টেনে নেয়। ফ্রয়েড-কথিত আত্মমুখী আকর্ষণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ এ কবিতা-

        নাসারন্ধ্র ভরে থাক অমর্ত্য সৌরভে
        অঞ্জলি অঞ্জলি
        জল ছুঁড়ে ছুঁড়ে সর্ব দাহকে জুড়াও।

        স্নান করো বিম্ববতী- স্নান করো।
        এ জৈষ্ঠ্যের অসহ্য-উত্তাপ দ্বিপ্রহরে
        স্নান করে জুড়াও হৃদয়।

চমৎকার এ কবিতাটি পাঠের পর ইচ্ছা জাগে তাঁর ‘গৌরীয় বৈষ্ণব রসের অলৌকিকত্ব’ কবিতাগ্রন্থটি পুরোপুরি উপভোগ করার।

কবি উমা দেবীর পর কবি দেবারতি মিত্রকে আরো একজন সাহসী কবি হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ‘ভূতেরা ও খুকী’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন দীর্ঘকাল। ঐ গ্রন্থের ‘ঝরণার সোনা’ কবিতার কিছুটা-

                 ঘোর কদমের মাসে
        তার সঙ্গে বিয়েভাঙ্গা স্কার্ফখোলা চটুল বত্রিশ
        গাড়ি ছাড়বার আগে লাফাতে লাফাতে যেন চাকা ছুটে আসে,
        মেয়েলি ঘাড়ের হাড়ে বেঁধে গিয়ে তুরপুনের মতো প্রজাপতি,
        জড়াজড়ি মুঠোভর্তি স্বাদুমাংস রান্নার আগুন,
        আঠায় মধুতে ঠোঁট স্ট্রবেরি জারানো দামী নুন।

        রুমাল নাচিয়ে বলে মহিলাটি, ‘চলো যাই, সিংহের কেশর ধরে
                            ঝাঁকিয়ে
                       আসিগে,                  
        ভবিষ্যৎ টাইগনের মতো হবে অথবা সফল। ’

সফল শিল্পকুশলতায় কবিতাটির ভেতর প্রবিষ্ট রয়েছে যৌনতা। ‘বিয়েভাঙ্গা চটুল বত্রিশ’, ‘সিংহের কেশর ধরে ঝাঁকানো’, ‘ভবিষ্যৎ টাইগনের মতো’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ গভীর ব্যঞ্জনাময় ইঙ্গিত বহন করে। সম্পূর্ণ কবিতাটি পাঠে ভিন্নমাত্রাও প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্তরের অভীপ্সার একটি উৎস অডস-এর কেন্দ্রে কবিতাটির অবস্থান, অডস-এর মধ্যে মূল্যবোধের অবস্থান নেই, সুখভোগই একমাত্র উদ্দেশ্য, এর মূলে রয়েছে দেহ! দেবারতির ভালো কবিতা এটি। এখানে আবেদন রয়েছে নিপুণভাবে, আরোপিত কিংবা লিবিডো-আক্রান্ত মনে হয় না, যৌনতা এসেছে শিল্পের স্বাভাবিক নৈপুণ্যে।

তীব্র আবেদন রয়েছে তাঁর ‘আমার পুতুল’ কবিতাগ্রন্থের ‘পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন’ কবিতায়-

        ক্রমে তার মুখে আসে
        ঈষদচ্ছ অনতিশীতোষ্ণ গলা মোম
        টুপটাপ মুখের গহ্বরে ঝরে পড়ে
        পেলিকান পাখিদের সদ্যোজাত ডিম ভেঙ্গে জমাট কুসুম নয়,
        একটু আঁশটে নোনতা স্নিগ্ধ সাদা জেলি।
        ভরে যায় আত্মা অবধি পর্ণপুট
        মাধ্যাকর্ষণহীন ফুটফুটে মোলায়েম
        হালকা জলন্তপ্রায় একরাশ বেলুনের ঝাঁক নিয়ে
        বিদেশী তারার খুব কাছাকাছি  ভেসে যেতে থাকে
        যেন  ডানা মেলে দেবদূত উড়ে যাবে
        এক্ষুণি বিছানাসুদ্ধ তাকে নিয়ে।

        মেয়েটির উচ্ছল তৃপ্ত ওষ্ঠাধর, দাঁত, দুচোখের পাতা
        চটচটে ঘন লাক্ষারস মাখামাখি,
        সজীব রঙিন শান্ত সুস্থ জানুসন্ধির মধ্যিখানে
        আস্তে আস্তে তার মুখমণ্ডল অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে
        পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী।

কবিতাটিকে কবি শামশের আনোয়ার বাংলা ভাষায় লেখা সর্বাধিক যৌন আবেদনের কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আমার কাছে বরং ‘স্নান করো বিম্ববতী’ কবিতাটিকেই অধিকতর আবেদনময় মনে হয়েছে, আত্মমুখী বিবেচনায়, পরমুখী প্রেরণায় শামসের সমর্থনীয়। দেবারতি মিত্রের সময়ও তাঁকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। মলয় রায় চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায় (হারাধন ধাড়া), এঁদের প্রতিষ্ঠিত হাংরি জেনারেশনের কৌতুকাশ্রয়ী যৌন অনুষঙ্গের গন্ধবাহী শব্দসমূহের উপস্থিতি সে সময় কবিতা অঙ্গনে তুমুল ঝড় তোলে। অবশ্য, যৌনগন্ধী শব্দ পূর্ব-দশকেই শক্তি, সুনীল, সন্দীপন এঁদের কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় ব্যাপকভাবে স্থান করে নিয়েছিল। কিন্তু হাংরি কবিকুল শব্দগুলোকে নিজেদের ইচ্ছায় অপ্রয়োজনেও ব্যবহৃত হতে দিয়েছেন, ফলে অনেক ক্ষেত্রে আরোপিত মনে হয়েছে। তাঁদের প্রচেষ্টা অনেকের কাছেই গিমিক বলে মনে হয়েছে।

কবি দেবারতি মিত্রের ঘরের কবি মণীন্দ্র গুপ্তও এক বিশাল প্রেরণা, অর্ধাঙ্গ অবশিষ্ট অর্ধাঙ্গ থেকে প্রভাবিত হবে, এইটেই স্বাভাবিক। বর্ষীয়ান কবি মণীন্দ্র গুপ্তর একটি কবিতা প্রসঙ্গ হতে পারে, ব্যতিক্রম আয়োজনে-

        জলে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ মদ্দা হাঁসটা মাদী হাঁসের
        গলা কামড়ে ধরে তার উপরে উঠে পড়ে।
        তার শরীরের নিচে মেয়ে হাঁসটা পাখা বিস্তার ক’রে
        রহস্যময় ছায়ার মতো ডুবে থাকে-
        আমি দেখতে পাই, সঙ্গীকে সুবিধে দিতে মেয়েটা
        জলের নিচে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
        কালিদাসের বিবৃতজঘনা মনে পড়ে।        
                         (গড়িয়া গ্রামের হাঁস)

ফ্রয়েডের যৌন-মনস্তাত্বিক অভিজ্ঞান- লিবিডোই মানব জীবনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, এটাই হচ্ছে মূল চালিকাশক্তি - এর প্রভাবে পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যে উত্থিত আলোড়ন বাংলা সাহিত্যের তিরিশোত্তর আধুনিক কালে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কালে ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের ব্যাপক প্রসার অনিবার্যভাবে আধুনিক বাংলা কবিতায় উদ্বেলিত হয়েছিল। কবিদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা ছিল ফ্রয়েডের ‘নির্জ্ঞান’ মন সম্পর্কিত ব্যাখ্যা। তাঁর মতে মানুষের মনের ক্ষুদ্রতর অংশ ‘চেতন’ মনের আড়ালে রয়েছে বৃহত্তর ‘নির্জ্ঞান’ মন। প্রকৃত অর্থে মানুষের অন্তর্জগত নিয়ন্ত্রণ করে এটা, এর উৎস যৌনপ্রবৃত্তি। অভিনব এই ধারণা চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনে। যৌনতা ধারণাটিকে ব্যাপক অর্থে সম্প্রসারিত করেন ফ্রয়েড। তাঁর মতে নরনারীর ভালোবাসার সহজাত সব প্রবৃত্তির সংহত ও মিলিত রূপই হচ্ছে লিবিডো বা কামপ্রবৃত্তি। এমন কি মানবপ্রেম, আত্মপ্রেম, বন্ধুত্ব, বাৎসল্য, অপত্য সবকিছুর পেছনেই রয়েছে লিবিডোর উপস্থিতি। নির্জ্ঞান যৌনচেতনার বাতাবরণে মানুষের মন আবেগে, সংরাগে বিচিত্র পথে বিভিন্ন মাত্রায় আবর্তিত ও বিকশিত হয়। মানুষের জৈবসত্তা ভোগপ্রবণতার অনুসারী। অন্যদিকে বাস্তব সত্তা ধাবিত হয় বাস্তবতার প্রতি। ফলে দ্বন্দ্ব জন্ম নেয় এ দুয়ের মধ্যে। আবার মানুষের নীতিবোধের আশ্রয়স্থল বিবেকেরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এসব কিছুর ওপর। এভাবেই লিবিডো-নিয়ন্ত্রিত হয় মানুষের সব কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। ফ্রয়েডের অনুসারী ইয়ুং লিবিডোর পরিসীমাকে অনন্ত বিস্তার প্রদান করেন। তাঁর মতে, কেবল যৌন আকাঙ্খার নয়, লিবিডো হলো মানুষের সব উদ্যোগের মূল শক্তি। হাংরি জেনারেশন এটাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করে। এঁদের কবিতায় টাটকা মাছের ফুলকোর আগ্রাসী রঙ, তাতানো মাংসের লোলুপ-তাপ প্রভৃতি, রগরগে শব্দ দিয়ে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে, সমসাময়িক অনেকে অতিচমকের আকর্ষণে ওসবে যুক্ত হয়ে পড়ে। এঁদের লেখালেখির পেছনে একটা যুক্তি দেখানো হতো : যৌনতার স্বাভাবিকতার সঙ্গে আত্মপ্রকাশের স্বাভাবিকত্বের সম্পর্ক রয়েছে, এবং একজন শিল্পীর রয়েছে আত্মপ্রকাশের অভীপ্সা, জীবন থেকে যদি যৌনতা পৃথক করা না যায়, লেখালেখিতে তা হবে কেন? এরা বুঝেও প্রকাশ করেননি যে জীবনে যৌনতার স্থান কিছুটা আড়ালে, অনেকটা গোপনে! গোপনে হয়তো একটা চিঠি লেখা যায়, কবিতা নয়, লেখালেখি হচ্ছে প্রকাশিত শিল্প, যৌনতা ও লিবিডো এক নয়! মন্দিরগাত্রে খোদিত চিত্রকর্মও যৌনতা প্রকাশের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল একসময়, সরাসরি অঙ্গ উপাসনার সূত্রপাতও হয়েছিল অনেক কটা ধর্মে, উপাসনালয়ের গঠনরীতিতেও রয়েছে যৌনতা, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ওসবের। স্বাভাবিকভাবে যা আসে তা খাঁটি, আরোপ করতে গেলে দেখা দেয় সমস্যা, ওটাকে তখন শিল্পের আবেদন ধরে নেয়া যায় না, নিছক যৌনতা অথবা লিবিডো-আক্রান্ত হিসেবে তা চিহ্নিত হয়। ঐ দশকেরই কবি রমা ঘোষ, তাঁর সমুদ্র ভ্রমণ কবিতার শেষাংশ-
        
        তোমার শরীর ঘিরে বৃষ্টিধারা আমি একা কিছুদিন যদি ভোগ করি
        উচ্ছন্নে গেছি বলে কেউ যদি কুকথা রটায়
        আমি তা নীরবে শুনে সমুদ্র পাখির
        পালক কুড়িয়ে নিয়ে মাথায় সাজাবো,
        যাবো না এখন আমি এই পুণ্য মাতৃভূমি পৃথিবী পেরিয়ে
        শুধু কিছুদিন যাবো শাওন তোমার সঙ্গে সমুদ্র ভ্রমণে।

        আজ রাতে ছাদে শুয়ে সমুদ্র ভ্রমণে যাবো শাওনের ঘরে।

শিল্পসফল এ কবিতাটি প্রকট যৌনগন্ধী মনে হয় না, অথচ হৃদয়কে টানে, ব্যাকুলভাবে! শুরু থেকেই পাঠক উপলব্ধি করেন এর সুষমিত লাবণ্য। লিবিডোর বিকশিত স্তরে মানবমন এরকমই কল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে।

ষাটের সোচ্চার আন্দোলনের রেশ না মিলাতেই পশ্চিমবঙ্গের কবিতায় সত্তরের তুমুল উত্থান, নারী-কবিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। সত্তরে এসে কবিকুল লিবিডো বিষয়ে কুশলী হয়ে ওঠেন, এ দশকের কবিতায় এক ধরনের কাঠিন্যও প্রকাশ পায়, শিক্ষিত নাগরিক চেতনা-সঞ্জাত কবিতার পাশাপাশি স্লোগানমুখর কবিতাও উপচে পড়ে, একদিকে দুর্বোধ্য কাঠিন্য, অন্যদিকে মেধাহীন কবিতার ছড়াছড়ি অনেকটা দূরে ঠেলে দেয় পাঠককে। শুরুতেই নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঢেউ পশ্চিমবাংলার কবিদের ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে। দুর্বল রুচির, অনেকাংশে শালীনতা-বর্জিত আত্মপ্রচারসর্বস্ব কবিতা, যেগুলিকে ঘুরিয়ে আত্মজৈবনিক বলে চালানোর প্রচেষ্টাও লক্ষিত হয়। যে সমাজের জন্য কবিতা রচিত হয়েছে, তা ছিল প্রবলভাবে বাত্যাতাড়িত, ক্ষুব্ধ, অত্যাচারিত। সে সময় যৌনতা-নির্ভর কবিতা কবিদের মনোজগতের দুর্বলতা বা মনোবৈকল্যের পরিচয় দেয়। দু দশক আগের একজন পরিণত কবিও অবলীলায় চরম হতাশাগ্রস্ত পঙক্তি রচনা করেন। নবনীতা দেবসেন ‘হাজার বছর ধরে একজোড়া যুবক-যুবতী’ কবিতায় লেখেন-

পৃথিবীতে অন্তর্বাস খোলার মতন
        কোন রাত্রি নেই। পৃথিবীর মুখের ওপরে
        ঠাস করে বন্ধ করে খিল তুলে দেবো,
        সেরকম কোন দরজা নেই।

অন্তর্যাতনা কিংবা হতাশা কবিতাটির মূল সুর। সত্তরের আরো এক কবি অনুরাধা মহাপাত্রের কবিতায়ও দেখা যায় প্রায় এ ধরনেরই হতাশা-করুণ পঙক্তি-

        সঙ্গমে ভিন্ন কোন আলো নেই- প্রকৃতি অথবা ঈশ্বরের
        উপবাস ও পূজার কোন চিদাকাশ নেই
        আত্মত্যাগ, আত্মহত্যা উভয়ই সমান
প্রেমিকের মাথা আকাশে তুললেও তবু মুখ,
        নেমে আসে অন্ধ পুকুরে
    চারিদিকে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ি- যৌনতা ও সিমেন্টের
        মৃত রসায়ন

দ্বৈততা কবিমনের ভেতর; যৌনচেতনা ও অহং এক কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে; জীবন্ত সকল সত্তাকে ধরে রাখার প্রয়াস! ‘প্রেমিকের মাথা আকাশে তুললেও তবু মুখ,/নেমে আসে অন্ধ পুকুরে’, এখানেই লিবিডো! স্নেহলতা চট্টোপাধ্যায়ের ‘আজ বৃষ্টিতে’ কবিতার অংশ-
        
        দুজনে মৌন, মুখর দুচোখে দাবী,
        আলোক-পীড়িত এখনো শয্যাখানি
        কেন উদাসীন গৌরবে দেরী কর?

        আমার প্রদীপ যত্বে নেভাও তুমি

যৌনগন্ধী কোনো শব্দ নেই, অথচ আশ্চর্য মধুর আহ্বান রয়েছে পঙক্তিগুলোয়! এখানে পৌঁছে কবিতা ভিন্ন রূপ নেওয়া শুরু করে, সত্তর-পরবর্তী কবিগণ লিবিডো বিষয়ে অনেকটা সচেতন হয়ে ওঠেন। আশি-নব্বুই দশকে কবিগণ আরো ইঙ্গিতধর্মী হয়ে ওঠেন। কাব্যগন্ধী শব্দের পরিবর্তে চাতুর্যময় অভিনব শব্দ চয়ন তাঁদের কবিতাকে রহস্যময়তার আড়ালে নিয়ে যায়। চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবিতার জন্ম’-

ট্রামলাইনের পাত বরাবর জ্বলছে নিভছে সাদা ভালোবাসা
        ধুয়ে মুছে চাঁদ জ্যোৎস্না-প্রপাত ভাসিয়ে দিয়েছে কে ছোটো কে বড়
        
        মাটির মেঝেয় গণ্ডী কেটো না আল্পনা আঁকো আমাকে শোওয়াও
        তিথি ও তারারা স্বাগত জানাক স্রোত বয়ে যাক অনাবিল স্রোত

লিবিডো বিষয়ে ভিন্নদৃষ্টি রয়েছে এমন তাত্ত্বিকদের মধ্যে ‘নব্যফ্রয়েডীয়’ এডলার, র‌্যাংক, হর্নি, সুলিভান, ফ্রম প্রমুখ ফ্রয়েডের লিবিডো তত্ত্ব অনেকাংশে প্রত্যাখ্যান করেন। অন্তর্জগতের কাঠামোয় আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের গুরুত্ব প্রাধান্য পেয়েছে তাঁদের কাছে, যেখানে ফ্রয়েডীয় মূল তত্ত্বে আত্মউপলব্ধিকে ধরা হয় লিবিডোর প্রাথমিক চালিকাশক্তি। আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কের খোঁজে ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি সম্পূর্ণ কবিতা-

        কে    কতখানি নেমেছে জলে,
        কে    করবে তার সত্য নির্ণয়!
        কে    করেছে স্নান, কে ছুড়েছে ঢিল!

       কে    ডেকেছে মূলত অন্ধকার,
       কে    পূর্ণিমাতে সারারাত,
       কে    জানে এর সত্য ইতিহাস!

        কে    দিয়েছে লজ্জাহীন গোপন প্রস্তাব!
        কে    ছুঁড়েছে হাসি উপেক্ষায়!

আশির দশকের কবি রূপা দাশগুপ্তের ‘ক্রীড়াকাল’ কবিতার শেষাংশ-
            
                   ভাবো কি এতই বোকা, এত কৃশ, গূঢ় চালিয়াতি
        বরাবর হেসে হেসে ছাড় পাবে যুবতীর কাছে
        কি চাই, কখন চাই, চাই কার মুখ
        হৃৎ দোলাচল
        শরীরে ফ্রিকিক ও সুরায় গোলপোস্ট রেখে
        নিছক ভ্রমণ।

ফ্রয়েডীয় লিবিডো তত্ত্ব একদিকে পরিবর্তনকামী, পিচ্ছিল, ভোল-পাল্টানো স্বভাবের, অপরদিকে যৌনচেতনানির্ভর স্বজ্ঞার ভেতর অনুপ্রবিষ্ট, অনেকটা একপেশে। ইয়ুংও একইরকমভাবে স্বজ্ঞানির্ভর শক্তি হিসেবে এটাকে সাধারণীকৃত করেছেন। বর্তমান সময়ের অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন ফ্রয়েড লিবিডো ধারণাটিকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের চালিকাশক্তি হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, বিপরীতে সমাজের চালিকাশক্তিগুলোকে যথাযথভাবে বিবেচনায় আনেননি। লিবিডো তত্ত্ব ক্রমাগতভাবে বিবেচিত পুনর্বিবেচিত হচ্ছে মূলত তিনটি দিক থেকে, অধিমনোবিকলনগত, উন্নয়নগত ও চিত্তবিকারবিদ্যাগত, এবং কখনো সব মিলিয়ে। সমাজচালিকাশক্তি কীভাবে লিবিডো প্রকাশ করে, কবিমনে এর প্রভাব কেমন, নারীবাদী কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের একটি অন্যরকম কবিতার দুটি স্তবকে দেখা যাক-

আমার তের বছরে এক কাঠখণ্ডে বেঁধে
ঝুলিয়ে দিয়েছিল মালিক হাটের মাঝখানে
চাবুক মাছে খোঁচালো, গায়ে কাপড় থাকলো না
কানকো তুলে ওরা আমার রক্ত দেখে নিল

লজ্জা নেই আমার ভয় থাকতে নেই জানি
যে মাছ আজ চাবুক তার নিবাস কালজানি।

নব্বইয়ের শেষদিকে এরকম কবিতা বরং কিছুটা কমই লেখা হয়েছে, কবিরা এসময়ে আরো রহস্যনিবিড় হয়ে ওঠেন, তাঁদের কবিতায় যৌন অনুষঙ্গগুলো ইঙ্গিতময় হয়ে যায়, পাঠকের প্রত্যাশাও বেড়ে যায় অনেক, বিপরীতে শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা কমে যেতে থাকে, পুঁজিবাদী অবক্ষয়ে কবিদের অন্তর্জগতও অত থাকে না। আন্তর্জালের বিস্তার কবি ও পাঠককে একাধারে নিঃসঙ্গ ও অস্থির করে তোলে। শবরী ঘোষের ‘পুরুষ-কিম্পুরুষ’ কবিতার কিছু অংশ-
        
এক্ষুণি একজন পুরুষ চাই আমার
        রাত্রি যেভাবে সূর্যের সঙ্গে মেলে
        সেরকম সম্পূর্ণ মিলনের জন্য চাই
        . . . . . . . . . . . . . . . . . . .
        তবু প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত
        ঠিক নিরানব্বই জন হিজড়ের সঙ্গেই শুধু
        ঘুরে ফিরে দেখা হয়ে যায় আমার !
        . . . . . . . . . . . . . . . . .
        হায় হিজড়েরা সঙ্গম জানে না।

        এখনই একজন যথার্থ পুরুষ চাই আমার
        আমি তো প্রস্তুত হয়েই রয়েছি !

বাংলাদেশের নারী-কবিদের কবিতায় লিবিডোর উপস্থিতি অনুসন্ধানের বিষয়! তসলিমা নাসরিনের একটি কবিতার কিছু অংশ (এটা হয়তো নিষিদ্ধ নয়!), হতে পারে, এখানেই শুরু!

        আমার বর্ষার জলে
        শরীরে বর্ষাতি নিয়ে অনার্য পুরুষ তুমি
        চতুর ডুবুরী হও, যতো হও জলজ শরীর
        এতোটুকু তবু তোমাকে ছোঁবে না জল।

        আমাতে প্রোথিত হও, সঠিক নিমগ্ন হও
        বিবর্ণ খোলস খুলে ফেলে
        আমার আগুনে আজ শরীর তাপাও।

বাংলাদেশ স্থানীয় সময় ১৮৪০, নভেম্বর ১৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।