ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

সপ্তজিজ্ঞাসে—

কবি মেহেরুবা নিশা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১২
কবি মেহেরুবা নিশা

(কবিতাসংশ্লিষ্ট সাতটি নির্ধারিত প্রশ্ন নিয়ে ‘সপ্তজিজ্ঞাস’ নামের এ আয়োজন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের পক্ষ থেকে তানিম কবিরের করা প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন কবি মেহেরুবা নিশা...)

কবিতা কেন লিখেন— একজন কবি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য কি না? যদি বাধ্য নন— তো কেন? আর হোন যদি— আপনার প্রতিও একই প্রশ্ন; কেন লেখেন কবিতা?

নিজেকেই আমি প্রশ্নটা প্রায়ই করি।

আমার মনে হয়, একজন কবির কবিতা লেখা ছাড়া, সত্য-সুন্দরের রুচিশীল চর্চা ছাড়া, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের শৈল্পিক প্রচেষ্টা ছাড়া আর কোনও কিছুতেই বাধ্য থাকা উচিৎ নয়। এতে কবিত্বের স্বতঃস্ফূর্ততাই বাধাপ্রাপ্ত হয়। তবে কোনও বাধ্যবাধকতা ছাড়া এইটুকু বলতে পারি— আমার ব্যক্ত-অব্যক্ত আবেগই মূলত আমার কবিতা। আমার করা না-করা মূর্ত কর্মগুলোরই এক অনিবার্য বিমূর্ত প্রকাশই শেষপর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠতে চায়।

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— এই ‘কেউ কেউ’ বা ‘কারও কারও’ কবি হয়ে ওঠায় ঐশীপ্রাপ্তির কোনও ঘটনা থাকে কি? নাকি পুরো ব্যাপারটাই রেওয়াজ নির্ভর? আপনার কী মনে হয়?

কবিতার ব্যাপারে যার সহজাত বোধ আছে— যথাযথ পরিচর্যা, পরিশ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে সে-ই শেষপর্যন্ত কবি হয়ে উঠতে পারে। এই সহজাত বোধটাকেই কেউ কেউ ঐশীপ্রাপ্তি বলে বিবেচনা করতে চায়।   যেমন— কেউ গান না শিখেও ভালো গাইতে পারেন, যদি তার থাকে গান গাওয়ার মতো সাবলীল কণ্ঠ (অনেকে যাকে বলেন ঈশ্বরপ্রদত্ত), সহজাত সুর ও তালজ্ঞান। এরপর যথাযথ অনুশীলন আর রেওয়াজের মধ্য দিয়ে তিনি তার এই সহজাত গুণগুলোকে আরো শাণিত করেন— পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে ওঠেন। কবিতার ব্যাপারেও ঠিক তাই। যার ভেতরে কবিত্ব আছে, কাব্যশিল্প বোঝার মতো সহজাত বোধ আছে, তিনিই কিন্তু যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত কবি হয়ে ওঠেন। আর ব্যাপারটা যদি শুধু রেওয়াজ নির্ভর হতো, তাহলে আর ’কেউ কেউ কবি’ হয়ে উঠতেন না। শুধুমাত্র অনুশীলনে ’সকলেই কবি’ হতে পারতেন।

এখনকার কবিদের ছন্দবিমুখতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু? কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তারে ছন্দ আপনার কাছে সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক?

একটি কবিতায় ছন্দের চেয়েও কাব্যগুণ আর কাব্যরস থাকাটাই বেশি জরুরি। কেউ যদি টানাগদ্যে একটি ভালো কবিতা লিখেন, দেখা যায় সেই গদ্যেরও একটা ছন্দ আছে। তাকে যদি অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্তের মতো কোনও নির্দিষ্ট ছন্দে নাও ফেলা যায়, তবু বেশ একটা দোলা এবং মজা নিয়ে কবিতাটি পড়া যাবে। এই যে দোলা, যেটা পড়তে গিয়ে সহজাতভাবে আসে— সেটাই তো কবিতার ছন্দ। আমার মনে হয় প্রত্যেক কবি বা কবিত্বশক্তির অধিকারী মানুষের ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছন্দ খেলা করে। আর ছন্দ নিয়ে নানারকম খেলা এবং পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে চাইলে ছন্দের মূল বেসটা জানা থাকা জরুরি।

আমার মনে হয় শ্রমবিমুখতা ছন্দবিমুখতার একটা কারণ হতে পারে। পরিশ্রম না করেই শর্টকাটে কবি হতে গিয়ে আমাদের মাঝে অনেকেই ছন্দবিমুখ হয়ে পড়েন।
 
দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের প্রবণতাটিকে কিভাবে দেখেন? আপনার দশকের অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে নিজের কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উপাদানসমূহ কী বলে মনে হয় আপনার?

মূল্যায়নের জন্য নয়— আমাদেরকে দশকের দারস্থ হতে হয় শুধুমাত্র কিছু তথ্য গ্রহণের জন্য। তাই দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের ব্যপারটাকে আমি পুরোপুরি এভয়েড করি না। একটা নির্দিষ্ট দশকে কারা কবিতা লিখেছেন বা লিখছেন এটা যেমন সহজে জানা যায়, তেমনি কে বা কারা সর্বকালের কবি হয়ে উঠেছেন তা-ও সহজে বের করা সম্ভব হয়।   আমরা জীবনানন্দকে জানি কোনও দশকওয়ারী কবি হিসেবে নয়— বরং তার কাব্যগুণ তাকে তার সময়ের উর্ধ্বে নিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি কোন সময়ের কবি, সেসময়ে আরো কারা লিখেছেন, কারা বড় কবি হয়েছেন, কারা হয়েছেন গৌণ— এই ব্যপারগুলো জানতে কিন্তু আমাদের একটা নির্দিষ্ট দশকেই চোখ ফেলতে হয়। তবে যিনি কবি— তিনি কবিই। সময়ের উর্ধ্বে— সর্বকালের। তাকে নির্দিষ্ট কোনও দশকে ফেলে মূল্যায়ন করার দরকার নেই।
 
আমি লিখি আমার ভেতরের একাধিক সত্তা আবিষ্কারের নিরন্তর প্রচেষ্টায়। লিখি কল্পনা ও বাস্তবতার যৌথ উপাদানে গড়া আমার নিজস্ব জগতের কিছু চিত্র, দর্শন এবং বিশ্বাস থেকে। আমার কাজ শুধুই লেখা। আর লেখাটা নানাভাবে মূল্যায়ন করবে পাঠক। তাই আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটির জবাব তাদের কাছে চাওয়াই ভালো, যারা আমার এবং আমার দশকের অন্যান্য কবির কবিতা পড়েছেন।

তিরিশের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত— প্রত্যেকটি দশক থেকে যদি তিনজনের নাম করতে বলা হয় আপনাকে— কারা আসবেন? উল্লিখিত কালখণ্ডে কোন দশকটিকে আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

আপনার এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গেলে কিছু সমস্যায় পড়ে যাবো। কারণ কোনও কোনও দশক এতো বেশি উজ্জ্বল যে, সেখান থেকে তিনের অধিক নাম চলে আসবে। আবার কোনও কোনও দশক থেকে তিনজনের নাম খুঁজে পাওয়াটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তার চেয়ে বরং আমি তিরিশের দশক থেকে সাম্প্রতিকতম দশক পর্যন্ত বেশ ক’জন কবির নাম উল্লেখ করতে পারি, যাদের কবিতা বিভিন্নসময় বিভিন্নভাবে আমাকে টেনেছে।

স্বীকার করতে বাধা নেই, আমার কাব্যপ্রীতির শুরুটা ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম আর জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে (দশক থেকে দূরে রেখে)। ভালো লাগার তালিকায় আরো এসেছেন অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবু হাসান শাহরিয়ার, মাসুদ খান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মজনু শাহ, কামরুজ্জামান কামু, টোকন ঠাকুর, রহমান হেনরী, শামীম রেজা, সোহেল হাসান গালিব, তারিক টুকু।
 
সাম্প্রতিকতম দশকের কবিদের নাম উল্লেখ করতে গেলে আমার দীনতাটুকু প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। কারণ এখনো অনেক কবিতা পড়া বাকি থাকায় হয়তো অনেক ভালো কবির নাম অনুল্লেখ থাকবে। তবে খুব সহজেই যাদের নাম আমি বলতে পারি তাদের মধ্যে হিজল জোবায়ের, আল-ইমরান সিদ্দিকী, সালেহীন শিপ্রা, তানিম কবির, রুদ্র হক আর রওশন আরা মুক্তা আছেন আমার পছন্দের তালিকায়।    

দেশভাগোত্তর দুই বাংলার কবিতায় মৌলিক কোনও পার্থক্য রচিত হয়েছে কি? এ-বাংলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন। ওপার বাংলায়ও নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন— এসমস্ত কিছুর আলাদা আলাদা প্রভাব কবিতায় কতোটা পড়েছে বলে মনে করেন?

প্রতিটি দেশের সাহিত্যেই সেই দেশ এবং কালের রাজনৈতিক পটভূমিকাকে উপজীব্য হতে দেখা যায়। তবে কবিতায় এই প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু যখন রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আসে, কোনও আন্দোলন ঘটে, তখন কবিতায় এর প্রভাবও স্বতঃস্ফূর্তভাবে পড়ে। যেমন ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের পটূমিকায় বাংলাদেশে রচিত হয়েছে বেশকিছু কালজয়ী কবিতা। কিন্তু তা ওপার বাংলার নকশালবাড়ি আন্দোলনের মতো এতটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বলেই আমার ধারণা। এই প্রভাব কতটা ইতিবাচক, কতটা নেতিবাচক সেই আলোচনায় না গিয়ে বরং এটুকু বলতে পারি— বড় বড় কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন দুই বাংলার কবিতাকে দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করেছে।

কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলুন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিৎ? বর্তমানে বাংলা কবিতার পাঠক কারা?

একটি গাছের সবগুলো ফুলতো আর একইরকম ভঙ্গিমায় ফুটে থাকে না। আবার একইরকম ভঙ্গিমা সবার কাছে একইরকমভাবে আকর্ষক হয় না। এখন সবার কাছে সমানভাবে চিত্তাকর্ষক হবার জন্য ফুলগুলো তো তাদের ফুটে থাকার ভঙ্গিমা বদলে ফেলবে না! কবিতা এবং পাঠকের রুচির ব্যাপারটাও এমনই। কোনও অবস্থাতেই পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবি কবিতা লিখবেন না। আপোষ শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন  একটা দুর্নীতির গন্ধ মিশে থাকে। একজন কবি কোনও অবস্থাতেই তার কবিতার সাথে দুর্নীতি করতে পারেন না।  

কবিতা তো কোনও সুন্দরী নারী বা সুদর্শন পুরুষ নয়— যে চোখের দেখাতেই ভালো লেগে যাবে। কবিতা ব্যক্তিত্ব বা পারসোনালিটির মতই দূর্বোধ্য। খুব সহজে এর সৌন্দর্য় বা রহস্য ভেদ করা যায় না। একে হৃদয়োঙ্গম করতে হলে দরকার শিল্পবোধ সম্পন্ন মস্তিস্ক।

আমার মনে হয়, বর্তমানে বাংলা কবিতার পাঠক মূলত কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক। এছাড়া শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত কিছু উন্নত রুচি এবং শিল্পবোধ সম্পন্ন মানুষও কবিতা পড়েন— কখনো ভালো লাগা থেকে, কখনো বা প্রযোজনে।  

। ।
মেহেরুবা নিশা
জন্ম : ২৯ জুলাই, ১৯৮৮
জন্মস্থান : ভৈরব
প্রকাশিত গ্রন্থ : মনের রঙিন স্বপ্নগুলো (কিশোর কবিতা), নামটি পাখির টুনটুনি (ছড়া), চিচিং চিচিং ফাঁক (ছড়া), মেঘের পুতুল (শিশুতোষ গল্প), কালো বাঁশি (কিশোর গল্প)
। ।

বাংলাদেশ সময় : ১৪৫০ ঘণ্টা, ২২ নভেম্বর ২০১২
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad