ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

নায়মা পারভীন-এর নিবন্ধ

জীবনানন্দ দাশের গল্পে নিঃসঙ্গচেতনা

নায়মা পারভীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১২
জীবনানন্দ দাশের গল্পে নিঃসঙ্গচেতনা

“The sad truth is that we remain necessarily strangers to ourselves, we don’t understand our own substance, we must mistake ourselves; the axiom, ‘Each man is farthest from himself,’ will hold for us to all eternity. Of ourselves we are not ‘knowers’…”
— Friedrich Nietzsche, The Genealogy of Morals

নীৎশের সূত্র ধরেই বলা যায়, মানুষের নিঃসঙ্গতা জন্মসূত্রেই প্রাপ্ত। মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ আর নিঃসঙ্গচেতনার ইতিহাস আজকের নয়।

সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে এই বোধ জাগ্রত হয়েছে সচেতন, স্বশিক্ষিত মানুষের মননে। কারণ সমাজ ব্যবস্থা যতই ভারসাম্যপূর্ণ অথবা বৈষম্যহীনই হোক না কেন, মানুষ অতৃপ্ত হবার মতো এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে এই পৃথিবীতে।

তাছাড়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯) ইউরোপীয় সমাজ-ব্যবস্থায় যে ভাঙনের সৃষ্টি করেছে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশে এই যুদ্ধের প্রভাব ছিল আশঙ্কাজনক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বাঙালি জীবনের অনিশ্চয়তার প্রধান কারণ ছিল বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার তীব্র প্রভাব। এই মন্দার ফলেই বেকার সমস্যা, শ্রমিক অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করেছিল।

সমকালের এই সমাজবাস্তবতা, বিচিত্র নৈরাজ্য  ও বিকারগ্রস্ততাকে উদঘাটন করেই আধুনিক সাহিত্যিকের দায়িত্ব  শেষ হয়ে যায় না। মানুষের অস্তিত্বের যে স্তরগুলি থাকে অপরিচয়ের ধুপছায়ায় প্রচ্ছন্ন, আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে তার উন্মোচনও জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে চেতন ও আবচেতনের ঐকতানে জীবনের সামগ্রিক স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াসে জীবনানন্দ দাশের (১৮৯৯-১৯৫৪) অধিকাংশ ছোটগল্পগুলো রচিত। গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে ফুটে উঠেছে হতাশা, নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতার তীব্র আখ্যান। তাঁর গল্পগুলিতে লক্ষ করা যায়:
১. অর্থনৈতিক সংকট বা আমৃত্যু পিষ্টজনিত হতাশা।
২. যৌনকামনা, সুস্থ-স্বাভাবিক ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা ও পরিণামে ব্যর্থতাজনিত নৈরাশ্য।
৩. প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ফলে আত্মিক জগতের বিপর্যয়হেতু নিঃসঙ্গতা।
৪. ব্যক্তি জীবনানন্দের প্রকাশ।
৫. দাম্পত্য বিচ্ছিন্নতা।
৬. পুঁজিবাদী সমাজ অবক্ষয়ে পারিবারিক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

জীবনানন্দ দাশের গল্পে অর্থনৈতিক সংকট হলো শিক্ষিত সংবেদনশীল মধ্যবিত্তের সংকট। লেখক মনীশ ঘটক থেকে শুরু করে জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প উপন্যাসে সর্বশ্রেণির মানুষের যে বিপুল কোলাহল লক্ষণীয়। জীবনানন্দ দাশের গল্প, উপন্যাস -সেই বিপুল ও বিচিত্র কোলাহল থেকে সরে এসে একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে গোনা কয়টি চরিত্রের মধ্যে ঘুরপাঁক খায়।

বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্বের সমকাল কুৎসিত দারিদ্রের কাল। এই পর্বের রাজনৈতিক সচেতনতা ও উত্তালতার সঙ্গে ঠিক বিপরীতধর্মী সমশক্তিতে সমাজ ও অর্থনীতির অধঃপতন ঘটে। ১৯২৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ব পরবর্তী বিশ্ববাজারে মন্দা যাওয়ায় ঘটে মুদ্রাস্ফীতি আর বেকারত্ব। অন্যদিকে রক্তাক্ত সংঘাতে লিপ্ত সৃষ্টিশীল জীবনচর্চা ও স্বাভাবিক যৌনাকাঙ্ক্ষা তথা- প্রেম, প্রকৃতি ও বিশুদ্ধ মননকল্পনার মধ্যে বেঁচে থাকার ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষা ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ নামক গল্পের নায়ক সোমেন এই দ্বৈতসত্তার দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত।

‘সোমেন জীবন ব্যবসায়ের প্রতি অবিশ্বাসী-জীবনকে চায় শুধু, খড়ের মতন কঠিন, চোখা-বিচারবোধটাকে কল্পনার রেশমি কাপড়ের জাল জড়িয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে, ভালোবেসে নয়। ’

অন্যদিকে রয়েছে প্রকৃতিপ্রেম ও নারীপ্রেম। সুমিতা চক্রবর্তী বলেছেন:

‘আলবেয়ার ক্যামু তাঁর নৈরাশ্য-পীড়াকে উপস্থিত করেছেন উপন্যাসে। কাফকার লেখায় আত্মযন্ত্রণা পৌঁছেছে অসুস্থতার পর্যায়ে, সার্ত্রের রচনায়ও প্রকটিত হয়েছে অস্তিত্বের অর্থহীনতা, ভার্জিনিয়া উলফের রচনায় অনুভব করা যায় মৃত্যুবোধস্পর্শী এক ঔদাস্য, যে-অর্থে এ লেখাগুলি স্ব-স্ব স্রষ্টার আত্মদর্পন, জীবনানন্দ দাশের গল্পগুলিও সেই অর্থে এঁদের সমগোত্রীয়, বোধের নিকটবর্তী অর্থাৎ অস্তিত্ববাদী। ’

অন্যদিকে দেহাতীত কোনো প্রেম আধুনিক মানুষের অচিন্তনীয়। শরীরের সীমানার মধ্যেই প্রেমের সার্থকতা, তাকে উত্তীর্ণ হয়ে নয়। প্রেমের বোধকে শরীরনিষিক্ত করেই একটি সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে আবিষ্কার করতে উন্মুখ। কিন্তু তিনি জানেন যে, ‘ইচ্ছা কার কবে কতদূর পূর্ণ হয়েছে এ পৃথিবীতে?’

জীবনের ব্যবস্থাটাই এরকম যে, যে-সব জিনিস খুব সুন্দর-অন্ধকারের ওপর আলোর রেখা বুলিয়ে দেয়, মৃত্যুকে দেয় অমৃতে ঢেকে, সে সব জিনিস আমাদের পরস্পরের বিচ্ছিন্ন, থাকে একাকী অবসন্ন মনের স্বপন হয়ে। সুতরাং শরীরের চাওয়া আর মনের চাওয়া এ দুইয়ের একটি সুন্দর মিলন জীবনানন্দের গল্পে কখনোই ঘটেনি।

দুইটি সত্তার এই যে হরপার্বতী মিলনে ব্যত্যয়। তার মধ্যেই নিহিত থাকে জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসের মানুষের গভীর সংক্ষুব্ধতা, এ থেকে জাত ব্যক্তিগত নৈরাশ্য।

‘আমাকে ভালোবাসেনি কোনোদিন। আজকাল ঘোমটা টেনে সরে যাচ্ছে, পালাবার পথ খুঁজে হয়রান। কী-যে ভয়! কত বড় ঘেন্না। ’ (নায়ক/ছায়ানট)

কেননা ‘ছায়ানট’ এর নায়িকা রেবার কাছে সুস্থ-স্বাভাবিক প্রেমের কোনো মূল্য নেই, তরুণ, সুবেশ ধনী ডাক্তারই তার কাম্য। রেবা ডাক্তারের সঙ্গে ভালোবাসাহীন যৌনতায় মিলিত হয় নায়ক তা টের পায়। কিন্তু এই মিলনের মধ্যে নায়ক যে সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছে তা সম্পূর্ণরূপে জৈবিক সৌন্দর্য-সমাজবন্ধনের বাইরে ইন্দ্রিয়জ মনকে মুক্তি দিয়ে মনমতো শরীর তৃপ্তির সুখ স্পর্শে যে সৌন্দর্য ফুটে উঠে প্রাণীজগতে- এ সেই সৌন্দর্য।
 
জীবনানন্দ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় নারীকে সংসারে এমনই দেখেছিলেন। ফলে এ-তাবৎকালে নারীকে স্নেহময়ী ও প্রেমময়ী করে দেখবার যে প্রবণতা ভারতীয় মানসিকতায় প্রধান- জীবনানন্দ তা থেকে ব্যতিক্রম। এ ব্যতিক্রমের কারণ মূলত লেখকের দাম্পত্য জীবনে অনীহা, ভলোবাসা শূন্যতা। ফলে লেখকের অভিজ্ঞতার প্রকাশ যেমন ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে লক্ষ করা গিয়েছে। তেমনি ‘ছায়ানট’ গল্পে-‘ডাক্তার চলে গেলে রেবা নায়কের ওপর গড়িয়ে পড়ল একেবারে। কুণ্ঠা, লজ্জা, ভয়, ঘেন্না-সমস্ত উৎরে অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে সে যেন। সেই বড় নির্ভর- বাসি মড়াটার ওপরেই। ’

জীবনানন্দ দাশের গল্পে যৌনতা মিশ্রিত  প্রেমের ব্যর্থতার দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে দাম্পত্য জীবন। যার শতকরা পঁচানব্বই জন দম্পতিই সামাজিক ও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদন ও পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে যায় কিন্তু শরীর ও হৃদয়ের পথে পরস্পরের মিলন হয় কমই। দ্বন্দ্ব তাই তাদের অনিবার্য। এই অমিলের পরিণামে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার স্বাধীনতা রাখে। যার ফল সীমাহীন নিঃসঙ্গতা। যা জীবনানন্দ দাশের গল্পে স্পষ্ট- ‘মেয়েমানুষ’ গল্পে হেমেনের অভিব্যক্তি- ‘জীবনে প্রেম হলো না, প্রণয় হলো না, ছেনালি অব্দি হলো না। একজন পরের স্ত্রীকে আটকে রেখে মোকদ্দমায় যদি সে পড়তো তাহলেও যেনো একটা ক্ষোভ মিটতো। এখন যেন রক্ত মাংস বিবেচনা বুদ্ধি বিবেক সমস্তই কামড়াচ্ছে তাকে হালু হালু করে কামড়াচ্ছে। ’

হেমেন মনে করে এই ব্যর্থতার মূলে রয়েছে তার বিশ্রী চেহারা। এখানেও জীবনানন্দের আমিত্বেরই প্রকাশ। তাঁর অসুন্দর চেহারার জন্য লাবণ্যদাশ তাঁকে পছন্দ করতো না। এমনকি এ বিশ্রি চেহারার কথা জীবনানন্দকে মনে করিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হত না। অন্যদিকে একই গল্পের নায়ক দ্বিজেন সুদর্শন, সদালাপী, চটপটে। অনেক নারীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রয়েছে। হেমেন মনে করে দ্বিজেন জীবনের আসল জিনিসটিই পেয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিজেন যা পেয়েছে সে শুধু শরীরের স্বাদ-যা মানুষকে খুব দ্রুত ক্লান্ত করে দেয়, জীবনের প্রতি করে তোলে বিতৃষ্ণ। এ সম্পর্কে স্বয়ং দ্বিজেনের মর্মান্তিক স্বীকারোক্তি- ‘আমি এখন শুধু একটু শান্তি চাই, মেয়েদের পিছু পিছু ঘুরে নয় হেমেন, নিজেরই ঘরে, নিজের স্ত্রীকে নিয়ে, জানো না তুমি কেউ আমাকে ভালোবাসে না। ’

এ যেন জীবনানন্দ দাশেরই নিঃসঙ্গতা থেকে জাত তীব্র আর্তি। সেই সাথে একাকীত্বের বেদনা ও একই সাথে ঘরের শান্তি ফিরে পাবার তীব্র হাহাকার। জীবনানন্দ দাশের একটি গল্পের নাম ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ হলেও তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পের চরিত্র এ দ্বন্দ্বে  বিব্রত। প্রকৃতির প্রতি রোমকূপে বৃহৎ সত্য উপলব্ধির ও বিশুদ্ধ আনন্দের মন্ত্র লুকিয়ে আছে। সেই প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতা থেকে মানুষের স্বেচ্ছা নির্বাসন ও প্রকৃতির উন্মুখ পরিধি থেকে মানুষের দেয়াল চাপা কোটরের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থান দেখে কবি অনেকাংশে বিক্ষুব্ধ চিত্তে মানুষের এই আত্মঘাতী অভিপ্রায় উন্মোচনে সোচ্চার। ফলে লেখকের গল্পে শহুরে মানুষের সংসারে বার বার ঘুরে আসে প্রকৃতির ভিরে ফিরে যাওয়ার প্রসঙ্গ অথবা প্রস্তাব। কখনো কখনো নগর-সভ্যতার বিচিত্র কর্ম-কোলাহল। অভ্যস্ত যান্ত্রিক জীবনের ছেদ টেনে মুহূর্তের জন্যে জেগে ওঠে প্রকৃতির প্রতি দুর্মর আকর্ষণ। এভাবে জীবনানন্দ দাশের গল্প-উপন্যাসে মানুষের একাকীত্ব ও অসহায়ত্বে প্রকৃতি পরম নির্ভরশীলতা নিয়ে উপস্থিত হয় বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাত থেকে। ক্লান্তি, দুঃস্বপ্ন, ও আত্মঘাতী বিপর্যয় থেকে মুক্তির অন্বেষায় জীবনানন্দ দাশের মানুষেরা এই নির্ভরশীলতার আশ্রয় খোঁজে।

‘ছায়ানট’ গল্পের নায়ক শারীরিক অসুস্থতার জন্য ঘরের মধ্যে দীর্ঘদিন আটকা পড়ে আছে। প্রকৃতির উদার উন্মুক্ত সান্নিধ্য থেকে নির্বাসনের যন্ত্রণা তার স্বগত ভাষণে সংক্ষুব্ধ ভাবে প্রকাশ পেয়েছে-
‘আকাশের দিকে চেয়ে কাটিয়েছি অনেকদিন। বাইরে বাইরে। ....কিন্তু ঘরে ঢুকতে হয়েছিল যে।
বিদায় নিলুম, -আকাশ আলোর দিকে ভালো করে তাকাবারও ভরসা হত না। চমকে উঠতুম, ঐ নগ্ন আলোর মুখ দেখে, আর ঐ অত বড় অতখানা আকাশ .....দরজা জানালা বন্ধ। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।