ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

গল্প

পয়ষট্টি টাকার কান্না

রিংকু সারথি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২
পয়ষট্টি টাকার কান্না

শহরের হাসপাতালে তিন-চার বছরের ছেলের চিকিৎসা করাতে এসেছে এক গ্রাম্য দম্পতি। কয়েকদিন হাসপাতালের খয়রাতি ঔষধে চিকিৎসার পর, এক সময় ডাক্তার ছেলেটির বাবাকে বাইরে থেকে কিছু ঔষধ কিনে আনতে বলে।

বাবা দুয়েকবার ঔষধ কেনে, তারপর এক সময় জানায় তার আর বাইরের ঔষধ কেনার সঙ্গতি নেই। এক সময় বিনা চিকিৎসায় ছেলেটি মারা যায়। ছেলের লাশ নিয়ে যখন বাবা বাইরে আসে, মা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। স্বামী তাকে ধমকে কাঁদতে নিষেধ করে। বলে, অমন করে এই সব জায়গায় কাঁদলে মানুষ হাসাহাসি করতে পারে। আরো বলে, আল্লাহর ধন, আল্লায় নিয়ে গেছে, তাতে তাদের কী-ই বা আর করার ছিল?

হাতে কোনো পয়সা কড়ি নেই দেখে বাবা শহরেই দাফন করতে চায় ছেলের লাশ। কিন্তু মা গো ধরে, তার কলজের টুকরোর লাশ সে বাড়িতেই নিয়ে গিয়ে কবর দেবে, যেন সকাল সাঁঝে ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে পায়।

লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন এলে, বাবা নৌকো ঠিক করতে যায়। নৌকোর ভাড়া পয়ষট্টি টাকা এবং তা দেয়া তাদের সাধ্যের অতীত বিধায় নৌকো যাত্রা বাতিল হয়ে যায়।

একজন পরামর্শ দেয় লঞ্চে করে বাড়ি যেতে। লঞ্চের ভাড়া অনেক কম। শেষে বাবা মানুষের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে যা জোগাড় করে, তাতে দু’জনের লঞ্চ ভাড়ার সংস্থান হয়। কিন্তু এবার নতুন আর এক সমস্যার উদ্ভব ঘটে। বাবা জানতে পারে যে, লঞ্চওয়ালারা লাশ নিয়ে কাউকে ভ্রমণ করতে দেয় না।

শেষে বুদ্ধি খাটিয়ে বাবা এই সমস্যারও সমাধান বের করে ফেলে। সে স্ত্রীকে বলে, ছেলের লাশ কাঁথা-কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে, এমনভাবে লঞ্চে বসবে যে মানুষে বুঝবে তাদের ছেলে অসুস্থ। লঞ্চে যেতে যেতে স্বামী, স্ত্রীকে আরো বলে যে, সে মাঝে মাঝে ছেলেকে আদর করবে, ও বুকের দুধ খাওয়ানোর ভান করবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সে ছেলের শোকে কাঁদতে পারবে না। কাঁদলে লঞ্চের লোকেরা বুঝে যাবে যে তার কোলে লাশ।

নিরুপায় স্ত্রী স্বামীর সব শর্তেই রাজি হয়। এবং তারা লঞ্চে করে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা করে।

মা বুকে পাষাণ বেঁধে, স্বামীর সব শর্ত মেনে চলে। পুরো যাত্রায় সে একবারও কাঁদে না। প্রতি মুহূর্ত, প্রতি পল তার বুক থেকে কান্নার দামামা উঠেও কোথায় এসে যেন থমকে যায়। কোনোভাবেই সেই কান্নাকে সে চোখ পর্যন্ত পৌঁছুতে দেয় না। অধিকন্তু মৃত সন্তানকে ‘বাবা ’, ‘সোনা’ বলে বার  কয়েক  বুকের দুধ খাওয়ানোর ভান করে।
 
কান্না লুকাতে লুকাতেই এক সময় স্বামী-স্ত্রী ছেলের লাশ নিয়ে তাদের গন্ত্যবে পৌঁছে যায়। বাড়ি পৌঁছুলে, লাশের দাদী জিজ্ঞেস করে, তাদের সোনা দাদু কি শহরের চিকিৎসায় ভালো হয়ে গেছে? এই কথার উত্তরে মা কিছু না বলে, শ্বাশুরির হাতে ছেলের লাশ সঁপে দিয়ে, মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে এবং তারপর মাটি চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ করতে থাকে।
 
শ্বাশুরি ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, বউ অমন করে কাঁদছে কেন? উত্তরে ছেলে কিছু না বলে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বউ আগের মতোই মাটি চাপড়ে কাঁদতে থাকে আর বলে, তার আদরের ধন মরে গেছে। হাতে আর কয়েকটা পয়সা থাকলে, বাইরের ঔষধ কিনে দিলে, ছেলে তার মরতো না। ছেলে মরার খবর পাওয়ার পর, স্বামী তাকে হাসপাতালের মধ্যে বসে কাঁদতে দেয়নি। সে ভেবেছিল যে লাশ নৌকায় করে বাড়ি নিয়ে আসবে। এবং নৌকায় বসে প্রাণ ভরে কাঁদবে। নৌকার ভাড়া না থাকায় শেষে লঞ্চে চড়ে আসতে হয়। লঞ্চওয়ালারা লাশ বহন করে না। তাই পুরো পথ মৃত বাচ্চাকে জীবিত বাচ্চা বানিয়ে, কাঁথা কম্বল দিয়ে ঢেকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে হয়েছ। তার স্বামীর হাতে পয়ষট্টি টাকা থাকলে, সে নৌকায় করে লাশ নিয়ে আসতে পারতো, এবং মনের সুখে কাঁদতে পারতো। এখন বাড়িতে এসে, সে সেই পয়ষট্টি টাকার কান্নাই কাঁদছে সে। পুত্রমৃত্যুর শোক এখানে ম্লান হয়ে আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: তানিম কবির, [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।