আমাদের রিকশা এসে আর্ট কলেজের সামনে থামল। আমরা নামলাম।
হ্যাঁ, ক্ষুধা লেগেছে। কী পাওয়া যেতে পারে এখানে?
ফুচকা কিংবা চটপটি খেতে পারো, আমড়া খেতে পারো।
আমি কদবেল খাব। জুঁই ঘোষণা করল।
তাকিয়ে দেখলাম, সামনেই রাস্তার পাশে একজন আমড়া ও কদবেল নিয়ে বসেছে। আমরা দুজনই কদবেল নিলাম। খেতে খেতে কলেজ এরিয়ার ভেতরে ঢুকলাম।
এই প্রতিষ্ঠানটি কে প্রতিষ্ঠা করেছে, জানো? জুঁই জিজ্ঞেস করলো।
জানি। তুমি আর কী কী জানতে চাও?
কদবেলে ঘুটা দিতে দিতে জুঁই বললো, এই বিল্ডিংয়ের ডিজাইনটা কার?
১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৮ জন ছাত্র নিয়ে এটি শুরু করেন। তাঁর সাথে ছিলেন কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, শফি উদ্দিন আহমেদ, খাজা শফিকসহ আরো অনেকে। এই ভবনটির ডিজাইন করেন ভাস্কর মাজহারুল ইসলাম।
তুমি এতসব জানো কিভাবে?
খুব সহজে। সামনে বিসিএস পরীক্ষা। বাংলাদেশ ডায়রি মুখস্ত করছি। সেখান থেকে বললাম।
ক্যাম্পাসের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় ছোট-বড় ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে। মূল ভবনের চতুর্দিক খোলামেলা। সুন্দর করে ঘাস কাটা। এর মাঝে ছেলেমেয়েরা একত্রে কাজ করছে। কেউ স্কেচ করছে, কেউ রংতুলির কাজ করছে। পরিবেশটি সম্পূর্ণ আলাদা।
এখানে মেয়েদের মধ্যে দেখলাম, কোনো জড়তা নেই। ছেলেদের সাথে সহজে মিশছে। পড়াশোনায় সাহায্য নিচ্ছে, দিচ্ছে।
সব জায়গায় প্রচুর গাছপালা। যেন সমস্ত ক্যাম্পাসটাই একটা বাগান। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পেছনের দিকে চলে এলাম। বসার বেঞ্চি আছে এখানে। আমরা একটা খালি বেঞ্চি দেখে বসলাম। ছাত্রছাত্রী এদিকটায় কম। যারা আছে, কাজ করছে যে যার মতো।
জায়গাটা খুব সুন্দর না? জানতে চাইলো জুঁই।
হ্যাঁ, সুন্দর, খুব সুন্দর। কবিতার মতো সুন্দর।
তাহলে, তুমি একটা কবিতা লিখে ফেলো না। এই সৌন্দর্যকে নিয়ে। এই আমাদের নিয়ে।
কবিতা না, আমি একটা গল্প লিখবো ভাবছি। বললাম।
প্লটটা বলো না, প্লিজ। আমাদের ছায়া যেন থাকে।
গল্পটা একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে ঘিরে। ছেলেটির নাম আগুন। মেয়েটির নাম জল।
জল খুব উচ্ছ্বল, ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। সে প্রায়ই আগুনের হোস্টেলে যায়। আগুনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরের সবকটি অলিগলিতে। আগুনের আবৃত্তির গলা ভালো। সে আবৃত্তি করে জীবনানন্দ দাশ, আবুল হাসানের কবিতা। কোনো খোলা প্রান্তরে গেলেই আগুন জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা কবিতাটি আবৃত্তি করে-
‘সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ। ’
আগুন এক সময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, জলকে ঘিরে।
জুঁই খিলখিল করে হেসে ওঠে। তুমি তো আমাদের কথা বলছো। লেখো না, মনে হয় গল্পটা খারাপ হবে না। বলো বাকিটা। গল্পের শেষটা কেমন হবে?
আমি বলতে থাকলাম। আগুন দিনের অধিকাংশ সময় কাটায় ঘুরেফিরে জলের সাথে। পড়াশোনায় মন কই তার? তাই, শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসা হয় না তার।
আগুন এই সময় কবিতা লিখতে শুরু করে। অসাধারণ সব কবিতা লেখে সে জলকে নিয়ে।
তারপর?
একদিন জল আর আসে না। কয়েকদিন পর জানা যায়, বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে কলকাতা চলে গেছে সে।
আগুন এখনো ঘুরে বেড়ায় শহরের অলিগলিতে। ঘুরে বেড়ায় আগের মতো। যেন জল তার সাথে সাথে আছে, না বেড়ালে ও তো রাগ করবে! চুল-দাড়ি কাটা হয় না আগুনরে। পোশাক জীর্ণ। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে সে মাঝে মাঝে।
ছোট ছেলেমেয়েরা এখন মাঝে মাঝে পিছু নেয় আগুনের। ঢিল ছোঁড়ে পাগল বলে। আগুন হাসে।
আমি চুপ করলাম। তাকিয়ে দেখি জুঁইয়ের চোখ ছলছল করছে। মুখে বললাম, জুঁই! এটা একটা গল্প, শুধুই গল্প। মুখে মুখে বানালাম। কেন তুমি শুধু শুধু সিরিয়াসলি নিচ্ছো।
চুপ। চুপ করো তুমি। এ গল্প দিয়ে তুমি আমাকে ছোট করেছো। যেন আমাদের পরিণতিটা গল্পের মতো হবে এবং তা হবে আমার কারণে।
তুমি বলতে চাও, আমাদের ভবিষ্যৎটা কখনো গল্পের মতো হবে না? জানতে চাইলাম।
অবশ্যই না। আমি তোমাকে পাগল হতে দেবো না, কখনো না। তুমি জানো না, আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি! অস্ফূট স্বরে বলে উঠলো জুঁই।
দেখো জুঁই, আমি তো এখনই পাগল এবং এর কারণ তুমি।
এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো জুঁই। দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো আমার ডানহাত।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৬ ঘণ্টা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: তানিম কবির