ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

তানিম কবির-এর সাতটি কবিতা

চাবুকের জিজ্ঞাসাগুলো...

তানিম কবির | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১২
চাবুকের জিজ্ঞাসাগুলো...

জন্মান্ধের নিদ্রাযাপন
 
জন্মান্ধের গাঢ় নিদ্রায় তুমি প্রোজ্জ্বল হয়ে আছো ঊষসী— শব্দ ও আতরের অস্পৃশ্য সুড়ঙ্গপথে কেটে যাও ভাষার আঁচড়। ইস্পাতের সিংহাসনে বসে, আমি আঁকি প্রলয়ের মানচিত্র— জ্যামিতি বাক্সে কাঁপে হয়তো বা পারদের কাঁটাকম্পাস।

সূর্যাস্তের আগে, প্রান্তরে— স্লেট আর খড়িমাটি নিয়ে পৃথিবীর মৃত সব দার্শনিকের সভায়, আমি হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকি। হলদে আকাশ থেকে সন্ধ্যাযানে চড়ে তুমিই কি নেমে আসো নিবিড় একা— উদ্‌ভ্রান্ত কররেখায় ফেলে অগ্নিনিঃশ্বাস? শ্যাওলাজলে ছুঁড়ে দেয়া ঢিলমগ্ন হাত— ফর্সা আঙুল, রক্তিম নখপুষ্পের ঘ্রাণে ভাঙবে কি নৈঋতের মেঘপুঞ্জিত ঘুম? চন্দ্রগ্রহণের রাতে, কোনও এক বিমর্ষ ক্রীতদাসের উন্মুক্ত পিঠে— অঙ্কিত হয়ে চলে চাবুকের জিজ্ঞাসাগুলো...
 
সন্ধ্যার মনুমেন্ট
 
মুখ নেই, নেই মুখরতা— আমাদের হাসিবিনিময়, অজ্ঞাত ইঙ্গিত আর করমর্দন হলো শেষ। মেঘে মেঘে তাই এতো শোক, করমচার বনে লোহিত সমযাতনার অভেদ্য উৎপ্রাস। দুরারোগ্য সন্ধ্যার অনুদ্বেল হলুদে মিশে গেছে শহরের নাম, ঝড়ের সম্ভাবনা— প্রেমিকের অনুনাদ জড়িয়ে নিয়েছে এক ঘুৎকার চরকের নাচ। শান্তি নেই, নেই সান্ত্বনা— ঊষসী তোমার মনুমেন্ট আজ রঙিন দ্বিধার ফোয়ারা, যাজকের মর্সিয়ায় জেগে ওঠা বিষাদ বেদিকায় বসে বেসুরো কোরাস তুলে যাই। প্রমূর্ত স্তুতির ঘাঁই হয়ে থাকি— তোমার সুষুপ্ত চোখে আঁকি অস্ফূট নিবেদন, বোবার গোঙান...
 
ভেঁপু
 
চলে যেতে পারি প্রিয় হস্তাক্ষর, কাজলপেন্সিল, ঊষসীর স্ল্যামবুক, কারুপ্রচ্ছদ— চলে যেতে পারি আমি। পাঁসকুড়াগামী কোনও লোকাল ট্রেন কিম্বা শ্যামসুন্দরপুরের অজ্ঞাত যান আমায় নেবে না জানি। মহাপুরুষের বাণী, নির্বাণ নির্বাণ— সমবেত উল্কাপতনের রাত্রি অথবা গায়ত্রীর শবযাত্রায় মিশে যেতে পারি। সারিসারি বেলুন, রঙিন ফুঁ উড়ে চলে যাবে, নর্তকী বাতাস বলবে না কিছু— শুধু বয়ে যাবে, জ্বরতপ্ত কপালে ঝুঁকে থাকা চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে। রূপনারায়ণের বিধর্মী জল নিরাময়ের অতল কোনও মীমাংসায় বাজাবে না সুর— দূরভাস্বর কোনও কাঠের নূপুর। নেবে না ফুলেস্বর, কুলগাছিয়া— ধাতব জানলায় ফেলে রাখা নির্লিপ্ত হাতে পড়ে র’বে বাসুকীর মরদেহ। সমাপনী বিকেলে, চিত্তভানুর মর্মর পেরিয়ে বেজে উঠবে মাধুকীর ভেঁপু...

আশ্চর্য ইরেজার
 
হাতের তালুতে ঘুরে ঘুরে নাম এঁকে যায় জাহাজকাটা লাটিম— শিস বাজাতে বাজাতে খুঁজে বেড়ানো সুর ও সুরাহার অজ্ঞাত বেলুনপথ। বহুদূর, পেছনে পড়ে আছে পেছন— পেরুনো হলো না তবু নিজেরই ছায়া— স্বকৃত পাপ, ঘামের গন্ধ, গলিত নিদ্রা কিম্বা অস্ফূট স্বগতোক্তি। নাবিকের জল তিরতিরে চোখ একটা সামুদ্রিক আয়না— প্রতিবিম্বিত দীপাগার। নটরাজের প্রাসাদ অট্টালিকায় গাঁথা শিলারোদনের ভার বহে বয়োবৃদ্ধ বাতাস। প্রমত্ত নুনের বাগানে রক্তিম সূর্যোদয়— বরফের পুতুলেরা দলবেঁধে গলে যায় রোদের অভিজ্ঞতায়! প্রত্নাধারের ভাঁজে টুকে রাখা কামরাঙা ফুল— পর্ণকুটির আর সমূহ নাব্য শুশ্রূষার ভেতর বসে ইরেজার ঘষে ঘষে ঊষসী মুছে যায় চাঁদের বকুল...
 
নেইলপলিশ
 
ঊষসীর নখে এতো ধার, ওৎপাতা এতো এতো বিষ— তবু নেইলকাটার নয়, এনেছি নেইলপলিশ! রঞ্জিত আঁচড়ে ফালিফালি বুক— ছিঁড়ে যাও শংকরাবরণ, জেগে ওঠো অনন্ত অসুখ। উড়ে আসে তুলোর পাথর, অধিকারমণ্ডিত হাত— প্রস্তুত হয়ে আছে শূদ্রহাড়কঙ্কন, পাঁজরবিদীর্ণ রাত। জলকেটে হাঁসের মিছিল, ধ্বনিমত্ত উপহাস— উল্টে নাও ঠোঁট, চোখ বোজো চির বঞ্চিত, প্রিয় সর্বনাশ। তরুণ ঈর্ষার বেদিতে পাঠ হয় মৃতের প্রতিভালিপি আজও— কনিষ্ঠাঙ্গুলি ফুটে ওঠো, দীর্ঘশ্বাস বাজো বাজো...

উদ্‌ভ্রান্ত যতিচিহ্ন
 
দ্যাখো যায়, ঝাপসা করে আকাঙ্ক্ষার চাঁদ বয়ে যায় বিদেহী বাতাস। নড়বড়ে মানুষেরা ভেঙে যায় প্লাস্টিকের বিছানায়। ক্ষমার জাহাজ কাটে আকুতির ধারালো কুড়াল। কে আঁকে এতো রঙকাঁচা সরল আলপনা? কোথায় ঘন হয় বেজোড় টোকা, পুষ্পমরণ, কাঠবাদামের আসবাব? দ্যাখো কাঁপে, লোচনদিঘির জল কাঁপে দৃশ্যের ভিড় ঠেলে তিরতির করে ওঠে নুন। লাটিমের পেরেকে বিদ্ধ হয় সাইকেলের চাকা। বিদেশী মেঘের পেটে ঘাঁই মারে পাড়ার ঘুড়ি। কে জমায় বৃত্ত উঠোন, ধুলোর বৈঠক? কোথায় ডুবে গেছে কামনার ঢিল, অনুস্বর, মর্মার্থের কীট? দ্যাখো নামে, অযাচিতের রোমশ বুকে নেমে আসে বিরহী সন্ধ্যা। কবন্ধের আর্তনাদে দাউদাউ করে ওঠে পানশালা। অনড় আকাশে রটে আলোর বয়স, প্রেরিতপুরাণ। কে বাসে ভালো স্যাঁতস্যাঁতে ভার আর মোমের মানুষটিরে? কোথায় পুড়ে যায় স্লেটের আঁকন, ধ্যানভঙ্গিমা, মাংসাসী রোদ— জানে ঊষসী?
 
প্রিয় ঊষসী,

সুযোগ পেলেই আজকাল মাছের কাঁটা উপড়ে ফেলছি, যেকোনও কাপড় থেকেই মুছে ফেলছি রঙ আর বেপরোয়া কার্নিশে ছুঁড়ে দিচ্ছি পরপর কাগজের বিমান। দেখে এলাম তোমাদের ঐতিহ্য নিদর্শন— গলিত অশ্বখুর আর পাঁজরের হাড়ে তৈরি নামতার সুরম্য দালান। দুয়েকটা জানালা থাকতে পারতো— কেননা উদ্বৃত্ত, রপ্তানিযোগ্য বাতাসের অভাব নেই এখানে। এখনও বয়ে যাচ্ছে। এই বর্ষায় তোমায় দেবো বলে— বানিয়েছি বজ্রপ্রতিরোধক ছাতা। হাতলে ফুটো করা আছে, চাইলে বাঁশিও বাজাতে পারো। শলাকার শিকে শিকে হ্যান্ডমেড বারুদ। প্রতিটি বজ্রপাত একটি করে বারুদ জ্বালাবে। অবজ্ঞার ফুঁয়ে তোমাকেই সেটা নেভাতে হবে। এদিকে মাশরুমের চাষ খুব লাভজনক হয়ে উঠেছে— সবজি বাজারে বেড়ে গেছে কোলাব্যাঙের উৎপাত। অসুখ মাঝেমাঝে আমারও হয়। ব্যাকুল শুশ্রূষাকে ঘরে রেখে, সুখের সাথে বেড়াতে যাওয়ার ডাক আমিও কি পাই না? কিন্তু একটা জলপট্টির কান্না কিভাবে এড়াতে হয়— শিখি নি। শুনেছি স্কুলে এসব শেখানো হয়। আলাদা টেক্সটও নাকি আছে— আর সবকিছু মুখস্থ করে ঢুকতে হয় পরীক্ষার হলে। কিন্তু পরীক্ষার হলে পপকর্ন, কোক কিম্বা ফান্টা বেচে না বলে ওসবে আমার আগ্রহ হয় নি কোনওকালে...

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।