ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

লালন-রবীন্দ্রগানের পাঠ

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ও ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১২
‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ ও  ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে’

লালন ফকির
১০টি শব্দশ্বাস:  খাঁচা, অচিন পাখি, মনবেড়ি, আট কুঠুরি, নয় দরজা, আয়নামহল, মন, আশা, কাঁচা বাঁশ, পাখি পালায়।

লালন ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের শুরুতেই আমাদের একটা টেনশনে ফেলে দেন।

চিড়িয়াখানায় বন্দী বাঘের টেনশন নয় এটি। এটি একটি মুক্ত হরিণের টেনশন-- যে কিনা তার অজান্তে শিকারির জালে আটকা পড়ে গেছে! এই দৃশ্যটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠার সাথে সাথে আমরা আর একটা দৃশ্য পাই — হরিণটা তার মুক্তির জন্য লড়াই করছে। মানে দৃশ্যের অনেকগুলি স্তরে আমাদের টেনশন লুকিয়ে থাকে। যখন বুঝতে পারি যে লেখকের টেনশন জন্ম হয় একটা ধারণা থেকে তখন দেখি তার এই টেনশন আসছে একটা জিজ্ঞাসা থেকে। কী প্রকার জিজ্ঞাসা? আবার এই জিজ্ঞাসার আগে আসে একটি চিন্তা। আসলে চিন্তাটা শুরু হয়- একটা নিগেশন থেকে। ‘আছি’ নয় একটি ‘নাই’ ধারণা থেকে। যা শেষ পর্যন্ত ‘অচিন পাখিটা কেমনে পালায়’ থেকে বড় হতে থাকে। এক সময় দেখি লেখকের একটা সন্দেহপ্রবণ মনের জন্ম হয়— সে ভাবে পাখি পালিয়ে গেলে- খাঁচা ঠিকই থাকে, কিন্তু খাঁচা কাঁচা বাঁশের তৈরি হওয়ায় তারও স্থায়িত্বের কোনো নিশ্চয়তা নাই। তাই লেখকের টেনশন আরো দৃঢ় হতে থাকে। কারণ কাঁচা যে কোনো জিনিসই ভঙ্গুর আর অস্থায়ী। সেটি বাঁশ হোক বা বয়স।

পাখির ‘থাকার’ ধারণাটি থাকলেও- প্রশ্ন আসে- পাখি কিভাবে আসে আর কিভাবে যায়? আমরা বুঝতে পারি মানুষ প্রথম যেভাবে আত্মজ্ঞানে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে ও বোঝে সেখান থেকে সমস্যাটার শুরু। মানে আমি থাকলেও আসলে ‘আমি নাই’ এমন একটি অবস্থা থেকে প্রথম চিন্তার শুরু। পৃথিবীতে আসার পর মানব-সৃষ্ট বিবর্তনবাদ বা প্রকৃতিবিদ্যায় লাগাম নেয়ার আগে মানুষের চিন্তাযাত্রা হয়তো এরকম একটা হৃদয়বিদারক প্রশ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল। ‘আমি কী এবং যাবো কোথায়?’ সেই মোতাবেক ‘পাখি আসে আর যায়। ’ যদি পুরো টেক্সটাকে একটা মেটাফর হিসাবে দেখি তাহলে— সে ভাবে খাঁচা মানে এই মানুষের ইহজীবনের বস্তুবাচকতা। তাই প্রশ্ন আসে- কে এটিকে- এই ধাঁধার খনি হিসাবে তৈরি করেছে? এই চিন্তা মানুষকে শুধু পাগলই করে ফেলে। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। এই চিন্তাগত সীমাবদ্ধতার কারণে সে এই ‘খাঁচা’ নামক মেটাফরের কাছে এক সময় সে একটা আকারের সন্ধান পায়- শরীর বা দেহ নামে যাকে সে কল্পনা করে। যার ভেতরে মানুষ তার অস্তি-নাস্তির বীজ, মরা-বাঁচার দরোজা জানালাগুলিকে দেখে। বিশ্বাসী মানুষ এটিকে একজন সৃষ্টিকর্তার অধীনে নিয়ন্ত্রিত কর্ম হিসাবে দেখে, যা শেষ পর্যন্ত তাকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায় না। কিন্ত মানুষ যখনই এই কর্মটিকে তার এই সমর্পণের অন্ধ ধারণা থেকে মুক্তি দিয়ে, তার নিজস্ব ভাবধারণার বশবর্তী করে এগোয়, তখন সে একটি দ্বিতীয় চিন্তা করার শক্তি অর্জন করে। আর সেই চিন্তাটা আসে তার নিজেকে দেখার বা আবিষ্কার করার একটি আত্মদর্শন লাভের সুযোগ থেকে। তার শুরুটা হয় এই বস্তুবাচকতা তথা এই দেহটাকে নিয়ে। তখন লালন আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। সে ভাবে, তার এই দেহের ভেতর কে থাকে? অচিন পাখি>সৃষ্টি না সষ্ট্রা>নাকি দুজনই? এই লেখকের দেখা তথাকথিত ‘বিশেষ জ্ঞান’ এর আওতায় দানা বাঁধেনি বলে তিনি দাবি করেন যে, শরীর একটা খাঁচা বা পিঞ্জর। তার ভেতরে ‘অচিন পাখি’ আসা-যাওয়া করে। সে ভাবে পাখি আসে কিন্তু থাকে না কেন? যায় কই। তাহলে তো একটি সমস্যাই। মানুষের চিন্তার সমস্যা। পাখির এই আসা যাওয়া একদিকে কিন্তু ধর্মীয় হায়াত-মউতের কথা মনে করিয়ে দেয়। একটা নির্দিষ্ট নিয়মের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানে বোঝা যায় যে, লেখক এক সময় তার ‘আত্মজ্ঞান’ পেরিয়ে আল্লাহজ্ঞান দ্বারা তার জিজ্ঞাসাকে মজবুত করতে চাইছে। সে প্রথম মানবের মতোই বিস্ময়াভূত-- -এই অচিন পাখি কোথা থেকে আসে? শুধু শূন্য থেকে এলে তো শূন্যতেই মিলিয়ে যেত। কিন্তু তা নয়। তার একটি অচিন আধারবাটি আছে কোথাও— যেখানে সে পালিয়ে যায়! তার মানে সে কোথাও সব সময় থাকে। কোথাও ‘হয়ে আছে’ আর এক মহাজনের সৃষ্টিরূপে। কিন্ত তাকে তো আমি সৃষ্টি করতে পারি না। তাই তার ওপর আমাদের কোনো অধিকার নাই। পারি না বলেই একটা ক্ষোভ, জ্বালা তৈরি হয়। একটা টেনশন তৈরি হয়। আর থেকে থেকে একটা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়। কেমনে আসে যায়? এটি কি কোনো কেন্দ্রহীন স্বাধীন ভাবধারা? মানে এটি কি কোনো প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃত আর পরীক্ষিত মহাজাগতিক চিন্তার বাইরে? মনে হয় বাইরেরই। মানে এটি কোনো তেমন সংস্কারস্নাত জ্ঞানধারা নয় মোটেই। সংস্কারস্নাত জ্ঞান হলে এই রকম একটা চিন্তাময় জিজ্ঞাসা একটি উত্তর পেয়ে শুরুতেই নষ্ট হয়ে যেত। কারণ এরকম জ্ঞান আস্তে আস্তে ‘আছে ধর্ম’ স্থায়ী হয়ে ব্যক্তির বিশেষ স্বাধীন অবস্থাকেই পরাধীনতায় পর্যবসিত করে। কিন্তু লেখক সেদিকে না গিয়ে ব্যক্তির বিশেষ চিন্তাধারার ওপর ভরসা রাখে। আত্মচক্ষু দিয়ে বুঝতে চায় পাখি কেন আসে যায় আর কেমনে পালায়?। কিন্তু ব্যক্তি শেষ পর্যন্ত উত্তর পায় না বা উত্তর নেয় না। শুধু অচিন পাখির আগমন নিগর্মন দেখে। এই লীলাতেই সে আবদ্ধ থাকে, মজা পায়। যেমন একদিন ডেনমার্কের এক রাজপুত পেয়েছিল। বাবার হত্যাকারী আসে আর যায়! তার করার কিছু থাকে না। হ্যামলেট যেমন অসহায় তেমনি এই ফকির লালন। খালি প্রশ্ন করে আর নাটক করে বেড়ায়। টু বি অর নট টু বি? হবে কি হবে না? মানে- কেমনে আসে যায়? কোথায় থেকে সে আসে নয়, কোথায় যাবে সে নয়। কেমনে আসে যায়? এই আসা যাওয়ার ‘খেল’ টাই আসল। লাভ লোকশান কোনো বিষয় নয়।

তাহলে প্রশ্ন- কী আসে যায়? পাখিটি কী? তাকে কে পাঠায়? প্রাণ বলে যেভাবে আমরা ভাবি- তা তো নিশ্চয় নয়। যা থাকে সে তো আত্মা। প্রাণ দেহ আর মনের সম্মিলনের কারণে ঘটে। যা কিনা রক্তজাত। কিন্তু এই পাখি তা তো নয়। সে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরের একটি চিন্তাপাখি--- আত্মা। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়। আত্মা কী? তাকে কে দিয়েছে? এই প্রশ্ন এখানে নাই। নাই মানে যিনি দেয় তার চেয়ে বরং তার সৃষ্টি বা কিভাবে দেয় সে কথা কানে আসে। হয়ত পাখি নিজেই অধীশ্বর হয়ে আছে খাঁচাটির ভেতর। পাখি কী? সত্তা, সৃষ্টিকর্তা- এ যেন কপালের এক অদ্ভুত খেল। সহজে উত্তর পাওয়া যায় না। আমরা জিজ্ঞাসা আর উত্তর না পাওয়ার সমস্যায় আটকা পড়ে যাই। ‘কপালের খেল’ বলে লেখক কোন জিনিসের দিকে ইশারা দেন? এটি বলে তিনি কি আবার একটি প্রতিষ্ঠিতপ্যাকেজে পা রেখেছেন? মানে আসমানি কোনো ধর্মের দিকে? ধরে নেই যে তিনি তাই মনে করেন। কিন্তু এখানে আমরা একটা ‘ফানা’ কর্মেরই যেন ইশারা পাই। মানে সৃষ্টি আর সৃষ্টিকারীর কোনো আড়াল তিনি রাখতে চান না।  

কবি জীবনানন্দের- আলো আঁধারিতে যাই, মাথার ভেতর কোনো বোধ কাজ করে- এই ভয়ংকর কাব্যভাবনা সর্ববিনাশী অসুস্থ সময়ের চিন্তাফসল হলেও তা শেষ পর্যন্ত লালন আইডিয়াজাতই। খাঁচা নামক এই পৃথিবীর ভালোবাসা, প্রেমে মগ্ন ‘আমি’। আমার খাঁচায় ধরা এই রসভাণ্ড একদিন থাকবে না। মানে আবারো ‘নাই’। তাই লালন কাঁদে। জীবনানন্দও কাঁদে। কেন? সে কী এই খাঁচার মায়ায় কাঁদে? নাকি পরম যে সত্তা যিনি এই অচিন পাখি সৃষ্টি করছেন তার সাথে মিলবে বলে তার সাময়িক আনন্দমাখা কান্না। কার জন্য সে অপেক্ষা করে? প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত প্রশ্নই থেকে যায়। লেখকের ব্যবহৃত ভাষা আমাদেরকে তার ব্যক্তিগত ভাষার চেইন থেকে তার জন্মঅধ্যুষিত জনমণ্ডলীর মুখের ভাষার কথাই মনে করিয়ে দেয়। মানে মনের ভাষা। রাখঢাক নাই। তাকে শেকল দিয়ে পেঁচিয়ে আর একটি বিশেষ ভাষা বানানোর কোনো ইচ্ছা নাই। কেমনে, দিতাম, খেল, রইলি আশে ইত্যাদি শব্দচয়ন তার ও তার সমাজের প্রতিনিধিত্ব যেমন করে তেমনি এই ভাষা হয়ে ওঠে এই রচনার রচনারীতির শক্তি। প্রতিষ্ঠিত কিন্তু প্রায় জনবিচ্ছিন্ন পুস্তকীয় ভাষার বিরুদ্ধে কি এটি প্রথম ভাষাবিদ্রোহ?  

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১০টি শব্দশ্বাস:  হিয়া, লুকিয়ে, দেখতে পাইনি, বাহির-পানে, ভালোবাসায়, আঘাত, আশায়, আনন্দ, খেলায়, গোপন প্রাণে।

রবীন্দ্রনাথের এই গান কোনো টেনশন থেকে জেগে ওঠে না। বলার কায়দা দেখে মনে হয় তার দেখার চোখটা খুব ক্যাজুয়াল। মানে এর ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোনো অপেক্ষার যন্ত্রণা দেখা যায় না। কে আসে আর যায় বা থাকল কি থাকল না এটি কোনো ভাববার বিষয় না। যে আছে এমনিতেই আছে,  হয়ে আছে- এমন তার উপলব্ধিজাত জগৎ। তার কোনো খাঁচা নাই,  অচিন পাখিও নাই। তাই পাখি ‘কেমনে আসে যায়’ এটি নিয়ে তার মাথা ব্যথা নাই। তার খাঁচা নাই কিন্তু তার ‘হিয়া’ তো আছে। তিনি এতে কোনো মেটাফর ব্যবহার করেন না। তাতে আমাদের একটু বাঁচা বাড়ল। আমাদেরকে কষ্ট করে অচিন পাখির ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ যাওয়া আসা দেখতে হয় না। যদিও হিয়ার মাঝে কেউ লুকিয়ে থাকে- কিন্তু কে লুকিয়ে থাকে তার জন্য কোনো প্রশ্ন নাই। এই হিয়া থেকে কোনো পাখিও পালিয়ে যায় না। তাই তার ভেতরে কোনো সমস্যা বা কোনো জিজ্ঞাসা নাই। বলা যায় এটি তার জ্ঞান থেকে দেখা বা অর্জন। লাভ করা বোধের ওপরের বোধ। কারণ সে জানে ‘হিয়া’ একটি বস্তু শরীরের ভেতর- যেখানে কারো আসা যাওয়া নাই। পরমজ্ঞানে যাকে জানা যায় সে তো আছে, সে তো কেবলই থাকে,  যায় না কোথাও। সে থাকে রক্তমাংসসহ থাকে। তাই তার গ্রহণটাই গোপনে ঘটে। এই যে কেউ লুকিয়ে আছে এবং সে যে এই ব্যাপারটি জানে না - এই নির্জ্ঞান অবস্থা থেকে সে কোনো মুক্তি চায় না। কারণ সে বুঝতে পারে যে কেউ গোপন থাকে আগে থেকেই।   তার এখানে থাকারই কথা। যে একজন থাকে সেটি তার উপলব্ধি, পরীক্ষা পাঠজাত। তাই এই লেখক বলা যায় একটি নিরাপদ আইডিয়ার সাথেই সুর মেলান। জীবনকে দেখার যে চোখ সেখানে পরতে পরতে পেলবতা,  প্রাপ্তির সৌন্দর্য। অপ্রাপ্তির জ্বালা যন্ত্রনা বা আশাহত হওয়ার মতো কিছু নাই।

প্রশ্ন তাহলে কে লুকিয়ে থাকে?  এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে- এটি আছে যে সেটি বোঝা যায় না। শরীর আছে তো শরীরের মতোই। তার কোনো প্রসার নাই, ভাগব্যবধান নাই। কুঠুরি, দরজা, জানালা আয়নামহল নাই। এখানে কোনো অচিন পাখিও আসে না। তাহলে কে গোপনে আসে?  সে কি তার পরিচিত কেউ? বোঝা যাচ্ছে যে এই আগন্তুক ঠিক আগন্তুক নয়। সেখানে সে রীতিমত অধিকার নিয়েই আছে। সে কী পরমাত্মা সে কী সৃষ্টিকর্তা?  আমার মধ্যে তুমি আমি হয়ে লুকিয়ে আছে আর এক ‘আমি’। এই জায়গায় এসে লালনের সাথে তার একটা মিল দেখা যায়। যদিও লেখক রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত কোনো মেটাফরের দিকে যান না, কিন্তু আমরা ঠিকই বুঝতে পারি যে, ‘হিয়া’ তো খাঁচাই। গভীর গভীর এক খাঁচা। কিন্তু তার হিয়ায় কোনো অচিন পাখি আসে আর যায় না। যে আসে সে আসে লুকিয়ে লুকিয়ে আসে। ওরা থাকে এক সাথে কিন্তু ব্যক্তির এমন অজান্তে যেন জানাই আছে সব সময়- সে সব সময়ই থাকে। মানে কোনো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় এটি। সে চলে গেলে লেখকের বাঁচা মরা কিছুই ঘটে না। এখানে লালনের ফানা কেন্দ্রিক আইডিয়ার সাথে মিল পাই। কিন্তু লালন যেখানে বেশিক্ষণ আরাম করে বসে থাকতে পারেন না সেখানে রবীন্দ্রনাথ কিছু স্বভাব কিছু শ্রেণীগত কারণেই কোনো টেনশন পান না। সে মনে করে যে থাকে সে তো থাকেই। তার থাকার প্রয়োজনেই থাকে। তার এমন লুকিয়ে থাকা আর পাওয়ার ভেতর একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দ থাকে। আনন্দ এখানে একটা চিরস্থায়ী অবস্থান নিয়েই থাকে। তাহলে তো অপরদিকে দুঃখও থাকে। কিন্তু দুঃখ এখানে একটা এসথেটিক দুঃখ। মানে দুঃখটা কোনো কিছু নাই বা কোনো কিছুর অভাব আছেই বলে ঘটে না। ঘটে কারণ অপর দিকে সুখের একটি নিশ্চিত অবস্থান আছে। সেই দুঃখ ঘটে,  হয় না। তা শুধু ঘটবে ব্যক্তির মানসিক বা দৈহিক শক্তিটিকে বোঝার জন্য। যে দুঃখের আর এক নাম সুখ। তাই তার উত্তরণ উপলব্ধির আনন্দে। ‘তোমার কাছে যাইনি’ বলে একটি হাহাকার থাকে অবশ্য। কিন্তু সেটি শুধু একটি অনির্বচনীয় (সাবলাইম) হাহাকার। মানে আছে তো,  হারিয়েছি ক্ষণিক,  আবার পাব ‘তাকে’। তার থেকে ব্যক্তির হেমলেটীয় দোদুল্যমানতা আসে না। তবে এই যে না-দেখে না-বুঝে একজনের জন্য আফসোস তার থেকে হয়তো গোপন একটা মায়া কাজ করে। প্রশ্ন আসে - কিসের মায়া? পরমের সাথে মিলনের মায়া? বা কোনো নারীর সাথে মিলন? মিলন যে কারোর সাথেই হোক, যেখানেই হোক,  তার যে একটা গোপন না পাওয়ার বেদনা আছে- তা বোঝা যায়। সকল শান্তির যে আধার সে কোন জায়গা থেকে আসে? এমন কোনো প্রশ্ন নাই। তাই শুধু ঘটে নীরব সমর্পণ। সমর্পণ একটি সামন্ত শ্রেণীজাত ধারণা। তার সাথে বিদ্রোহ করার জোস নাই। কিন্ত লালন শাহ নামের লেখকের আছে। তার জিজ্ঞাসা তাকে একটি গোপন বিদ্রোহের দিকে নিয়ে যায়। আমাদের চিন্তা, সমাজসংস্কার বা ধর্মনীতি যা-ই হোক। লালনের করা প্রশ্নের উত্তর হয়তো তার অজানা নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটা আসে তার বিষয়টা যেন সবারই অস্তিত্বের অংশ হয়ে যায়।

আত্মাকে লেখক রবীন্দ্রনাথ টের পান না। তিনি প্রাণের গোপানীয়তা টের পান শুধু। তার মানে সে বুঝতে পারে যে – কেউ তাকে ঘিরে রেখেছে, সরলভাবে স্নেহ করে ধরে রেখেছে। তার পালিয়ে যাবার কোনো ইচ্ছা বা অধিকার নাই। তাই লেখক এখানে শান্ত, নিশ্চিত ও  তৃপ্ত।   মানুষের চিন্তাশক্তি বিকাশের দ্বন্দ্বকে দূরে ঠেলে এখানে রাজত্ব দেয়া হয়েছে- এই যে আমি পেয়েছি এমন শান্তিপ্রদ অবস্থান। তার মানে তার চিন্তার চেয়ে তার সংস্কার বিশ্বাস কাজ করেছে বেশি। মানে একটি পরমকে খোঁজা যার পরমতা বিষয়ে লেখক একটি স্থির ধারণা রাখেন। তাকে চ্যালেঞ্জ করবেন এমন টেনশন কখনো হয় না। আর লালনে- যা আছে তার উপস্থিতির চেয়ে যা ‘নাই’ তাই নিয়ে যতসব দ্বন্দ্ব। মন সব সময় রক্তাক্ত।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস [email protected]; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected] 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।