সৈয়দ শামসুল হক
বৃষ্টি কতকাল পরে
বৃষ্টি কতকাল পরে! এমন করে! দীর্ঘ দগ্ধ বৈশাখে আমার এই চলার ভেতরে!
বৃষ্টি যেন গাজনের ঢাক! শব্দ যেন সম্বর গাইয়ের মতো ফুটন্ত নীল শরীর!
আমি রাজপথ ছেড়ে নিয়েছি গলিপথ! বৃষ্টি মাথায় আমি কাওরান বাজারে!
বাজারের কোলেই বস্তি! আনাজ ও মাছের পাহাড়ের পাশেই বিষ্ঠার সাগর!
ভিজে ওঠা মাটির গন্ধের সঙ্গে হাওয়ায় সাঁতার দিচ্ছে প্রতিযোগিতায় মুত!
গলিপথ ছেড়ে রেললাইনের স্লিপার এখন আমি পার হচ্ছি লাফিয়ে লাফিয়ে!
হঠাৎ এক নবজাতকের চিৎকার! বস্তিতে কলরব! এনজিনের তীব্র সিটি হয়!
বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে উল্লাস না কান্নাই ওদের ওটা, ঝমঝম করে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন!
‘শালার এ বৃষ্টি! আর শালার এ জীবন!’ নালা দিয়ে বহে যাচ্ছে রক্ত নাভিকাটা!
আল মাহমুদ
কদম ফুলের ইতিবৃত্ত
আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি বৃক্ষের মতো অনড় নই
তুমি যতবার ফিরে এসেছ ততবারই ভেবেছ
আমি কদমবৃক্ষ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকব
কিন্তু এখন দেখ আমি গাছের নিচে থাকলেও
হয়ে গিয়েছি বৃক্ষের অধিক এক কম্পমান সত্তা
বাঁশি বাজিয়ে ফুঁ ধরেছি আর চতুর্দিক থেকে কেঁদে উঠেছে
রাধারা।
আমি কি বলেছিলাম ঘর ভেঙে আমার কাছে এসো
আমি কি বলেছিলাম যমুনায় কলস ভাসিয়ে
সিক্ত অঙ্গে কদমতলায় মিলিত হও?
আমি তো বলিনি লাজ লজ্জা সংসার সম্পর্ক জলে ভাসিয়ে দাও
আমি তো নদীর স্বভাব জানি, স্রোত বুঝি, কুল ভাঙা বুঝি।
কিন্তু তোমাকে বুঝতে বাঁশিতে দেখ কতগুলো ছিদ্র
সব ছিদ্র থেকেই ফুঁ বেরোয়
আর আমার বুক থেকে রক্ত।
রফিক আজাদ
ঘরবাড়ি বলতেই
‘ঘরবাড়ি’ বলতেই আমার দু’চোখে ভেসে ওঠে
একটি উঠোন ঘিরে চারপাশে ক’টি কুঁড়ে ঘর,
‘শান্তি’ বলতে ঘোমটার নিচে সলজ্জ মুখের হাসি,
‘ছায়া’ বলতেই জনকের দীর্ঘকায় প্রতিবিম্ব,
‘স্নিগ্ধতা’ বলতে আমি এখনো মায়ের মুখটি বুঝি,
সন্তানের মুখের মণ্ডল আমার ‘তৃষ্ণার জল’,
‘ভালোবাসা’ বলতে বুঝি দীর্ঘস্থায়ী অতৃপ্ত চুম্বন…
ঘরবাড়ি বলতে লোকে যা বোঝায় আমার তা নেই—
শান্তি-ও আমার থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বে
বাস করে। অতএব, শান্তি নাম্নী আমার কোনোই
সহোদরা নেই— পরিচিতাদের মধ্যে কেউ নেই।
ছায়া ব’লে কোনো ধাই ছিলো কি আমার কোনো কালে?
‘ভালোবাসা’ বলতে এখন ক্ষরণ, ক্ষরণ— আর,
শুধুই ক্ষরণ…
মহাদেব সাহা
কতোদিন হয়
কতোদিন পূর্ণিমারাতে বাঁশবনের মাথায়
গোল চাঁদ দেখা হয় না,
জ্যোৎস্নার মাঠে ঘুরে বেড়ানো হয় না
ছিপ ফেলা হয় না নদীর জলে;
কতোদিন ডুব-সাঁতার হয় না পুকুরঘাটে
মাছ ধরা হয় না বিলে,
আজ আমার কেবলই মনে হয় এসবই হারিয়ে গেলো।
কতোদিন হয় নতুন ধানের গন্ধ শোঁকা হয় না
গন্ধভাদুলী তুলে আনা হয় না বাড়িতে,
সকালবেলায় দুধ দোয়ানোর শব্দ শোনা হয় না
কতোদিন হয় এসব কিছুই হয় না;
মা-বোন আপনজনদের স্নেহ পাওয়া হয় না
কতোদিন মুখ ধোয়া হয় না নদীর জলে,
দু’চোখ ভরে পূর্ণিমারাত আর আকাশ দেখা হয় না।
গৌতমাশিস গুহ সরকার
নববর্ষে ঠাকুমাদের মনে পড়ে
আমাদের ঠাকুমারা চৈত্র সংক্রান্তির দিন রাজ্যের তেতো এনে জড়ো করতেন।
করলা, নিম, গিমা শাক ইত্যাদিতে ভরিয়ে তুলতেন সোনালি কাঁসার থালা।
আমরা তিতোতে তিতি বিরক্ত হয়ে ঘ্যানঘ্যান করে তপ্ত দুপুরে শয্যা নিতাম।
পরদিন বৈশাখের প্রথম আলোয় মিষ্টিতে মুগ্ধ করে আমাদের পুরো বছর
নিরোগের নিশ্চয়তায় ভরিয়ে তুলতেন তাঁরা।
এখন প্রতিদিন মিষ্টি খাই
প্রতিদিন চর্বি খাই
পশুদের, পাখিদের, মাছেদের।
আর পুরো বছর সারা গায়ে অসংখ্য খোস পাঁচড়া নানাবিধ চর্মরোগে
ছাল ওঠা কুকুরের মত ডাক্তারের চেম্বারে জিহ্বা বের করে হাঁপাই।
আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা শূন্যে
আমরা কিছুই ঠেকাতে পারি না
খোস পাঁচড়া, দুর্নীতি, মৌলবাদ, হিংসা আর নষ্টামি-সব আমাদের
আক্রমণ করে।
আমাদের মায়েরা আমাদের আদর স্নেহে এতই জড়ভরত করে তুলেছেন যে
আমরা প্রতিরোধহীন অকর্মার দল হয়ে ভেড়াকান্তের মতো পূর্বপুরুষের ভাষা হারাই !
ঠাকুমাদের আমন্ত্রণ জানাই
তোমরা কাসার থালায় তেতো হাতে আরো একবার এসো আমাদের ডুবুডুবু সংসারে
আমরা আমাদের মায়েদের বলি
মিষ্টতায় নষ্ট কোরো না উত্তরাধিকার।
আমরাও চারটি মূলমন্ত্রে স্বদেশ সাজাতে চাই
আমাদের বুকেও গুলি এসে ফিরে যাক মুক্তিযোদ্ধার বুকের মতই।