‘‘এনাফ ইজ এনাফ’’--- অনেক হয়েছে! আর নয় মুখ বুঁজে থাকা। এবার পশ্চিমা দুনিয়ার ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিলেন নোবেলজয়ী জার্মান কবি-লেখক গ্যুন্টার গ্রাস।
গত শতকে জার্মান যুদ্ধবাজ এডলফ হের হিটলারের ইহুদিনিধনযজ্ঞের যাবতীয় পাপ কাঁধে নিয়ে দুনিয়ার সামনে গোটা জার্মান জাতির মাথা আজো হেঁট হয়ে আছে। আজো তারা ইহুদিদের ব্যাপারে নীরব থাকার নীতিতে অটল; ইহুদিরা যতো কুকর্ম আর ‘মহাপাপ’ই করুক, ডয়েশল্যান্ডের মানুষ সে ব্যাপারে যথারীতি চোখ বুঁজে, মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। পাছে ইহুদি বিদ্বেষের বদনাম জোটে —--এই ভয় তাদের ছাড়ে না। আসলে তাদের গায়ে, জন্মদাগের মতো, লেগে আছে ‘‘ইহুদি-বিদ্বেষ’’ নামের তকমা। তাই অগত্যা ইহুদি-তোষণ নীতি আঁকড়ে আছে তারা। বলা হয়, প্রতিটি জার্মান-মন সদা এক অদৃশ্য ইহুদি ভূতের লাশ কাঁধে নিয়ে ঘোরে। এই এক ট্যাব্যু---যা জার্মানদের নিয়তসঙ্গী।
কিন্তু সে ট্যাব্যুকে একপাশে ঠেলে, সম্ভাব্য সমালোচনার রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে, মুখ খুললেন গ্যুন্টার গ্রাস। এবার তার কলমের জিহ্বায় খড়্গসম জ্বলে উঠল সত্যবাক্য; ইউরোপীয়দের ভণ্ডামি, উদাসীনতা আর তুষ্ণীভাব, মার্কিনীদের নির্লজ্জ দ্বৈতনীতি, আহমাদিনেজাদের ভাঁড়ামো আর অসার তর্জন-গর্জন, সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইসরায়েল নামের বিষফোঁড়ো-রাষ্ট্রটির ক্রমাগত দামামা পেটানোর চলমান সার্কাস---এসবের বিরুদ্ধে এবার তিনি একাই বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন। ‘‘অ্যান্টি সেমেটিক’’ বা ‘‘ইহুদি-বিদ্বেষী’’বলে পশ্চিম দুনিয়া তাকে তকমা এঁটে দেবে জেনেও কপটে বলে দিলেন—গোপনে পরমাণু অস্ত্রধারী ইসরায়েল বিশ্বপল্লীর ‘‘বড়ে গুণ্ডা’’; দুনিয়ার শান্তির জন্য সে-ই আজ সবচে বড় হুমকি।
ফলে যা হবার হয়েছেও তা-ই--- পশ্চিম দুনিয়া এখন গ্যুন্টার গ্রাসের গোষ্ঠি উদ্ধারে নেমেছে। পশ্চিমের আমজনতারও বড় একটা অংশ থেকে শুরু করে সেই দলে নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিক, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ মায় টেকোমাথা বুদ্ধিজীবীর দল। দু’একটা ব্যতিক্রম বাদে তা থেকে বাদ যায়নি মিডিয়াও; নিরপেক্ষতার তথাকথিত মেকি মুখোশখানি ভেদ করে এবার বেরিয়ে পড়তে শুরু করেছে তাদের আসল চেহারা। আর ইসরায়েল? সে তো তেড়িয়া ষণ্ডের মতো শুরু করে দিয়েছে ঘোঁৎ ঘোঁৎ। এরই মধ্যে ইহুদি রাষ্ট্রটি তাকে তড়িঘড়ি ‘‘অবাঞ্ছিত’’(পারসোনা নন গ্রাতা) বলে ঘোষণা দিয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে ‘‘যে কথা বলতে হবে’’ ("What Must Be Said") শিরোনামের কবিতাটি যেন লক্ষ-কোটি পরমাণু বোমা হয়ে ফেটে পড়েছে তেল আবিবের কালো কলিজায়। আর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেন ইয়ামিন নেতানিয়াহু নামের চিরচেনা ‘‘সেমেটিক জল্লাদ। ’’ ফিলিস্তিনে বোমা মারা, জায়গা দখল আর নারী-শিশু-বৃদ্ধদের লাশ ছাড়া দুই চোখে একফোঁটা নিদ আসে না যে তার!
নেতানিয়াহুর আঁতে ঘা যতোই লাগুক, গোটা পৃথিবীর বিবেকের প্রতিনিধি,সাহিত্যে নোবেলজয়ী ৮৪ বছর বয়সী মহাশয় গ্যুন্টার গ্রাসের তাতে কী বা এসে যায়! তিনি তো বলেই দিয়েছেন: ‘‘কবিতাটির তীব্র সমালোচনা হবে জেনেই তা লিখেছি আমি। ’’
যে করেই হোক বিশ্বজুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দেওয়া কবিতাটি চটজলদি অনুবাদ করিয়ে তা বাংলানিউজে প্রকাশ করার আইডিয়াটি আমার নয়। এটি এসেছিল এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের মাথা থেকে। এটি দ্রুত অনুবাদ করার তাগিদ দিলেন তিনি (এসব সৃজনশীল কাজের প্রণোদনা দেবার ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার)। সে তাগিদ শিরোধার্য! কিন্তু আমি এর ইংরেজি অনুবাদটি খুঁজে খুঁজে কেবলই হয়রান। অতএব কী করা? অবশেষে ত্রাতা রূপে আবির্ভূত হলেন কালেরকন্ঠ’র সাহিত্য সম্পাদক কবি শামীম রেজা। কবিতাটির বাঙলা রূপান্তরের ক্রেডিট জমা থাকুক তাদের দুজনের ঘরে। দুজনকেই অশেষ কৃতজ্ঞতা।
যে কথা বলতে হবে
গ্যুন্টার গ্রাস
কেন আমি থেকেছি নীরব, এতো-এতো দিন সবার চোখের সামনে
যুদ্ধের খেলায় তারা যা করেছে, সব দেখেশুনে
কেন আমি থেকেছি নীরব; অবশেষে আমাদের মধ্যে যারা
বেঁচে যাবো তারা সবে বড়জোর পাদটীকা হবো ?
এ হলো কথিত সেই প্রথমে-আঘাত-হানার অধিকার;
সে আঘাত মিসমার করে দেবে ইরানি জাতিকে,
তাদের দমিয়ে রাখছে এক বড়গলাবাজ;
আর তারা সাজানো র্যালিতে গিয়ে নিয়মিত জমায়েত হয়,
হয়তোবা ক্ষমতা-বলয়ে তার পয়দা হচ্ছে একখানা পরমাণু বোমা,
সেই অপরাধে তারা মারা পড়বে অঘোরে-বেঘোরে।
তবুও এখনও সেই দেশটির নাম মুখে নিতে
কেন আমি এতো দ্বিধা করি, যে দেশ
অনেক বছর ধরে--যদিও গোপনে--পরমাণু শক্তিধর হলো দিনে দিনে,
তার জন্য নয় কোনো তদারকি, ভেরিফিকেশন,
পরিদর্শন-টর্শন সব তার বেলায় মাফ?
এসবের প্রতি এই--এহেন নিখিল নিরবতা,
এসবের মুখোমুখি হেঁট-মুণ্ড আমার নিজের নিরবতা;
এই নিরবতা এক পীড়াদায়ী মিথ্যা মনে হয়,
এর বিরোধিতা করতেই সে আমাকে
বাধ্য করে সাজা মেনে নিতে:
কী অবলীলায় ‘‘ইহুদি-বিদ্বেষ’’-- এই রায় নেমে আসে।
কিন্তু এখন আমার নিজের দেশ, তার
নিজ অপরাধের কারণে তাকে
কাঠগড়ায় তোলা হলো কতো কতো বার,
লেখাজোখা নাই কতো প্রশ্নবাণে জর্জরিত সে-- জুড়ি মেলা ভার,
সে হলো নাটের গুরু; সবকিছুই তাকে দিয়ে শুরু,
(এই নিয়ে বেশুমার চলেছে বেসাতি ,
যদিওবা অনায়াসে তারা এর নাম দিল পিতৃভূমে প্রতি-আবাসন)
আরো একটা ডুবোতরী রণসাজে সাজানো হয়েছে--আর সেটি
পরমাণু বোমা-পেটে ইসরায়েল যাবে,
সেখানে যে পরমাণু বোমাটোমা বলে কিছু আছে
আজও তার মেলেনি প্রমাণ, আতঙ্কই শুধু এর
একক প্রমাণ; যে কথা বলতে হবে, আমি তা বলবোই।
কিন্তু আমি কেন আজও আছি চুপচাপ?
যেহেতু আমার আদি পরিচয় নিয়ে আমি ভাবিত ছিলাম ,
কখনো-যাবে-না-মোছা কলঙ্কের কালি এক লেগে আছে তার সারা গায়,
এর মানে, যে-দেশের সঙ্গে আছি ওতপ্রোত, আর থাকবো জড়িয়ে চিরকাল ,
ইসরায়েল রাষ্ট্র এই সত্য ঘোষণাটুকু মেনে নিক তবে--
আমি এটা চাইতেও পারবো না ?
কেবল এখন কেন তবে, এ বুড়ো বয়সে এসে, আর
যতটুকু কালি আজো অবশিষ্ট আছে এই কলমে আমার--
তা দিয়েই বলে যাবো আমি:
ইসরায়েলের আণব-মর্দ্দামি---
পৃথিবীর ইতিমধ্যে ভঙ্গুর শান্তিকে করেছে অসহায়।
যেকথা বলতে হবে অতি-অবশ্যই আলবৎ--,
কাল যদি বলি তবে বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে;
এবং যেহেতু---জার্মান হিসেবে আমরা ঘানি সেতো টেনেছি অনেক --
কোনো একটা অপরাধের মালমশলা, হয়তোবা, আমরাই দিচ্ছি যোগান
---এ-মুহূর্তে এটা পরিষ্কার! আমাদের শত অপরাধ
গৎবাঁধা খোঁড়া যুক্তি ঢাকতে পারবে না।
আর এতো অনিবার্য: নিরবতা---আমি একে ভেঙ্গেছি খানখান,
পশ্চিমের ভণ্ডামিতে ঘেন্না ধরে গিয়েছে আমার!
আর আমি আশা করি, নিজেদের নিরবতা থেকে
মুক্ত হবে আরো অনেকেই; এ-দাবিতে উনারাও হবেন সোচ্চার
তাদেরই বিরুদ্ধে যারা ডেকে আনলো আমাদের হাঁ-খোলা বিপদ ;
তাদের ছাড়তে হবে এহেন মস্তানি--- এটুকুই আমাদের দাবি;
আমরা আপসহীন, হয়তোবা, তুলবো আওয়াজ।
ইসরায়েল-ইরানের এ-দুই সরকার,
উভয়ের পরমাণু সক্ষমতা, সম্ভাব্য ক্ষমতা বিষয়ে
আন্তর্জাতিক তদন্ত যেন তারা হতে দ্যায় ; সে তদন্ত হতে হবে উন্মুক্ত অবাধ।
এর চেয়ে ন্যায্য আর ফিলিস্তিন-ইসরায়েল উভয়ের জন্য সমান
সহায়ক পদক্ষেপ আর কীবা হতে পারে তবে?
অলীক বিভ্রমে ঢাকা এতদঅঞ্চলে
পরস্পর দুষমন হয়ে যারা পাশাপাশি বসবাস করে
এই রফা তাদের সবার জন্যে, আর
শেষমেষ আমাদের সকলের জন্যে সেটি অনুকূল হবে।
[মূল জার্মান থেকে Breon Mitchell-এর করা ইংরেজি অনুবাদ ‘‘What Must Be Said’’-এর বাংলা ভাষান্তর]
বাংলাদেশ সময় ১৮৪৫, এপ্রিল ১১, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক