ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শিল্প-সাহিত্য

শূন্যতা

শ্যামল চন্দ্র নাথ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১২
শূন্যতা

http://www.banglanews24.com/images/PhotoGallery/2012April/galpo 120120408165545.jpgকপালের উপরের রেখাগুলো কেমন ভাজ হয়ে গেছে অনন্তের। সে ভাবছে।

কিন্তু কূলকিনারা খুঁজে পায় না। হাতের সিগারেটের আগুন জ্বলতে-জ্বলতে শেষপর্যন্ত  নিঃশেষ হয়ে যায়। গন্ধ সারা ঘর আচ্ছন্ন করে দেয়। অনন্ত আস্তে আস্তে জানালার ফাঁক বেয়ে গড়িয়ে পড়া চাঁদের আলো দেখতে শুরু করে। খোলা আকাশ থেকে বাতাস শরীরে এসে নাড়া দিচ্ছে। কি রকম এক অস্বস্তি। সে বোঝার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু তার আবেগ এবং ইচ্ছার প্রতিফলন ভিন্ন।

সে আজ যা ভাবছে তা বড় দূরের অনেক দূরের দেশ। সে গভীর দুঃখের মধ্যে বুঝতে চেষ্টা চালায় কী তার কী তার না। বুকটা ক্ষণিকের জন্য পাথর হয়ে যায়। পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে তাকে। কেমন আতঙ্কে সাদা হয়ে যায় অনন্ত। কালের যবনিকার আড়ালে হারিয়ে গেছে তার সোনালি অতীত। নীরব স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে জন্ম নেয় জীবনের কিংবদন্তিতুল্য কোন মুহূর্ত। সে মুহূর্ত হয়তো মধুর নয়তো তিক্ত। যে আজও ওই মুহূর্ত আঁকড়ে ধরে আছে একাকী।

দশ বছর আগের কথা, ঘোলাটে স্মৃতি ভেদ করে মনের আঙিনা সাদা কোন এক সুক্ষ্ম ফ্রেমে ভেসে উঠল। সে কথা কোন পাখি কিংবা পতঙ্গের কাছেও প্রকাশ করতে পারেনি। হঠাৎ একটা চাপা রাগ ঘূর্ণিঝড়ের মত উঠে তার ভিতর তোলপাড় করে দেয়। আবেগের ডানায় ভর করে সে উদাস স্বরে একাকী বলে ওঠে। সে এখনও তার কথা ভাবুক, একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলুক। কিন্তু সে তো তার সীমানার বাহিরে, অন্য জগতে। ইদানিং কেমন জানি সব পাল্টে যাচ্ছে, তেমনি হাওয়া বাতাসও। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় চারপাশের বাতাস দেয়ালের মত জমে গেছে, যেমন— জমে যায় শরীরের কাটা স্থান থেকে বেরুনো রক্ত কণিকাগুলো।

একখানি কালো মেঘ বিষণ্ন মনে এসে চাঁদের আলোকে কিছুটা মলিন করে দিচ্ছে। সেই যে কবে অনন্তের সাইকেলটা চৈতীর ডাকে সাড়া দিয়েছিলো! যখন অনন্ত আস্তে আস্তে সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসত, আর সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতো স্ট্যান্ডের উপর, তার মনও তেমনি ভর করে থাকতো অন্য জনের উপর। সে আসলেই চৈতীর মুখে হাসির একটা ব্যর্থ চেষ্টা হত, মনে যে সত্যিকারের হাসি নেই তা দেখলেই অনুমেয় হত।

আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে অনন্ত, চৈতীর কথা তার বুকের ভিতরে নাড়া দিয়ে ফর্সা মুখটায় কিছুটা লাল আভা সৃষ্টি করত। চৈতী মস্ত এলোচুলের অগোছালো ঝাপটার আড়াল থেকে বড় চোখ আর গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বলে— কি তুমি না সকালে আস, এখন এলে! ভিতরে কী একটা তীব্র বেদনা। চোখ-মুখ ফেটে পড়ছে চাপা আবেগে কিন্তু ঠোঁট কেঁপে উঠলেও বিন্দু পরিমাণ কণ্ঠস্বর বের হয়নি। ওদিকে চৈতীর অপলোক চোখের ছাউনি সকল প্রাণশক্তির মহাবেগে লজ্জা, ঘৃণা, ভয় ও অপরাধবোধহীন হয়ে আলোকোজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনন্তকাল ধরে। ওদিকে অনন্তের এক বুক সমুদ্র সমান ভালোবাসা প্রচণ্ড ঢেউ দিয়ে নিজের ছায়াটিকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করে দেয়।

 হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া এক দৈত্যের টানা ধোঁয়ার লাইন তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। ভীষণ লজ্জা হয় তার দীর্ঘ সময় অন্যের বাসায় কাটানোতে। কিছুটা সময় পর চৈতীর হাতে এক গ্লাস পানি পান করে সে চলে যায়। কঠিন একটা লড়াই করতে হয়, কল্পনা আর বাস্তবতার কঠিন ও নিগুঢ় সত্যের সাথে। সে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে যায়। অন্য এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অনন্ত সূর্যের রক্তিম আলো এবং ঝিকিমিকি কারুকার্য, যা গাছগাছালির  উপর আছড়ে পড়ে জীবন্ত হচ্ছে সেই দৃশ্য অবলোকন করছে। মসৃণ নীল আকাশ, চারিদিকে গাঢ় সবুজ গাছপালার গহীন রাজ্য। ঘাসফুল আর ধানের খেতের গায়ে জমে থাকা শিশিরবিন্দু আস্তে আস্তে ঝরে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে চৈতী’র বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। চৈতী’কে আজ অনেক সুন্দর লাগছে, এত সুন্দর নকশা সহজে দেখা যায় না। ভীষণ লাবণ্য মাখা লাগছিল মুখখানি তার কাছে। অনন্ত অবাক হয়ে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখছিল। সে আরো মুগ্ধ হতে থাকে। চৈতীও তাকিয়ে থাকে, যার মাঝে কিছু অপূর্ণতা সে পূরণ করে আবার বিস্মিত হয়ে তাকায়। তার মনের ভিতর কে যেন নীরবে বলে ওঠে, একি পবিত্র ভালোবাসা নাকি কামপ্রবাহের তীব্র বাসনা।

কেমন যেন ওর ভাবভঙ্গী নিজের ভিতর নিবিড় ভাবে দেখছে চৈতী। এরপর কিছু না বলে অনন্ত বের হয়ে যায় তার মনের প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও। সামনে আড়াআড়ি পথ পড়ে আছে। কিন্তু সে ঠিক করতে পারে না সে কোন পথে যাবে। বামদিকের পথটায় অপূর্ব সুন্দর ছায়া পড়ে আছে। জনমানবশূন্য। শুধু গাছের উপর কয়েকটা ক্লান্ত পাখি আর একটা কালো কুকুর আরেকটা কুকুরের পিছনে দৌঁড়াচ্ছে। সে ওদের বিপরীত দিকে হাঁটছে। হঠাৎ একদিন অনন্তের মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মা’কে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে আসা হল উন্নত চিকিৎসার জন্য। অনন্তের মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। যত দিন গড়াচ্ছে তত মৃত্যুর করুণ ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। মা মৃত্যুর আগে তথা অসুখ ধরা পড়ার পর অনন্তকে নীরবে দেখত। ওইভাবে মায়ের সময় কাটত। আর অনন্তের দিকে তাকিয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে কেঁদে ফেলত। অনন্ত তার অশ্রু ধরে রাখার তীব্র চেষ্টা চালাত, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যেত।

হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষের সাদা রঙের অতিরিক্ত ঝলকে ঘরটা ভীষণ কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে। ওদিকে কোন এক অযাচিত কারণে চৈতীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ। মায়ের এবং অনন্তের পরিচিত কয়েকজন এলো মা’কে দেখতে। ওদের দিকে এমনভাবে তাকালো মনে হল সে জীবনে মানুষ দেখেনি। এবং পোশাকে আচ্ছাদিত অংশ বাদ দিলে তাদের কোন কিছু অনন্তের নজর এড়াল না। সবার চোখেমুখে এক ধরনের ভয় আর বিষণ্নতার কালো ছায়া রেখাপাত করে যাচ্ছে। কোন এক শব্দ অনন্তকে হকচকিয়ে দিল। না, বন্ধ জানালার ফাঁক বেয়ে গড়িয়ে পড়া শব্দ। আবার সব চুপচাপ হয়ে গেল। এক এপ্রন পরিহিত সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া নার্সের আতিথেয়তায় অনন্ত মুগ্ধ হল। ওর কন্ঠস্বর বেশ মধুর, অসাধারণ, একটু কাঁপা কাঁপা, যা ওর মুখের আকৃতির সঙ্গে কিছুটা বেমানান। সূর্যের আলোটা প্রচণ্ড তাপদাহে জ্বলতে শুরু করল ওদিকে মনেও সে আগুন দাবানলের মত জ্বলতে লাগলো। মায়ের জন্য ঔষধ নিতে একটি ফার্মেসি’র দিকে যাচ্ছে অনন্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে মোবাইলে একটি কল বেজে উঠল। অনন্ত আশা করছিল এই বুঝি চৈতীর বার্তা। কিন্তু না তার থেকে উল্টো কোন বার্তা। চৈতী’র বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে...।

 নিশ্চুপ, নিথর হয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গেল রাস্তার মাঝখানে। অল্পের জন্য বেঁচে গেল গাড়ি চাপা থেকে। ক্ষাণিক পর সে স্থির হল। ঔষধ নিয়ে হাসপাতালে ফিরতে ফিরতে একটা কালো রেখা অন্ধকার করে দিল সকল আলোকে। কান্নার বিশাল রোল পড়ে গেল হাসপাতালের ওই কক্ষে। তার মা আর জীবিত আত্মার সাথে খেলা করল না। সেই কান্না আকাশ এবং বাতাসের কানে স্পন্দিত হতে হতে মায়ের মৃত দেহটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। মায়ের মৃত শরীরকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু হল অনন্তের। হাতের ঔষধ পড়ে গেল মাটিতে। দেখতে আসা একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এমন কাঁদছে যেন কখনই তার কান্না থামবে না। অনেকের বুক বেয়ে দীর্ঘশ্বাস সীমাহীন গতিতে বেরুতে লাগল। বাবা অনেক আগেই চলে গেছে। মা চলে যাওয়াতে আজ নিঃসঙ্গতার আকাশ ভারী হয়ে গেল। যে আকাশের সমস্ত পরিধি জুড়ে একটি তারা। বড় একা।

ওখানে প্রায় দু’ঘন্টা কাটিয়ে দিল অনন্ত। এরপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল মায়ের শবদেহ নিয়ে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতে দেখা গেল চৈতীদের বাড়ি থেকে বিয়ের সানাইয়ের সুর ভেসে আসতে লাগলো সে সুর তার মনের গভীরে গিয়ে ওলোট পালোট শুরু করল। একদিকে মায়ের মৃত্যু, অন্যদিকে প্রিয় জনার অন্যের হাত ধরে চলে যাওয়ার তীব্র যন্ত্রণা। বুকের ভিতর ছিঁড়ে যাচ্ছে। মায়ের মাটি দেওয়া সম্পন্ন হল। সে আস্তে আস্তে ঘরে ফিরল। চোখ বেয়ে তখনো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মাটির বুকে। সে ভাবছে মা বিহীন, চৈতী বিহীন বিশ্ব ভালোই চলছে, হয়তো চলবে।

কয়েক দিন হয়ে গেল খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত করা হয় না অনন্তের। এক দিন অনন্ত মনের প্রশান্তির জন্য হাঁটা শুরু করলো অজানা গন্তব্যে। কিন্তু হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। কি জানি কিসের আভাস পাচ্ছে। অদ্ভুত এক গন্ধ। চারিদিক থেকে আরও গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে অনির্দিষ্ট কিছু ডাকছে। কিন্তু সে ওই গন্ধ অনুসরণ করে চলছে। বাতাসের খেলায় গন্ধটা বিলীন হয়, আবার ফিরে আসে স্বরূপে। প্রবল আকুতি এবং মিনতি বাসা বাঁধে বুকের ভিতর। গন্ধটা হারায়নি তো! পথ চিনতে বেগ পেতে হচ্ছিল। রোদ, সোনালী চাঁদ, আলো, হাওয়ার কোন কিছুর অর্থ তাকে বিচলিত করছে না। জন্ম বা মৃত্যুর কোন চিন্তা নেই। পিছু কোন টান নেই। গন্ধের অদৃশ্য রেখাটা মাটিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে থমকে যায়, মনে হয় কে তাকে ডাকে। কিন্তু সাড়া দেওয়ার ইচ্ছেটুকুনও তার নেই। ফাঁকা মাঠের এক কোণে কে যেন চুপ করে বসে আছে। হাঁটুতে তোলা মুখ, চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে মাটিতে, আর এক হাতে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছে। মেয়েটির সামনে অনন্তের ছায়া পড়ে কিন্তু মেয়েটি বিন্দু পরিমাণও বিস্মিত হয় না। এ যে চৈতী! মাথায় এখনও তাজা সিঁদুরের চিহ্ন। ক্ষাণিক পর দু’জন দু’জনের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। চৈতী আস্তে উঠে দাঁড়ায়, মৃদু স্বরে বলে তুমি! অনন্তের মনের ভিতর আগুনের সীমাহীন তেজ সব কয়লা করে দিচ্ছে। আর লক্ষ ঢেউ আছড়ে পড়ছে শূন্য মনে। একে কি কিছু বলার আছে?

বাংলাদেশ সময় ১৬০০, এপ্রিল ৮, ২০১২
সম্পাদনা : ফেরদৌস মাহমুদ, শিল্প-সাহিত্য সম্পাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।