ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

কৃষি

ঘাস লাগিয়ে কোটিপতি গফুরের পথে হেঁটে লাখোপতি আরও ২০০ চাষি

মোমেনুর রশিদ সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৩৯, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
ঘাস লাগিয়ে কোটিপতি গফুরের পথে হেঁটে লাখোপতি আরও ২০০ চাষি ঘাস কাটছেন আব্দুল গফুর মিয়া।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে সুলতানপুর বড়ইপাড়া গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দা চাষি আব্দুল গফুর মিয়া।

নেপিয়ার ঘাস চাষ করে দিনমজুর থেকে কোটিপতি বনে গেছেন তিনি। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও। ওই চাষির দেখানো পথে হেঁটে গ্রামের দুই শতাধিক কৃষক এখন লাখোপতি। বর্তমানে গ্রামটির প্রায় সবাই কমবেশি ঘাস চাষে জড়িত। ফলে গ্রামটিকে এখন মানুষ ‘ঘাসের গ্রাম’ নামে চেনে। গ্রামটিতে গেলেই চোখে পড়বে মাঠের পর মাঠ ছোট-বড় ঘাসের ক্ষেত। চাষিদের কেউ ঘাস রোপণ-পরিচর্যায় ব্যস্ত, কেউ ঘাস কাটছেন, কেউবা আঁটিভর্তি ঘাস ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন বিক্রির জন্য।

নেপিয়ার ঘাসের ক্ষেত।

কিছু দূর এগিয়ে দেখা মেলে ঘাসের গ্রামের রূপকার আব্দুল গফুর মিয়ার সঙ্গে। তিনি ঘাসের জমিতে নিড়ানি দিচ্ছেন। সফলতার গল্প শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ছোট থেকে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। সহায়-সম্বল হিসেবে ছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া আড়াই বিঘা জমি। সাংসারিক সচ্ছলতার আশায় বড় ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ২০০৩ সালে সবটুকু জমি বিক্রি করে তিন লাখ টাকা তুলে দেই এক দালালের হাতে।

এরপর প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ি। কোনো উপায় না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে শুরু করি দিনমজুরের কাজ। গাছ কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন শ্রম দিয়ে দিন হাজিরার ১শ থেকে দেড়শ টাকা দিয়ে কোনোমতে চলছিল ছয় সদস্যের সংসার।  

তিনি বলেন, বছরের শেষের দিকে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাভী কিনি। পরে এলাকার এক খামারি পরামর্শে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে নেপিয়ার জাতের ঘাসের চারা সংগ্রহ করে ১০ শতক বসতভিটার পাঁচ শতাংশ জমিতে লাগাই।   এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরেধীরে বাড়তে থাকে ঘাসের চাষ ও গবাদিপশুর সংখ্যা। বর্তমানে ঘাস চাষ ছড়িয়েছে ২২ বিঘা জমিতে। এর মধ্যে ১০ বিঘা নিজের, ১২ বিঘা বন্ধক নেওয়া। এক বিঘা জমিতে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১২ হাজার টাকা। এক বিঘা জমি থেকে তিন বছর ঘাস পাওয়া যায়। তিন বছরে আয় হচ্ছে প্রায় তিন লাখ টাকা।

নেপিয়ার ঘাসের ক্ষেত।

ঘাস বাজারজাত সম্পর্কে এ উদ্যোক্তা বলেন, প্রতিদিন সকাল-বিকেল ঘাস কেটে ভ্যানে করে পলাশবাড়ী সদরসহ ঢোলভাঙ্গা, ধাপেরহাট, মাঠেরহাট এবং পাশের উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করা হয়। চার কেজি ওজনের প্রতি আঁটি ঘাস বর্তমান বাজারে ১০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন চার থেকে ৬/৫ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি হয়। সব খরচ বাদে ঘাস বিক্রি করে তার মাসিক আয় লাখ টাকার ওপরে।

সফল ঘাষ চাষি আব্দুল গফুর বলেন, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি চাষের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ২০১৪ সালে তিনি কৃষি পুরস্কার পান। পুরস্কার হিসেবে একটি সনদ ও একটি রৌপ্যপদক দেওয়া হয়।

আব্দুল গফুর জানান, বর্তমানে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ বিভাগের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে তাকে আহ্বান জানানো হয়। তিনি তার সংগ্রামী জীবনের সফলতার গল্প বলে কৃষকদের ঘাষ চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। সেই সঙ্গে বাস্তব জীবনে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।



এদিকে আব্দুল গফুরের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের প্রায় সব কৃষকই অন্যান্য সফলের পাশাপাশি কম-বেশি ঘাস চাষ করছেন। এরমধ্যে দুই শতাধিক কৃষক নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে তারা পরিণত হয়েছেন লাখোপতি। তাদের সবার কথায় বাঁধভাঙা আনন্দ।

তাদের মধ্যে বাচ্চু মিয়া, মাসুদ মিয়া, আব্দুল করিম, বারি মিয়া ও শহিদুল ইসলাম জানান, সুলতানপুর বাড়াইপাড়া গ্রামের ঘাষ চাষিদের সফলতায় পলাশবাড়ী উপজেলাসহ পাশের জেলার মানুষদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ঘাসের গ্রাম দেখতে আসেন। তাদের মধ্যে যারা ঘাস চাষে আগ্রহী তারা পরামর্শ নিয়ে যান।

তারা আরও বলেন, এলাকার ঘাস চাষিদের কারও মাটি কিংবা টিনের ঘর নেই। সবাই পাকাবাড়ি বানিয়েছেন। সবার অভাবের সংসারে এসেছে সচ্ছলতা।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, প্রাণীর উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে আপামর জনসাধারণের দুধ ও আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষে প্রাণিসম্পদ বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।  

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘাস কম খাওয়ানোর ফলে গাভীর যে উৎপাদনশীলতা, সেটা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এটা জানার পর প্রাণী পুষ্টির চাহিদা পূরণে ঘাস চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রকল্প গৃহীত হয় এবং তা এখনও চালু আছে। ওই প্রকল্পের আওতায়ে ঘাস চাষ সম্প্রসারণে এলাকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি।  

প্রাপ্ত ফলাফল সম্পর্কে তিনি বলেন দেখা যাচ্ছে, যারা গাভীকে দানাজাতীয় খাবার কম খাইয়ে ঘাস বেশি খাওয়াচ্ছে তারা প্রতিবছরই একটি করে বাছুর পাচ্ছে। একইসঙ্গে গাভীর দুধ উৎপাদন দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে।  

‘ঘাসের গ্রাম’ নামকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, এর সম্পূর্ণ অবদান সফল ঘাষ চাষি আব্দুল গফুর মিয়ার। তার দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা সফলতা ও তার সাফল্যে গ্রামের প্রায় সবাই কম-বেশি ঘাষ চাষে জড়িত। এরমধ্যে সফলতাও পেয়েছেন কমপক্ষে দুই শতাধিক চাষি। এখন দূর থেকে যখন কেউ এ গ্রামের আসতে চান তখন ‘ঘাসের গ্রাম’ বললেই সবাই দেখিয়ে দেন।

এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।