ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯

সেই স্টোকসই ইংল্যান্ডকে এনে দিলেন বিশ্বকাপ

হুসাইন আজাদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৯
সেই স্টোকসই ইংল্যান্ডকে এনে দিলেন বিশ্বকাপ

কলকাতার ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা মনে আছে? বিশ্বকাপ জেতার জন্য শেষ ওভারে ইংল্যান্ডের হাতে পুঁজি ছিল ১৯ রান। ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগান বল হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বোলার বেন স্টোকসের হাতে। কিন্তু পুরো ওভার করতে পারলেন না স্টোকস। ৪ বলে ৪টি ছক্কা মেরেই খেলা শেষ করে দেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কার্লোস ব্রাথওয়েট। মাঠেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফুপিয়ে কেঁদেছিলেন স্টোকস। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রাও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে পারছিলেন না।

তিন বছর পর আবার কাঁদলেন স্টোকস। অঝোরে কাঁদলেন।

তার সঙ্গে সতীর্থদেরও চোখ মুছতে দেখা গেলো। তবে এবারের কান্না সেবারের মতো বেদনার কান্না নয়। এবারের কান্না বিজয়ের আনন্দের। যে বিজয়ের কারিগর, রূপকার অথবা চিত্রকর খোদ তিনিই। তার অবিশ্বাস্য-অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের সুবাদেই আইসিসির সবচেয়ে বড় আয়োজন ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক্রিকেটের জনক দেশ ইংল্যান্ড। ফাইনালের মঞ্চটা যতোখানি রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে, তার প্রায় সবটুকুনই যেন স্ফূরিত হয়েছে স্টোকসের ব্যাট থেকে। ম্যাচ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডকে স্বপ্নের পথে তুলে বহুলকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছেন তিনিই। ব্যাটিংয়ে আক্রমণাত্মক স্টাইলে বেন স্টোকসক্রিকেটের মক্কাখ্যাত লর্ডসে ২৪২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে প্রথম থেকেই ধুঁকছিল ইংল্যান্ড। ২০তম ওভারে তৃতীয় উইকেটের পতন হওয়ার পর স্কোরকার্ডে তখন সংগ্রহ ৭১। সেসময় মাঠে নামেন বেন স্টোকস। ২৪তম ওভারে স্কোরবোর্ডে যখন ৮৬ রান, তখন ইয়ন মরগান অর্থাৎ চতুর্থ উইকেট পড়ে গেলে অনেকে কিউইদের প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন দেখতে শুরু করেন। সেসময় মাঠে নামলেন জস বাটলার। এরপর এই বাটলারকে সঙ্গে নিয়ে স্টোকস যা করলেন, তা নিয়ে ইংল্যান্ডের ক্রিকেটভক্তরা তাদের নাতি-পুতিদের কাছে গল্পও করতে পারবেন।

ওভারপ্রতি তখনো দরকার প্রায় ৬ রান করে। আসছিল ৪ রান করে। প্রতি বিশ্বকাপে কি আর ফাইনাল খেলা যায়? সামনের বিশ্বকাপ অবধি দলেইবা থাকার নিশ্চয়তা কী? ফাইনালের এ মঞ্চ থেকে খালি হাতে ফেরা যাবে না ভেবে স্টোকস যেন ‘রণনীতি’ সাজালেন নতুন করে। বাটলারকে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পার্টনারশিপ গড়তে লাগলেন। ইনিংস মেরামতের স্বার্থে ওভারে ৪ রান, ৩ রান, ২ রান সংগ্রহ করে মেডেন পর্যন্ত হজম করেছেন। তবে জুটি ক্রিজে সেট হয়ে যেতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন দু’জন। ১০-১২ ওভার আগেও যখন মনে হচ্ছিল, ম্যাচেই ইংল্যান্ড ফিরতে পারছে না, ১০-১২ ওভার পরে এসে স্টোকস-বাটলার জুটির ব্যাট শোনাতে লাগলো আশার কথা। ওভার যত গড়িয়েছে লর্ডসে চড়া হতে থাকলো ইংলিশ সমর্থকদের হর্ষধ্বনি।

স্টোকস-বাটলার জুটি ১১০ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ইংল্যান্ডকে দেখিয়ে দেয় জয়ের বন্দর, ‘ওইতো, আরেকটু পথ!’ এই জুটি ভেঙে ৪৫তম ওভারে বাটলার ৫৯ রান করে আউট হয়ে যখন ফিরছিলেন, ইংল্যান্ড তখন জয় থেকে ৪৬ রান দূরে, হাতে ৩১ বল। কিন্তু ফাইনালের মঞ্চ যে রোমাঞ্চের ঢালা লুকিয়ে রেখেছিল, কে জানতো? নিয়মিত বিরতিতে উইকেট খুইয়ে ইংল্যান্ড আবার ব্যাকফুটে চলে যায়। কিন্তু তখনো যে মাঠে স্টোকস আছেন! শেষ ৩ ওভারে দরকার ৩৪ রান। ৪৮তম ওভারে আসে ১০ রান। ৪৯তম ওভারে আসে ৯ রান। এই অবস্থায় শেষ ওভারের সমীকরণ ১৫ রান।  

প্রথম দুই বল ট্রেন্ট বোল্ট আদায় করেন ডট। কিন্তু তৃতীয় বলে ছক্কা মেরে খেলা আবার বাগে নিয়ে আসেন স্টোকস। ৩ বলে দরকার ৯ রান। তখন বোল্টের করা একটি ফুলটস স্টোকস মিডউইকেটের দিকে ঠেলে দিয়ে দুই রান নিতে চাইলে উইকেটকিপারের দিকে থ্রো করেন ফিল্ডার মার্টিন গাপটিল। ডাইভ দিতে দিতেই সেই বলটি নিজের গায়ের দিকে আসছে দেখে ব্যাট পেতে দেন স্টোকস। থ্রোটি ব্যাটে লেগে চলে যায় বাউন্ডারিতে। দৌড়ে নেওয়া দুই রানের সঙ্গে যোগ হয় ৪, সবমিলিয়ে ৬। শেষ ২ বলে দরকার ৩। স্ট্রাইকিং প্রান্তে স্টোকস। পঞ্চম বলে ২ রান নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান আদিল রশিদ, আর শেষ বলেও স্ট্রাইকিংয়ে স্টোকস। ২ রান নিতে গিয়ে আউট হয়ে যান মার্ক উড। স্কোর হয়ে যায় সমান, অর্থাৎ ম্যাচ টাই। স্টোকস তখন হাঁপাচ্ছিলেন, বড় বড় শ্বাস ফেলছিলেন।

ফলাফল নির্ধারণে খেলা গড়ায় সুপারওভারে। এবারও বাটলারকে নিয়েই ‘যুদ্ধ’ করতে নামেন সেই স্টোকস। আগের ইনিংসে স্টোকস যে ৮৪ রান সংগ্রহ করেছেন তার মধ্যে ৪২ রান আসে বাউন্ডারিতে, বাকি ৪২ রান তিনি নেন দৌড়ে! ব্যাট হাতে মাঠে ছিলেন ১৪৭ মিনিট। শেষ দিকে দৌড়ে রান নিতে গিয়ে তিনি যে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন, ক্যামেরায় ধরা পড়ছিল বারবার। চোখ মুদে আসছিল ক্লান্তিতে। সেই স্টোকসকেই আবার নামতে দেখে অনেকের চক্ষুচড়ক দশা। কিন্তু স্টোকস কি দমবার পাত্র? বোল্টেরই করা সুপারওভারে স্টোকস ১টি চারের মারে তোলেন ৮ রান, আর বাটলারও ১টি চারের মারে তোলেন ৭ রান। এই ১৫ রানই হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের শিরোপা জেতার পুঁজি। ১৬ রানের টার্গেট ব্যাট করতে নেমে নিউজিল্যান্ড ১৫ রান তুলে স্কোর সমান করলেও ইনিংসে বাউন্ডারির হিসাবে জিতে যায় ইংল্যান্ড, স্টোকসের দল।

আম্পায়াররা ইংল্যান্ডের জয়ের সংকেত দিতেই ক্যামেরার আলো যায় স্টোকসের দিকে। গোটা ব্যাটিং ইনিংসে বুক চিতিয়ে লড়াই করা খেলোয়াড়টা অবিশ্বাস্য বিজয়ের আনন্দে তখন কাঁদছিলেন। সতীর্থরা যখন পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন, স্টোকস যেন আরও আবেগে ডুবে যাচ্ছিলেন। আহা! বছরতিনেক আগে এই মানুষগুলো তাকে পিঠ চাপড়ে বলেছিল, ‘বন্ধু ভেঙে পড়ো না, উঠে দাঁড়াও!’ তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন বলেই না সময় কী সুন্দর উপহার দিলো তাকে!

বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ এর সর্বশেষ