ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯

মন ভাঙে, তবু মনোবল ভাঙে না

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ৩, ২০১৯
মন ভাঙে, তবু মনোবল ভাঙে না চলমান বিশ্বকাপে সাকিবের পাশাপাশি ব্যাটে-বলে নজর কেড়েছেন সাইফউদ্দিন

আফগানিস্তানকে হারানোর পরপরই  সাংবাদিক সম্মেলনে সাকিব আল হাসানকে প্রশ্ন করা হয়, ‘সাকিব আপনি যখন ভালো করেন, তখন সবাই একসঙ্গে প্রশংসা করেন, আবার যখন খারাপ করেন তখন সবাই একযোগে সমালোচনা করেন, এটি আপনি কীভাবে দেখেন?’ সাকিব এক শব্দেই উত্তর দিলেন- ‘দেখিই না!’ এই যে এতোটা সাবলীলভাবে জানিয়ে দিলেন, এতে যেনো পুরো দলের মনোবলই ফুটিয়ে তুললেন তিনি। তাই বলে কি আসলেই তাদের মনে কখনোই আঁচড় লাগে না!

অবশ্যই লাগে, তবে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে সেটিকে এড়িয়ে চলাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু সমালোচনা ক্রিকেটারদের মনে ঠিকই অনেক বড় দাগ কেটে যায়।

বিশেষ করে খুব অল্পতেই আমরা ক্রিকেটারদের আন্তরিকতা বা পেশাদারিত্ব অথবা দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেলি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইস্যুগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক থাকে। দলের হয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে আসা তরুণ সাইফউদ্দিনের মনেও তেমন আঁচড় লেগেছিলো খানিকটা। কিন্তু পেশাদারিত্বের ছোঁয়ায় সেটি তিনি কাটিয়ে উঠেছেন বুক চিতিয়ে লড়াই করেই। তার ওপর অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইচ্ছে না করে খেলার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। পরবর্তীতে যদিও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছেন স্বয়ং দলের কোচ ও ম্যানেজারসহ সবাই। তবে মনে কিন্তু কিছুটা দাগ লেগেছে নিশ্চিত, সেই দাগকে মনে ধারণ না করে নিজের কাজটি ঠিকঠাক করার প্রতিই মনোযোগ দিয়েছিলেন সাইফ। আর সে কারণেই আফগানিস্তানের সঙ্গে পরবর্তী ম্যাচেই নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছিলেন।

বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির পর সাকিবের মৃদু উদযাপন।  ছবি: সংগৃহীত

তাই কে নেতিবাচক ভাবলো, কে কী নেতিবাচক সমালোচনা করেছিল, সেটা অতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু আইসিসি ঠিকই সাইফের প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুধাবন করেছিল। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগারদের প্রথম ম্যাচে জেতার পরই নিজেদের অফিসিয়াল পেইজে কাভার করেছিলো মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে। মনে আছে নিশ্চয়ই, চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু এটি।

সাকিব-সাইফের উদযাপন।  ছবি: সংগৃহীত

দেশের ক্রিকেটে আমাদের প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়ে দিতে বিশ্বসেরা সাকিবের পাশাপাশি একজন দৃঢ়প্রত্যয়ী সাইফ অনেক বড় বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে। এই দু’জনের মাঝে একটা দারুণ মিল দেখতে পাই আমি। এদের মন ভাঙে তবে মনোবল ভাঙে না। সাকিব গত এক যুগ ধরে আমাদের দেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ও ঈর্ষণীয় পারফর্মার। তবে এই সাকিবেরই চুন থেকে একটু নুন খসলেই চলে ‘তীর-ধনুকের খেলা’। কখনো কখনো সুযোগ পেলে ব্যক্তিজীবনেও আঘাত চলে আসে। এতে সাকিবের নিশ্চয় মন খারাপ হয়।

উদযাপনে সাকিব-সাইফ, রুবেল-সাব্বির।  ছবি: সংগৃহীত

তরুণ সাইফের ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষণীয়, একেবারে অল্পতেই তার প্রতি বিষোদ্গার শুরু হয়ে যায়। একটু এদিক-সেদিক হলেই ‘গেলো গেলো’ রব ওঠে। যেখানে এখনো তার ক্যারিয়ারের শুরুই হয়নি ঠিকভাবে। মনে খানিকটা চোট লাগা স্বাভাবিক। তবে মনোবল ধরে রেখে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতেই তিনি বদ্ধপরিকর। সাকিব-সাইফ চলতি বিশ্বকাপে এটির প্রমাণ দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। পারফর্মার হিসেবে সাকিব যেমন ভেতর থেকে অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চটা নিংড়ে দিয়েছেন, তেমনি চলতি বিশ্বকাপে ‘মোস্ট ইমার্জিং প্লেয়ার’ হিসেবে সাইফও সেই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হতে পেরেছেন।

ভারতের বিপক্ষে সাইফউদ্দিনের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের একটি মুহূর্ত।  ছবি: সংগৃহীত

গতকাল শিরোপা প্রত্যাশী ভারতের সঙ্গে ম্যাচে দলের সেরা পারফর্মার সাকিবের প্রস্থানের পর সাইফকে ঘিরেই নতুন করে স্বপ্ন বুনেছিল দেশের কোটিপ্রাণ সমর্থক । কাল হয়তো শেষটা ভালো হয়নি নানা কারণে, তবে সক্ষমতার বড় পরীক্ষায় বড় মঞ্চে বড় দলের সঙ্গে নান্দনিকভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন এই তরুণ অলরাউন্ডার। গতকাল তার ৩৮ বলে অপরাজিত ৫১ রান হয়তো সংখ্যার বিচারে বড় কিছু নয়। তবে পরিস্থিতি বিচারে এটি অনেক বার্তাবাহী। টিম ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত মিডলঅর্ডারে একটু পরিবর্তন এবার আনতেই পারে, কঠিন সময়ে একজন নির্ভরশীল ব্যাটসম্যানের প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে ম্যাচে। একটু ওপরে খেলার যোগ্যতা সাইফের আছে। তার প্রমাণ সাইফ রেখেছেন।

বিশ্বকাপে বল-ব্যাটে অনন্য-অসাধারণ সাকিব।  ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেট বোর্ডে এখন এই রত্নগুলোর অধিক দেখভাল করা জরুরি। তাদের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। পান্ডিয়া বা স্টোকস হিসেবে নয়, সাইফকে গড়ে তোলা হোক সাইফউদ্দিন হিসেবেই। যেন ১০ বছর পর বলতে পারি, ‘আমাদের একটা সাইফউদ্দিন আছে’। যেমনটা এখন আমরা সাকিবকে নিয়ে বলি।

সাকিবের সাকিব হয়ে ওঠার পেছনেও কিন্তু কম জলঘোলা হয়নি। তাই এই তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের প্রতি দেশের মানুষ বা মিডিয়াকেও কিছুটা দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। ‘তিলকে তাল’ না করে ইতিবাচকভাবে পথ ধরিয়ে দিতে পারলেই দেশের ক্রিকেটের জন্য উত্তম। বুঝতে হবে সবাই সাকিব নয়। তাই সাকিবের মতো অধিক পারফর্ম করে সেসব কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য সবার নাও থাকতে পারে।

সাকিব-সাইফের উদযাপনে সঙ্গ দিতে আসছেন অধিনায়ক মাশরাফি।  ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটে মনোবল বা মাইন্ড গেইমই সবচেয়ে বড় বিষয়। সেমিফাইনালে যেতে না পারলেও বিশ্বকাপজুড়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত ক্রিকেট খেলেছে বলে আমি মনে করি। ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে বেশ। খেলোয়াড় ও টিম ম্যানেজমেন্টের কথা অনুযায়ী এটি সম্ভব হয়েছে, মনোবলের জোরেই। তাই আমাদের কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মী ও দেশের আপামর সমর্থকদের সম্মিলিতভাবেই খেয়াল রাখতে হবে, এই যেন সহজে মনোবলটা হারিয়ে না যায়। তবেই একদিন দেখা হবে বিজয়ে, সেদিন আসছে শিগগিরই।

ভারতীয় দল ও সমর্থকদের চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল সাইফউদ্দিনের লড়াকু ব্যাটিং।  ছবি: সংগৃহীত

প্রাসঙ্গিকভাবে গত ১৫ বছরে এদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছুই দিয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ মাশরাফি। এটি ভুলে যাবার কিংবা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সবার প্রিয় ম্যাশের আরও অনেক কিছুই দেয়ার আছে হয়তো, তবে সেটি খেলোয়াড় হিসেবেই দিতে হবে, তা কিন্তু নয়। দিন শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একটি পেশাদার দল, তাই এখানে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নিয়ে কথা হবেই। বিশ্বকাপে খেলা ৬টি ম্যাচে দলের হয়ে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন এক সময়ের দেশসেরা এই পেসার। গতকাল দলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অধিনায়কের পারফরম্যান্স ভালো হলে ফলাফল হয়তো অন্য রকম হতো। তাই ভাবনার করিডোরে আমাদের বাস্তবতার নিরিখে ভাবতেই হবে। মাশরাফিও হয়তো ঠিকই ভাবছেন। বাংলাদেশ দলের জন্য অনেক ভালোবাসা আর শুভকামনা। আবারো ‘দেখা হবে বিজয়ে’।

লেখক
সার্টিফায়েড ক্রিকেট আম্পায়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্রিকেট আম্পায়ার অ্যান্ড স্কোরার অ্যাসোসিয়েশনে, ফেনী জেলা

বাংলাদেশে সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৯
এমএমইউ/এমএমএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ এর সর্বশেষ