অবশ্যই লাগে, তবে পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে সেটিকে এড়িয়ে চলাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু কিছু সমালোচনা ক্রিকেটারদের মনে ঠিকই অনেক বড় দাগ কেটে যায়।
তাই কে নেতিবাচক ভাবলো, কে কী নেতিবাচক সমালোচনা করেছিল, সেটা অতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। কিন্তু আইসিসি ঠিকই সাইফের প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুধাবন করেছিল। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগারদের প্রথম ম্যাচে জেতার পরই নিজেদের অফিসিয়াল পেইজে কাভার করেছিলো মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকে। মনে আছে নিশ্চয়ই, চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু এটি।
দেশের ক্রিকেটে আমাদের প্রত্যাশার পারদ বাড়িয়ে দিতে বিশ্বসেরা সাকিবের পাশাপাশি একজন দৃঢ়প্রত্যয়ী সাইফ অনেক বড় বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে। এই দু’জনের মাঝে একটা দারুণ মিল দেখতে পাই আমি। এদের মন ভাঙে তবে মনোবল ভাঙে না। সাকিব গত এক যুগ ধরে আমাদের দেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ও ঈর্ষণীয় পারফর্মার। তবে এই সাকিবেরই চুন থেকে একটু নুন খসলেই চলে ‘তীর-ধনুকের খেলা’। কখনো কখনো সুযোগ পেলে ব্যক্তিজীবনেও আঘাত চলে আসে। এতে সাকিবের নিশ্চয় মন খারাপ হয়।
তরুণ সাইফের ক্ষেত্রেও একই চিত্র লক্ষণীয়, একেবারে অল্পতেই তার প্রতি বিষোদ্গার শুরু হয়ে যায়। একটু এদিক-সেদিক হলেই ‘গেলো গেলো’ রব ওঠে। যেখানে এখনো তার ক্যারিয়ারের শুরুই হয়নি ঠিকভাবে। মনে খানিকটা চোট লাগা স্বাভাবিক। তবে মনোবল ধরে রেখে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতেই তিনি বদ্ধপরিকর। সাকিব-সাইফ চলতি বিশ্বকাপে এটির প্রমাণ দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। পারফর্মার হিসেবে সাকিব যেমন ভেতর থেকে অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চটা নিংড়ে দিয়েছেন, তেমনি চলতি বিশ্বকাপে ‘মোস্ট ইমার্জিং প্লেয়ার’ হিসেবে সাইফও সেই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হতে পেরেছেন।
গতকাল শিরোপা প্রত্যাশী ভারতের সঙ্গে ম্যাচে দলের সেরা পারফর্মার সাকিবের প্রস্থানের পর সাইফকে ঘিরেই নতুন করে স্বপ্ন বুনেছিল দেশের কোটিপ্রাণ সমর্থক । কাল হয়তো শেষটা ভালো হয়নি নানা কারণে, তবে সক্ষমতার বড় পরীক্ষায় বড় মঞ্চে বড় দলের সঙ্গে নান্দনিকভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন এই তরুণ অলরাউন্ডার। গতকাল তার ৩৮ বলে অপরাজিত ৫১ রান হয়তো সংখ্যার বিচারে বড় কিছু নয়। তবে পরিস্থিতি বিচারে এটি অনেক বার্তাবাহী। টিম ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত মিডলঅর্ডারে একটু পরিবর্তন এবার আনতেই পারে, কঠিন সময়ে একজন নির্ভরশীল ব্যাটসম্যানের প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ভারতের সঙ্গে ম্যাচে। একটু ওপরে খেলার যোগ্যতা সাইফের আছে। তার প্রমাণ সাইফ রেখেছেন।
ক্রিকেট বোর্ডে এখন এই রত্নগুলোর অধিক দেখভাল করা জরুরি। তাদের শক্তি ও দুর্বলতা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। পান্ডিয়া বা স্টোকস হিসেবে নয়, সাইফকে গড়ে তোলা হোক সাইফউদ্দিন হিসেবেই। যেন ১০ বছর পর বলতে পারি, ‘আমাদের একটা সাইফউদ্দিন আছে’। যেমনটা এখন আমরা সাকিবকে নিয়ে বলি।
সাকিবের সাকিব হয়ে ওঠার পেছনেও কিন্তু কম জলঘোলা হয়নি। তাই এই তরুণ সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের প্রতি দেশের মানুষ বা মিডিয়াকেও কিছুটা দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। ‘তিলকে তাল’ না করে ইতিবাচকভাবে পথ ধরিয়ে দিতে পারলেই দেশের ক্রিকেটের জন্য উত্তম। বুঝতে হবে সবাই সাকিব নয়। তাই সাকিবের মতো অধিক পারফর্ম করে সেসব কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য সবার নাও থাকতে পারে।
ক্রিকেটে মনোবল বা মাইন্ড গেইমই সবচেয়ে বড় বিষয়। সেমিফাইনালে যেতে না পারলেও বিশ্বকাপজুড়ে বাংলাদেশ প্রত্যাশিত ক্রিকেট খেলেছে বলে আমি মনে করি। ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে বেশ। খেলোয়াড় ও টিম ম্যানেজমেন্টের কথা অনুযায়ী এটি সম্ভব হয়েছে, মনোবলের জোরেই। তাই আমাদের কর্মকর্তা, মিডিয়াকর্মী ও দেশের আপামর সমর্থকদের সম্মিলিতভাবেই খেয়াল রাখতে হবে, এই যেন সহজে মনোবলটা হারিয়ে না যায়। তবেই একদিন দেখা হবে বিজয়ে, সেদিন আসছে শিগগিরই।
প্রাসঙ্গিকভাবে গত ১৫ বছরে এদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছুই দিয়েছেন ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক’ মাশরাফি। এটি ভুলে যাবার কিংবা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ নেই। সবার প্রিয় ম্যাশের আরও অনেক কিছুই দেয়ার আছে হয়তো, তবে সেটি খেলোয়াড় হিসেবেই দিতে হবে, তা কিন্তু নয়। দিন শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল একটি পেশাদার দল, তাই এখানে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নিয়ে কথা হবেই। বিশ্বকাপে খেলা ৬টি ম্যাচে দলের হয়ে একেবারেই নিষ্প্রভ ছিলেন এক সময়ের দেশসেরা এই পেসার। গতকাল দলের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অধিনায়কের পারফরম্যান্স ভালো হলে ফলাফল হয়তো অন্য রকম হতো। তাই ভাবনার করিডোরে আমাদের বাস্তবতার নিরিখে ভাবতেই হবে। মাশরাফিও হয়তো ঠিকই ভাবছেন। বাংলাদেশ দলের জন্য অনেক ভালোবাসা আর শুভকামনা। আবারো ‘দেখা হবে বিজয়ে’।
লেখক
সার্টিফায়েড ক্রিকেট আম্পায়ার, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্রিকেট আম্পায়ার অ্যান্ড স্কোরার অ্যাসোসিয়েশনে, ফেনী জেলা
বাংলাদেশে সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৯
এমএমইউ/এমএমএস/এইচএ/