ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস

প্রস্তর-নগরী মাচুপিচুর খোঁজে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৭
প্রস্তর-নগরী মাচুপিচুর খোঁজে পাহাড়ের কোলে বিস্ময়নগরী মাচুপিচু।

দক্ষিণ আমেরিকার যে বিশেষ স্থানটি থেকে প্রাচীন ইনকাদের হারানো প্রত্ন-রহস্যময় ‘মাচুপিচু’র সন্ধান আরম্ভ করতে হবে, তার নাম লিমা, পেরুর রাজধানী।

ওশিয়ানো প্যাসিফিকো বা প্রশান্ত মহাসাগরের মরুসদৃশ উপকূল এলাকার মধ্যে একফালি শ্যামল অঞ্চল লিমা। প্রশান্ত মহাসাগরের শীতল-হুমবোল্ট স্রোত আর মরুভূমির বাতাস---দুইয়ের প্রভাবে লিমার আকাশ সর্বদাই মাঝারি ঘনত্বের মেঘে ঢাকা এবং মাঝ রাত্রি থেকে ভোর পর্যন্ত কুয়াশা।

ওই শীতল স্রোত লিমাকে সারা বছর ১৮-২০ ডিগ্রি সেলসিয়ারের মধ্যে একটি ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় জড়িয়ে রাখে। লিমা নামটি বেশ পুরনো। স্পেনিয় ঔপনিবেশিক শক্তি দেশটিকে দখল করার আগে থেকেই এ নামটি প্রচলিত। স্থানীয় আইমারা ভাষায় লিমা বা লিশ্যক হচ্ছে হলুদ ফুল। আর কেচুয়া ভাষায় এর মানে কলস্বরা। রিমাক নামে যে নদীর তীরে লিমা শহরটি, কেচুয়া ভাষায় তারও অর্থ কলস্বরা নদী।

আন-অফিসিয়ালি বহু আগে হলেও, অফিসিয়ালি লিমার জন্ম ১৫৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি, স্পেনিয়ার্ড বিজেতা ফ্রান্সিস্কো পিজারোর হাতে। এই এলাকায় তখন বেশ কয়েকটি স্থানীয় আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা আমেরিন্ডিয়ান গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। ১৫৩২ সালে স্পেনিয়রা শেষ ইনকা সম্রাট আটাহুয়ালপাকে হারিয়ে পেরু দখল করে এবং এই অঞ্চলটিতেই রাজধানী গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ জায়গাটির যে নাম প্রথমে দেওয়া হয়েছিল, ‘সিটি অব দ্য কিংস’, তা শেষ পর্যন্ত টিকে নি, পুরনো নামটিই রয়ে যায়: লিমা। মাচুপিচু নগরীর কোথায় কি স্থাপনা।

লিমা থেকে যেতে হবে কুজকো। আন্ডিজ পর্বতমালার উপর দিয়ে প্লেনে যাওয়ার সময় দেখা যাবে ব্রোঞ্জরঙা একেকটি শৃঙ্গের ঢেউ খেলানো অবারিত জগৎ। এই পাহাড়েরই কোনও এক উপত্যকায় রয়েছে কুজকো: খাস ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানী। দক্ষিণ আমেরিকার প্রধান পুরাতাত্ত্বিক কেন্দ্রগুলোর একটি। ইনকা কিংবদন্তি অনুসারে ১৪৩৮ সাল নাগাদ পাচাকুটি শহরটিকে কেন্দ্র করে আধাঘুমন্ত ছোট্ট কুজকো রাজ্যকে সাপা ইনকা পরিণত করেন একটি বিশাল সাম্রাজ্যে। কেচুয়া ভাষায় কুজকো শব্দের অর্থ হল ‘নাভি’। কুজকোর উচ্চতা প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফুট। আসলে এটা একটা বড় উপত্যকা: আন্ডিজের দু‘টি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণীর মধ্যে যেন একটি পকেট। পৃথিবীর উপর সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির তীব্রতা এখানেই সবচেয়ে বেশি।

১৫৩৫ সালে স্পেনিয় বিজেতা কুজকো নগরী প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তার উপর গড়ে ওঠে নতুন স্পেনিয় শহর। প্রাচীন স্থাপত্যের কিছু অবশেষ এখনও বিদ্যমান। ইনকাদের স্থাপত্যশৈলী ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। গম্বুজওয়ালা প্রাচীন ইনকা প্রাসাদের দেওয়াল নির্মিত হয় গ্রানাইট পাথরের বৃহৎ এবং নিপুণভাবে কাটা লম্বা আয়তকার ব্লক দিয়ে। ব্লকগুলো এমন কৌশলে স্থাপিত হয়েছে যে ভূমি থেকে যতই উপরে উঠেছে ছাদ পর্যন্ত, একটু যেন সামনের দিকে হেলে রয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধে এই ব্যবস্থা খুবই কার্যকর, যা আয়ত্ত্বে ছিল প্রাচীন ইনকাদের।

ইনকারা ছিল ইনটি বা সূর্য উপাসক। তাদের প্রধান প্রার্থনাস্থল ছিল বিখ্যাত সূর্যমন্দির, যার নাম  ‘কোরিকাঞ্চা’। সূর্যদেবতার মন্দির, তাই ভিতরের দেওয়ালগুলো সোনার পাতে মোড়া। ইনকাদের আরও অনেক দেবতার নাম জানা যায়, যেমন: সৃষ্টির দেবতা, আকাশের দেবতা ইত্যাদি। পূজাস্থানের মেঝেতে পাথরে খোদাই করা প্রতীকচিহ্ন। ইনকা পূজায় বলির ব্যবস্থাও ছিল, কখনও বা নরবলি! সেখানেও রয়েছে প্রতীকচিহ্ন। কুজকো দখলের পর সূর্যমন্দিরের উপর স্পেনিয়রা তৈরি করে স্যান্টো ডোমিনগো চার্চ এবং কনভেন্ট। মাচুপিচু নগরীর খণ্ডচিত্র

ইনকা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয় ‘কুমারী ভবন’। আমৃত্যু কুমারী থাকা মেয়েদের সঙ্ঘবদ্ধ বসবাসের ধারণাকে ইনকা সভ্যতায় খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এজন্য ইনকা সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় তৈরি হয়েছিল কনভেন্ট ভবন। সে রকম একটি প্রধান ভবন কুজকোর ‘আক্লাহুয়াসি’ বা ‘টেম্পল অব দ্য ভার্জিনস অব দ্য সান’। এটা সূর্যমন্দির থেকে একটু দূরে। মনে করা হত, এই কুমারীরা ছিলেন নারী পুরোহিত; সূর্যপূজা বা বলিদানের সময় এরা মূল পুরোহিতকে সাহায্য করতেন। কিন্তু সূর্যমন্দির থেকে ভার্চিন টেম্পল-এর দূরত্ব বিবেচনার পর বোঝা যায়, ইনকা রাজারা চেয়েছিলেন সূর্যদেবের কাছে নিবেদিত এই কুমারীদের ভবনে যেন কোনও পুরুষের প্রবেশাধিকার না থাকে। কুমারীরা নির্বাচিত হতেন বংশ মর্যাদা আর সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী এবং সাধারণভাবে রাজার বা রাজ-পরিবার-সংশ্লিষ্ট মেয়েরাই শুধু নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ ও সৌভাগ্য পেতেন কুমারী মন্দিরে বসবাসের। নিখাদ কুমারীত্ব নিয়ে যাতে কোনও সন্দেহ বা সংশয় না থাকে, সে জন্য মেয়েদের আট বছর বয়সে কিংবা তারও আগে আলাদা করে নিয়ে আসা হত ‘আক্লাহুয়াসি’ বা ‘টেম্পল অব দ্য ভার্জিনস অব দ্য সান’-এ।   কুমারী ভবনে পনেরো শ’-এর বেশি নারী বাস করতেন। প্রবীণ নানদের বলা হত ‘মামাকুনা’। এরা এই নানারিতে অভিভাবকস্বরূপ মায়ের দায়িত্ব পালন করতেন।

ইনকা সাম্রাজ্যের মন্দিরবাসিনী কুমারীরা ছিলেন বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। শুধু রানী বা ‘কয়া’ এবং রাজকন্যারা এদের দেখতে পেতেন। ইনকা আইনে বলা ছিল, যদি কোন কুমারীর স্খলন ঘটে তবে তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা হবে এবং তার স্খলনের সহযোগী-সঙ্গীটিকেও হত্যা করা হবে। নানারিটির দেখভালের জন্য প্রভূত ক্ষমতা সম্পন্ন প্রায় পার্চ শ’ নারী নিযুক্ত ছিলেন। ‘আক্লাহুয়াসি’ বা ‘টেম্পল অব দ্য ভার্জিনস অব দ্য সান’-এ চিরকুমারীরা সূতো কাটা, বস্ত্র বোনা এবং নানা ধরনের পোশাক ও শিরোভূষণ তৈরি করতেন। এইসব তৈরি হত তাদের স্বামী সূর্যদেবের জন্য। যেহেতু এরা ছিলেন সূর্যবধূ, তাই তাদের ব্যবহার্য সমাগ্রী ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত। লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস বইয়ের প্রচ্ছদ

ইনকা আমলে রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ‘প্লাজা দ্য আরমাস’-কে বলা হত ‘হুয়াকেপাটা’ বা যোদ্ধাদের চত্বর। প্রতি বছর এখানে অনুষ্ঠিত হত ‘সূর্য উৎসব’ বা ‘ইনটি রাইমি’। ‘প্লাজা দ্য আরমাস’ থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠলে পাওয়া যাবে বিখ্যাত ইনকা ধ্বংসাবশেষ ‘স্যাকসাহুয়ামান’, ‘কেনকো’, ‘পুকা পুকারা’ এবং ‘ট্যাম্বোমাচা’। তারপর সেখান থেকে ‘ভিস্টাডোম কোচ’ নামের এক পার্বত্য পথে চলতে অভ্যস্থ ট্রেনে চেপে পৌঁছা যায় মাচুপিচু। আন্ডিজের দু‘টি ব্রোঞ্জরঙা সমান্তরাল শ্রেণীর মাঝখানের প্রশস্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলে। উপত্যকা কখনও বিস্তৃত হয়ে অনেকখানি ছড়িয়ে পড়ে; সেখানে অরণ্য, ঈষৎ হলুদ মেশানো সবুজ শস্যক্ষেত্র, লামা বা আলপাকা বা গরুর পাল, পার্বত্য স্রোতস্বিনী, ঝুল সাঁকো, পাকদণ্ডী মেঠো পথ, অচেনা পাখি আর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকা ক্ষিপ্রগতির নদী উরুবাম্বা। পথ কথনও নিরাবরণ পাহাড়ে মিশেছে, কখনও হয়েছে বনানীশোভিত। চূড়াগুলোও কোথাও কোথাও বরফে ঢাকা। ‘অগাস ক্যালিয়েন্টাস’ স্টেশনে রেল যাত্রার সমাপ্তি। ‘অগাস ক্যালিয়েন্টাস’ উরুবাম্বা নদী তীরে অবস্থিত। উরুবাম্বা অর্থ হল পবিত্র। কুজকো থেকে ‘অগাস ক্যালিয়েন্টাস’ আসতেই দিন ফুরিয়ে যাবে। সেখানে রাত কাটিয়ে রওয়ানা দিতে হয় মাচুপিচুর দিকে। ধরতে হয় ‘অগাস ক্যালিয়েন্টাস’ স্টেশনের সামনে থেকে মাচুপিচুগামী বাস।

উরুবাম্বা নদী পেরিয়ে বাস পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরতে ঘুরতে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ঘণ্টা খানেক পাকদণ্ডী পথ চলে পাহাড় শীর্ষের একটি বড় ও খোলামেলা চাতালে এসে বাস থামে। সামনে বিরাট বড় এক জমকালো গেট। গেটটি অতিক্রম করে এবার লাঠি হাতে পায়েদলে উঠতে হবে মাচুপিচু। পাহাড়ি রাস্তা ধরে একটু একটু করে এগুতে হবে। সুস্পষ্ট কোন পথ রেখা নেই, পথ তৈরি করে করেই সামনে এগুনোর পালা। পাহাড় প্যাঁচানো পথে অতঃপর বায়ে মোড়। তখনই দেখা যাবে, প্রস্তর প্রাচীর বেষ্টনীর পাশে, আকাশের নীচে মাথা তুলে দাঁড়ানো পাহাড়ের গায়ে উপর থেকে ক্রমশ নেমে এসেছে ছোট বড় নানা আকারের অজস্র বাড়ি-ঘর। ইট-কাঠের নয়,  সব পাথরের তৈরি। এক অভিনব প্রস্তর শহর। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, এত বড় বড় পাথরের ব্লক কোথা থেকে মানুষ বয়ে এতে এত উপরে কীভাবে তুলল!

‘মাচুপিচু স্থাপত্য’ সভ্যতার একটা অমূল্য প্রতীক। ইনকা সভ্যতার সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির  শ্রেষ্ঠ সময়ে ১৪৫০ সালে এই গৌরবময় নগর-প্রতীকটি তৈরি হয়। কিন্তু মাত্র এক শ’ বছর অতিক্রম করার আগেই শহরটির মৃত্যু হয়; মাচুপিচু হয়ে যায় পরিত্যক্ত নগরী! এর কারণ অবশ্যই ঔপনিবেশিক আক্রমণ। কেননা, তখন স্পেনিয় বিজয়ের ফলে বিশাল ইনকা সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিলুপ্ত হয়েছে। ইনকা হয় নিহত, নয় পালিয়ে গেছে। যদিও ইনকা রাজধানী কুজকো থেকে মাচুপিচু মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে, কিন্তু পথ এত দুর্গম আর ঘোরালো যে আগ্রাসী স্পেনিয়রা পর্যন্ত এই পার্বত্য শীর্ষের পাথুরে শহরটির সন্ধান পায় নি। ফলে শহরটি অক্ষত রয়ে যায়। পরিত্যক্ত হওয়ার পর স্থাপত্য-বিস্ময় মাচুপিচুকে ক্রমে ক্রমে ঢেকে ফেলে জঙ্গল। কয়েক শতাব্দি পর মানুষ ভুলেই যায় এর কথা। মাচুপিচু কেবল বেঁচে ছিল স্থানীয় কিছু বয়স্ক মানুষের লুক্কায়িত স্মৃতির ভিতরে। মাচুপিচুকে নিয়ে তৈরি হতে থাকে  নানা মিথ, উপকথা, আধিভৌতিক কল্প-কাহিনী। মাচুপিচু নগরীর খণ্ডচিত্র।

বিস্মৃতির অতল থেকে মাচুপিচুকে পুনরুদ্ধার করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলোজি বা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম। নানা কল্প-কাহিনী শোনার পর অনেকের মত অবিশ্বাস নিয়ে ফিরে না-গিয়ে হিরাম অনুসন্ধান আরম্ভ করেন। বহু কষ্টে স্থানীয় কিছু কেচুয়ান মানুষের সহযোগিতায় দুর্গম পথে অভিযাত্রা করে হিরাম অবশেষে বহুদিনের পথচলা শেষে রহস্যময় মাচুপিচু পৌঁছাতে সক্ষম হন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার পর প্রকাশ করেন বিশ্ব-কাঁপানো বই লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস। সেটা ১৯১১ সালের কথা। মাচুপিচু-এর জন্মের প্রায় পাঁচ শ’ বছর পর পুনর্জন্ম হয় এই পার্বত্য-পাথুরে-শহরের।

অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম-এর বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া পড়ে যায়। অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম খ্যাতির শীর্ষ-বিন্দুতে পৌঁছে যান। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের কোন কৃতিত্বই তিনি দেন নি। বলেছিলেন, তিনি মাচুপিচু গিয়েছিলেন জনশ্রুতি শুনে। যা হোক, পুনরাবিষ্কৃত মাচুপিচু-এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। মানুষের মনে রহস্যজাগানিয়া এক অদ্ভুত দোলা দিতে থাকে মাচুপিচু। ১৯৮৩ সালে মাচুপিচুকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে ঘোষণা করে।

প্রশ্ন উঠে সেকালের বিচারে এই রকম দুর্গম একটি পাহাড়ি অঞ্চলে এই আশ্চর্য শহরটি নির্মাণ করার পিছনের  উদ্দেশ্য ও কার্যকারণ নিয়েও। অধ্যাপক হিরাম বিংহ্যাম এবং আরও কেউ কেউ মনে করেন, এটা হয়ত ইনকাদের আদি বাসভূমি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও ধর্মীয় কেন্দ্র। কেউ কেউ মনে করেন, অভিজাত ইনকাদের সুরক্ষার জন্য শহরটি বানানো হয়েছিল, যাতে বহিরাক্রমণের সময় তারা রক্ষা পেতে পারে। অনেকেই মনে করেন, মাচুপিচু ছিল একটি ইনকা ‘লাকটা’ বা বিজিত অঞ্চলের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, মাচুপিচু হল সবচেয়ে বীর্যবান ইনকা সম্রাট সাপা ইনকা পাচাকুটি-এর খাস এলাকা এবং বিশ্রামস্থান। দু‘একজন বিশেষজ্ঞ প্রমাণ দিয়েছেন, ভূতাত্ত্বিকভাবে স্থানটির ল্যান্ডস্কেপে পবিত্রতাব্যঞ্জক ও শীতলতাদায়ক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, সম্ভবত চন্দ্রসূর্যগ্রহ সম্বন্ধীয় বিভিন্ন প্রধান মহাজাগতিক ঘটনার সঙ্গে মাচুপিচু-এর পাহাড়গুলোর অবস্থানের একটি সাযুজ্য রয়েছে। পাখির চোখে মাচুপিচু নগরী।

মাচুপিচুকে প্রকৃতিই চমৎকার সামরিক ও প্রাকৃতিক সুরক্ষা এনে দিয়েছে। ইনকা সৈন্যদের চলাচলের গোপন পথটি ছিল উরুবাম্বা নদীর উপর দড়ির ব্রিজ দিয়ে। মাচুপিচুর পশ্চিমে দু‘টি কাঠের গুঁড়ি পাতা আর একটি ব্রিজ। এই গুঁড়ি দু‘টি তুলে ফেললেই দক্ষিণ আমেরিকার ভয়াবহ শ্বাপদ-সঙ্কুল গভীর খাদ। মাচুপিচুর পিছনের পাহাড়টি প্রায় দুরধিগম্য। বসবাসের দিক দিয়েও মাচুপিচুর এক বিরাট সুবিধা ছিল পানীয় জলের ক্ষেত্রে। জলের প্রাচুর্যের কারণ কয়েকটি ঝরনা।

মাজুপিচু মানে পুরনো শৃঙ্গ। পাশে রয়েছে আরেক শৃঙ্গ---‘হুয়ানা পিচু’ বা ‘নবীন শৃঙ্গ’। প্রত্ন-গবেষকরা মাচুপিচুকে তিনটি এলাকায় ভাগ করেছেন: পবিত্র অঞ্চল, জনগণের অঞ্চল এবং পুরোহিত আর অভিজাতদের অঞ্চল বা রয়ালিটি জোন। পবিত্র অঞ্চলে প্রচুর সিঁড়ি পাহাড়ের গায়ে---নীচে, উপরে, পাশে পাথর দিয়ে তৈরি। প্রথমেই ‘ইনটিহুয়াটানা’ বা ‘সান টিয়ার’। গ্র্যানাইট পাথরের ত্রিস্তরবিশিষ্ট বেদী ধরনের একটি নির্মাণ, মাঝখান দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবার জন্য উন্মুক্ত সরনী। আয়তনে বড় নয়---কিন্তু আকৃতিতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সমস্তটাই ইনকা স্টাইলে নির্মিত এবং ইনকাদের সর্বপ্রধান দেবতা ইনটি বা সূর্যদেবতার উদ্দেশে নিবেদিত। মাচুপিচুর সাধারণ মানুষের বসতি এলাকায় রয়েছে ছোট ছোট ঘর-বাড়ি, শস্য মতুত করাবার গুদাম। সবই পাথরের। রাজকীয় অঞ্চলের বাড়িগুলো সারি বেঁধে পাহাড়ের ঢালে তৈরি। অভিজাতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘অ্যামটুস’ বা জ্ঞানী মানুষের বাসস্থানের বৈশিষ্ট্য হল, এর দেওয়ালে পাথরের রং ঈষৎ লাল। রাজকন্যা বা ‘নুসতাস’-এর ঘরগুলোর আকৃতি ট্রাপিজয়েড বা অসমান্তরাল বাহুবিশিষ্ট চতুর্ভুজ ধরনের। সব বসতবাড়ির ছাদে মজবুত ছাউনি রয়েছে। আর আছে পূজাস্থান এবং বলিদানের প্রাঙ্গণ।

মাচুপিচুর স্থাপত্য কৌশলের নাম ‘আশলার’। এতে পালিশ করা সমান মাপের বড় পাথরের ব্লকগুলো ঠিক ঠিক মাপমতো কেটে পাশাপাশি কিংবা উপরে-নীচে পরস্পর সংলগ্ন করে দৃঢ়ভাবে বসানো হয়েছে। জোড়ের জন্য কোনও মর্টার অর্থাৎ গাঁথনির মশলা ব্যবহৃত হয় নি। এই নির্মাণ কৌশলে ইনকারা অদ্বিতীয়। পাথরের অত বড় বড় ব্লক এমন নিখুঁত মাপে বসেছে যে কোনওদিকে একটা পাতলা ছুরিও ঢুকতে পারবে না!

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয় এই ভেবে যে, ইনকাদের জানার ভেতরে এটাও ছিল, ভূমিকম্প-প্রবল দক্ষিণ আমেরিকায় মর্টার ফ্রি নির্মাণ-রীতি খুবই উপযোগী। বৈজ্ঞানিক-নির্মাণ জ্ঞান আয়ত্বে না-থাকলে ইনকাদের এমন যুৎসই ইমারাত প্রাকৃতিক নিরাপত্তা ও দীর্ঘস্থায়ীত্ব পেয়ে কীভাবে টিকে আছে! ইনকা স্থাপত্য ডিজাইনেরও বৈশিষ্ট্য কম নয়। যেমন, দরজা-জানালাগুলো ট্রাপিজয়ডাল। ফলে এদেও বাহু অসমান্তরাল এবং নীচে থেকে উপরে পর্যন্ত ভিতরের দিকে সামান্য হেলানো; কোনগুলো গোল করে দেওয়া এবং ভিতরের কোণগুলো ঘরের দিকে সামান্য ঝোঁকানো, বাইরের কোণগুলো দৃঢ়ভাবে আটকাবার জন্য ‘এল’ আকৃতির পাথরের ব্লক ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়াও সব ইমারতের দেওয়ালই যথারীতি যত উপরে উঠেছে ততই সামনের দিকে অল্প হেলিয়ে দেওয়া। এইসব কৌশল ব্যবহারের ফলে এত শত বছর পরেও মাচুপিচু বড় বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে দিব্যি অটুট-অক্ষত রয়েছে। যেটুকু জীর্ণতা তা শুধু কালপ্রবাহের দরুন। মাচুপিচু নগরীর আকাশে মেঘ-রোদের খেলা।

সবচেয়ে বিস্ময় হলো, একসব প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড আনা হয়েছে বহুদূর থেকে! কীভাবে যে আনা হলো এবং এত উপরেও তোলা হলো! অথচ ইনকারা চাকা ব্যবহার করে নি। তাহলে কী শত শত মানুষ এসব ঠেলে এবং টেনে তুলেছে! হঠাৎ কোনও কোনও পাথরের গায়ে ‘নব’ দেখা যায়। বাকীগুলোতে নেই। হয়তো পাথরগুলো যথাস্থানে রাখা হলে ইনকারা ওইসব ‘নব’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিত। দু’একটা থেকে গেছে।

ইনকাদের হারানো প্রস্তর-নগরী মাচুপিচুতে সব মিলিয়ে এক শ’ চল্লিশটি নির্মাণ আছে। জলের জন্য ঝরনা আছে অনেক। পানি প্রবাহের জন্য পাহারে নালা কেটে ঝরনাগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রতিটি গৃহে জল-সরবরাহের ব্যবস্থাও আছে। চমৎকার, সুপরিকল্পিত, সুনির্মিত একটি পাহাড়ি শহর। পর্বত শীর্ষের এই শহরে রাস্তা তৈরির ব্যাপারেও ইনকারা বিশেষ দক্ষতা এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে। জাল বিছানো অসংখ্য রাস্তার সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজধানী কুজকো। বহু পর্যটক কুজকো থেকে পায়ে হেঁটে চার-পাঁচদিনে মাচুপিচু পৌঁছান। অবশ্য এক্ষেত্রে পথ চেনার জন্য তাদেরকে স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিতে হয় প্রতি পদে। আর এ কারণেই আগ্রাসী স্পেনিয়ার্ড বাহিনী কুজকো পর্যন্ত পৌঁছালেও মাচুপিচুর সন্ধান পায় নি।

পাহাড়চূড়ার প্রস্তর-নগরী মাচুপিচু রহস্যের ঘেরাটোপের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেই রক্ষা করতে পেরেছে স্বকীয় স্থাপত্য-বিস্ময়; সূর্যউপাসক প্রাচীন ইনকাদের প্রাচীন প্রত্নসভ্যতার সমৃদ্ধির স্মারক।

‘দ্য লস্ট সিটি অব দ্য ইনকাস’ অবলম্বনে রচিত।

ড. মাহফুজ পারভেজ
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত,       [email protected]


বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।