ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

কুমির ফোটে করমজলে

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
কুমির ফোটে করমজলে করমজল প্রজনন কেন্দ্রে আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে এক কুমির ছানা। ছবি: মানজারুল ইসলাম

করমজল (সুন্দরবন) ঘুরে: দুই বধ‍ূ এক স্বামীর বসবাস পুকুরটায়। এক বধূর নাম জুলিয়েট, অপরজন পিলপিল। স্বামীর নাম রোমিও। সুন্দরবনের নোনা জলে নিজেদের রাজ্যেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো ওরা। জেলেদের জালে আটকে পড়ার পর ধরে এনে এই পুকুরে প্রজননে লাগিয়ে দিয়েছে বেরসিক বনবিভাগ। সেক্সপিয়রের অমর প্রেমকাহিনী থেকে ধার করে রোমিও আর জুলিয়েট নামটাও তাদেরই দেওয়া।

প্রথম প্রথম মিল মহব্বত না থাকলেও ধীরে ধীরে জুলিয়েট আর পিলপিলের সঙ্গে রোমিওর প্রেমটা কিন্তু জমেছে ভালোই। আর সেই প্রেমেরই ফসল কাঁড়ি কাঁড়ি ডিম।

ইনকিউবেটরে তাদের ডিম থেকে এখন ছানা ফুটছে হরদম। কুমিরের কৃত্রিক প্রজননে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের সাফল্যের তিলক তো ওই দুই বধূসহ রোমিওই এঁকেছে।

কিন্তু ভরদুপুরে শত শত দর্শনার্থীকে হতাশ করে কোথায় যে তারা মুথ সেঁধিয়ে পড়ে আছে বলা মুশকিল। ইট-সিমেন্টের চৌহদ্দির ভেতরে পুকুরের পাড় জুড়ে ঘণঝোপ। তার ভেতরে শুয়ে থাকলে ওদের দেখা পাওয়া ভার। আর পানিতে তো বাতাসের তিরতিরে কাঁপন পর্যন্ত নেই। অগত্যা বাচ্চা কুমির তৈরির মেশিন রোমিও ‍আর তার দুই বধূকে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে কাঠের প্লাটফর্মে তৈরি গ্যাঙওয়েতে পা বাড়াতে হয়। করমজলে গাছের ডালে রেসাস বানর।  ছবি: মানজারুল ইসলামপেছনে পড়ে থাকে সারি সারি চৌবাচ্চায় জিইয়ে রাখা বাচ্চা কুমিরের দল। কী কারণে কে জানে, ভীষণ ক্ষেপে আছে কুমির ছানা গুলো। ছোট্ট শরীরের তুলনায় বেঢপ বড় হাঁ করা মুখের বাচ্চা দাঁতই চিনিয়ে দিচ্ছে মাংসাসী প্রাণীটার জাত-চরিত্র।

ক’দিন আগেই নাকি এক কর্মীর আঙুল কামড়ে খুলে নিয়েছে এক পিচ্চি বাহাদুর। ইনকিউবিটরে ডিম থেকে বেরিয়েই দৌড় দেয় এগুলো। আর কামড়াতে শিখে যায় দৌড় দেওয়ার আগেই।

পেট ভরা থাকলে শিকার করে না এরা। দিনে ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টাই কাটিয়ে দেয় ঘুমে। বড় হলে প্রায় ৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে একেকটা। ওজন উঠে যেতে পারে ‍পাঁচ টনের কাছাকাছি। তবে কুমিরের পরিচিতি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার কোনো আয়োজন নেই করমজলে। কুমিরের সেবায় নিয়োজিতদের তাই পর্যটকবান্ধব বলার সুযোগ নেই। করমজলে ভাঙ্গা ওয়াকওয়ে।  ছবি: মানজারুল ইসলামএখানকার সব কুমিরই সুন্দরবনের। কুমির ছাড়াও এ বনের হরিণ আর বানর প্রচুর সংখ্যায় মিলবে করমজলে। ঘেরার মধ্যে থাকা হরিণগুলোকে হাত বাড়িয়ে পাতা খাওয়ানো যায় ঝামেলাহীনভাবেই। কিন্তু বানরগুলোর বাঁদরামি এখানে যেনো একটু বেশিই। খোলা বাগানে বিচরণকারী রেসাস বানর যে কোনো সময় হাত থেকে খাবারের প্যাকেট ছিনিয়ে নিতে পারে ছো মেরে। ওদের জন্যই তো কাঠের ওয়াকওয়েটার নাম মাঙ্কি ট্রেইল।

এক দিনের সুন্দরবন সফরে গোটা সুন্দরবনের মিনি সংস্করণ দেখতে এখানটায় আসে পর্যটক। সুন্দরী, গরাণ, গেওয়া, বাইন গাছের গায়ে নাম লিখে রাখা হয়েছে এখানে। দেওয়া আছে বাঘ, বানর, হরিণ, কুমিরের পরিসংখ্যান।

টিকিট কাউন্টারের পাশেই বিশাল এক বাঘের কঙ্কাল। হরিণ আর কুমিরের খাঁচার পাশে উন্মুক্ত এক সামুদ্রিক জাদুঘরও আছে। সেখানে শিল, শুশুক, ডলফিন আর বাংলাদেশের তিমির প্রতীকী প্রদর্শনী। করমজলে আগ্রাসী কুমির ছানা।  ছবি: শুভ্রনীল সাগরকাঠের ওয়াকওয়ের দু’পাশের বনে বাইন গাছের আধিক্য। খালের পাশে হেতাল ঝোপ, গোলপাতার বন। ওয়াকওয়েটা নড়ে গেছে কোথাও কোথাও। পাকা ওয়াচ টাওয়ার ভরে গেছে কুৎসিত কথায়। পশুর নদীর দিকে যাওয়া ওয়াকওয়েটা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে অনেক আগেই।

করমজল কুমির ও হরিণ প্রজনন কেন্দ্রটি সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আওতায়। মংলা থেকে এখানকার দূরত্ব ৭ কি ৮ কিলোমিটার হবে। তবে খুলনার দূরত্ব হবে ৬০ কিলোমিটারের মতো। মংলা থেকে এখানে আসতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগবে না।

মংলার কাছে হওয়ায় নিত্যদিনই এখানে ভিড় জমে মানুষের। খুলনা আর মংলা থেকে পশুর নদী বেয়ে নৌকা এসে ভেড়ে করমজল খালে। নোঙর ফেলা লঞ্চকে গুণতে হয় ৩শ’ টাকা জমা। জনপ্রতি টিকিট কাটতে হয় ২৩ টাকায়।

এখানে এলে বাঘ, হরিণ বা বুনো শুয়োরের পায়ের ছাপ চোখে পড়বে না সত্য, কিন্তু সুন্দরবনের বৃক্ষরাজির একটা প্রদর্শনী পাওয়া যাবে। তবে শীত মৌসুমে হাজার হাজার পর্যটক আসার কারণে জায়গাটা সব সময় হাটের মতোই গমগম করে। তাই এখানে এসে বনের নীরবতা আশা করা ঠিক হবে না।

আরও পড়ুন...

** সুন্দরী বেয়ে বাঘ-কুমিরের কটকায়
** হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন
** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
**
দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল


বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।