ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
হিরণ পয়েন্টে হৃৎকম্পন হিরণ পয়েন্টে নড়বড়ে ওয়াচ টাওয়ার-ছবি: মানজারুল ইসলাম

রেলিং ভাঙা। কিন্তু তাতেও ঠিক ঠাহর করা যায়নি কতোটা ঝুঁকি ওয়াচ টাওয়ারটায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে মাথা ঘোরার কারণটাও বুঝে আসছিলো না।

হিরণ পয়েন্ট (সুন্দরবন) থেকে: রেলিং ভাঙা। কিন্তু তাতেও ঠিক ঠাহর করা যায়নি কতোটা ঝুঁকি ওয়াচ টাওয়ারটায়।

সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে মাথা ঘোরার কারণটাও বুঝে আসছিলো না। কিন্তু ওপরতলার কার্নিশে দাঁড়াতেই বিপদটা টের পাওয়া গেলো। ইট-সিমেন্টের পাঁচতলা টাওয়ারটা পুরোটাই নড়ছে।

ভূমিকম্প হলে যেমন মাথা ঘোরে, এখানেও সেই অনুভূতি! শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের স্রোত বইছে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতেই বোধ হয় হিতাহিত জ্ঞান হারায় মানুষ। লাফ দেয় বহুতল ভবন থেকে।  

ওয়াচ টাওয়ারে উঠে সুন্দরবন ওয়াচ করার খায়েশ উবে গেলো নিমিষে। এই বুঝি ঢলে পড়লো টাওয়ারটা। সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্ট দেলোয়ার হোসেন বাদল চেঁচিয়ে উঠলেন নিচ থেকে। গোটা টাওয়ারটাই নাকি দোল খাচ্ছে তার চোখের সামনে।

ওপরতলার কার্নিশে এসে সেলফি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন লিটারেচার এডিটর শুভ্রনীল সাগর। মোবাইল বের করার জন্য পকেটে ঢোকানো হাতটা খালিই বেরুলো তার। নিচে নামার সিঁড়ি ভাঙার কথাটা আর বলে দিলে হলো না তাকে। হিরণ পয়েন্টের মিষ্টি পুকুরে অতিকায় গুইশাপ-ছবি: ডিএইচ বাদলকাছের ল্যান্ডিংটায় এসে সদ্য দাঁড়ানো স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট মবিনুল ইসলাম আর সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শাহজাহান মোল্লা এরইমধ্যে সিঁড়ি ভেঙে নামতে শুরু করেছেন। তার পিছু পিছু অর্ধেকটা নামার আগেই স্টাফ ফটো করেসপন্ডেন্ট মানজারুল ইসলাম রানা পাশ কাটিয়ে উঠে গেলেন ওপরে। ছবি তোলার নেশায় অকুতোভয়ী হয়ে উঠলেও অর্ধেক ওঠার আগেই রণে ক্ষান্ত দিতে হলো তাকেও।

একটু পেছনে পড়েছিলেন সিনিয়র নিউজরুম এডিটর আবু তালহা। টাওয়ারের বিমগুলোকে অন্তত ছয় ইঞ্চি এদিক-ওদিক দুলতে দেখলেন তিনি। ততোক্ষণে নিচে নেমে সবাই রুদ্ধশ্বাসে টাওয়ারটাকেই দেখছে।

কিন্তু টাওয়ার বিষয়ক আলোচনাটা ভালো করে জমে ওঠার আগেই মিষ্টি পানির পুকুরটার দিকে দৌড় দিলেন বাদল আর তালহা। বুদ্ধি করে দু’জন দু’দিক থেকে পুকুরটাকে ঘিরে ছুটছেন। শেষ পর্যন্ত বিশাল গুইসাপটা ধরা পড়লো ক্যামেরায়। তারপর খাওয়ার পানির জন্য খোঁড়া পুকুরটার পাড়ে নারিকেল গাছে ঝুলে থাকা বাবুই পাখির বাসা বন্দি হলো ক্যামেরার ফ্রেমে। কোথা থেকে এসে একটা দাঁড় কাক চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেলো মাত্র ফুট দশেক দূর দিয়ে।  

একটু আগেই পুকুরের কোণা থেকে গভীর বনের দিকে এগিয়ে যাওয়া ট্রেইলটায় গোটা তিন উৎসুক হরিণের ছবি তুলেছিলেন শুভ্র। তারপর একটা কী দু’টো হরিণ ধরা পড়ছিলো বাদল আর মানজারের ক্যামেরাতেও। এই হরিণের বিচরণের জন্যই তো জায়গাটার নাম হিরণ পয়েন্ট। হরিণ-বাঘের অবাধ বিচরণ এদিকটায়।
সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টের হরিণ-ছবি: শুভ্রনীল সাগরবন বিভাগের কর্মী আব্দুল বাকেরকে পাওয়া গেলো রেস্ট হাউজের পাশের রাস্তাটায়। তাকে পেয়ে ফের আলোচনায় ফিরে এলো নড়বড়ে ওয়াচ টাওয়ার। তিনি জানালেন, ওয়াচ টাওয়ারটা পরিত্যক্ত নয়।

কিন্তু ওটা যে নড়বড়ে সেটা কেনো লিখে দেওয়া হলো না, জানতে চাইলে তিনি বললেন, কেউ এলে আমরা তো সঙ্গেই থাকি। তাই সাবধান বাণী লিখে দেওয়ার দরকার মনে হয়নি।

এমন বেমক্কা উত্তরে তর্কে না জড়িয়ে ফিরে আসাই ভালো মনে হলো। সিডরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পরিত্যক্ত এক ভবনে নিজেই বাস করেন বাকের। তাকে অন্যের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন করা বৃথা। এদিকে ভাটা শুরুর আগেই হিরণ পয়েন্ট ছাড়া জরুরি। নতুবা ডুবো চরে আটকে যেতে হবে পরের জোয়ার না আসা পর্যন্ত। দুবলার চর থেকে আসার পথে দু’বার আটকে গেছে নৌযান গাঙচিল। ফের আটকালে অন্তত ছয় ঘণ্টা নড়তে পারবে না লঞ্চটা।

নীলকমলের ভাঙা জেটিতে ফিরতে বেশি সময় লাগলো না। এই নীলকমল নদীকে কেন্দ্র করেই তো গড়ে উঠেছে হিরণ পয়েন্ট পর্যটন এলাকা। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্থাপন করা একটি ভিত্তিফলকও রয়েছে এখানে। আর নীলকমলের ওপাড়ে রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ আর একটা ট্রেইল, আর একটা ওয়াচ টাওয়ার।    

ফেরার পথে নীলকমলের মুখের পাশে কেওড়া গাছটায় দেখা গলো ১৪টা সাদা বক বসে রয়েছে। ঢোকার মুখে ঠিক এক ডজন ছিলো বকের সংখ্যা। এখন আরও দু’টো বেড়েছে। গাছের কাছ ঘেঁষে শব্দ তুলে ছুটে যাওয়া লঞ্চটাকে তারা দেখলো কেবল, পাত্তা দিলো না। একটু দূরে ডুবো চরে আটকে যাওয়া গাঙচিলকে দেখা গেলো জোয়ারের জলে দুলছে। চর থেকে শরীরটা ছাড়িয়ে নোঙর ফেলে রয়েছে খালের মাথায়।
সহযোগিতায়

আরও পড়ুন...

** ঘুম সাগরে জল অভিযান
** চাঁদের সাথেই মাছের প্রেম
** দুবলার সৈকতে মৃতদের মিছিল!
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
**
দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৬
জেডএম/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।