ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

নেপালের ডায়েরি-২

বুক কাঁপানো রাস্তায় যাত্রীদের বাস ধাক্কা

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৪, ২০১৪
বুক কাঁপানো রাস্তায় যাত্রীদের বাস ধাক্কা

নেপাল থেকে: প্রথম পর্বের লেখাটি শেষ করেছিলাম ‘যন্ত্রণাদায়ক’ বাস ভ্রমণের কথা বর্ণনা করবো বলে! শুরু করছি সেখানে থেকেই। কাঁকড়ভিটা থেকে ঠিক পাঁচটায় বাস ছাড়লো কাঠমাণ্ডর উদ্দেশে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম প্রায় ছয়শ’ কিলোমিটারের রাস্তা। প্রথম চারশ’ কিলোমিটার তরাই বা সমতল অঞ্চলের। বাকিটা পাহাড়ি আঁকাবাকা পথ। সে পথে বেশ ধীরে চলবে বাস।

কিন্তু একি! কয়েক ঘণ্টা যেতেই বাস ধীরে চলা তো দূরে থাক, বন্ধই হয়ে গেল। শুরুতে বাসের চালক এবং তার সহযোগীরা চেষ্টা চালালো বাসটি চালু করার।
ব্যর্থ হয়ে অবশেষে দূর থেকে আনানো হল মিস্ত্রি। মিস্ত্রিও সফল হলো না। পেরিয়ে গেল চার ঘণ্টা। যাত্রীদের অনুরোধ করে দীর্ঘ তিন থেকে চার কিলোমিটার

পথ গাড়ি ধাক্কা দিয়ে আনা হল একটি গ্যারেজে। বিদেশি অতিথি ছাড়া প্রায় সব নেপালি পুরুষ এই গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার কাজে হাত দিয়েছে। নারীরা অনেকেই চেষ্টা করেছেন সঙ্গী পুরুষের সঙ্গে হেঁটে কিছুদূর যেতে। অবাক হচ্ছিলাম নেপালিদের দেখে!

বেশ স্যুট-বুট পরা লোকও বাস ঠেলছেন! পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আরো চারজন মোটর সাইকেল আরোহীকেও তাদের যাত্রা থামিয়ে সাহায্য করতে দেখলাম সেই গভীর রাতে।

গ্যারেজে আরো ৩-৪ ঘণ্টা সময় পার করে চালু হল বাসটি। সকাল হতে তখন কিছু সময় বাকি। বাকি কাঠমাণ্ডু পৌঁছানোর আরো অনেক রাস্তা।

প্রাণহানি করা এক পাহাড়ি দুর্ঘটনা:
চলতে থাকলো গাড়ি। কাঠমাণ্ডু থেকে তখনও প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা বাকি। কিন্তু সকাল ৯টার দিকে আবারও থেমে গেল আমাদের বাস। সামনে অসংখ্য বাসের সারি। জমতে থাকল পেছনেও। তীব্র যানজট। যানজট আমার কাছে অপরিচিত নয়! তবে নতুন করে পরিচিত হলাম পাহাড়ি যানজটের সঙ্গে। যানজটও এত সুন্দর হয়!

পাহাড়ি ঢালু রাস্তায় পাহাড়ের মাঝে গাড়ির লম্বা সারি। প্রকৃতি আর যান্ত্রিকতার অপূর্ব মিলন। এমন সব ভাবনার মাঝেই খবর মিলল, সামনে একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটি বাস পাহাড়ি খাদে পড়েছে। একজনের প্রাণহানি। কয়েকজন হাসপাতালে। সব যাত্রী উদ্ধার হয়েছে। এখন গাড়িটি সরানোর কাজ করছে পুলিশ।
সকাল ন’টা থেকে শুরু হওয়া সেই জ্যাম ছাড়তে বিকেল ৫টা ছাড়িয়ে গেল।

পাহাড়ি রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপরই কিছু দোকান আর রেস্ট হাউজ থাকায় খাবার আর ফ্রেশ হওয়ার জায়গার অভাব ছিল না। তবে অবাক হতে বাকি ছিল। এত লম্বা যানজটে পড়েও কোনো নেপালির চোখে মুখে সামান্য বিরক্তি অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যেন এটা খুব স্বাভাবিক। তখন আমার জার্নি করার মোট সময় ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়েছে।

রাস্তায় পাহাড় থেকে নামিয়ে আনা টাটকা কমলাসহ পাহাড়ি নানা ফল পাওয় গেল। ফরমালিন ছাড়া এসব ফল দেখেই কিনে নিচ্ছিল আমার মতো অনেক বিদেশি।

৫০ রুপিতে মিলল টাটকা ২১টি কমলা। এসব খেয়েই সময় কাটছিল। বিকেল পাঁচটায় আবার চলা শুরু করে বাসটি আমায় কাঠমাণ্ডু নামিয়ে দিল রাত সাড়ে ৮টায়।

নেপালের প্রকৃত সৌন্দর্য:
নেপালের রাস্তা দিয়ে কাঠমাণ্ডু আসতে গিয়ে অনুভব করলাম মাউন্ট এভারেস্ট, অন্নপূর্ণা আর কিছু মন্দির, প্যাগোডা দেখাটাই প্রকৃত নেপাল দেখা নয়।
পাহাড়ি রাস্তা, কিছুদূর পর পর চোখে পড়া ঝরনা, এর প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি বাড়ি সবই যেন অন্য সৌন্দর্য পেয়েছে। প্রকৃতি নিজেই অপার যত্ন নিয়ে সাজিয়েছে এই হিমালয় কন্যাকে।

সঙ্গে এখানকার মানুষকে দিয়েছে অসম্ভব শিল্পগুণ। তা দিয়েই সামান্য খড়ে বাড়িগুলোকেও কেমন অসাধারণ করে তুলেছে তারা।

নেপালি কন্যার অভিনব সাহায্য:
লম্বা জার্নির ক্লান্তি আর বিরক্তির মাঝেই অনলাইনে কাঠমাণ্ডুর একটি ভালো মানের হোটেল খুঁজে নিই। বাসেই পরিচয় রোসা নামের এক তরুণীর সঙ্গে। কথা খুব বেশি হয়েছিল এমনটি নয়।

কিন্তু বাস থেকে নামার পর আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো-এখানে ট্যাক্সি পাবে না। পেলেও অনেক রুপি লাগবে। আমার সঙ্গে এসো।

আগেই বলেছি এদের চোখে মুখে আমি তখনও ভয়ঙ্কর কিছু দেখিনি। তাই খানিকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠলাম রোসার গাড়িতে। ওকে নিতে এসেছে ওর দুলাভাই। সঙ্গে ছিল তার বোন। আমার ভীষণ ভারি ব্যাগটা সেই ভদ্রলোকই গাড়িতে তুলে নিলেন।

রোসা কাঠমাণ্ডুর একটি পার্টি হাউসের কর্মকর্তা। অনেক খুঁজে কিছু পথ হেঁটে ওরা আমাকে থামেল এলাকার পাকনাজলে আমার বুকিং দেওয়া হোটেলে পৌঁছে দিল। ৪৮ ঘণ্টা জার্নির পর আমি পৌঁছ‍ালাম কাঠমাণ্ডুতে। রোসা ফেরার আগে ফোন নম্বর আর সাহায্যের নানা অফার দিয়ে গেল। সেটিও একদম ফ্রি এবং ভালোবাসাসহ বলেই অনুভব করলাম। দীর্ঘ জার্নির ক্লান্তি শেষেও ভালোলাগায় ভরে উঠলাম রোসাদের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তায়।

শুরু হল কাঠমাণ্ডু মিশন। পরদিন সকাল থেকেই নানা ব্যস্ততা দিয়ে  নিউজ করার কাজ শুরু হল। অবাক হয়েছিলাম কবির উদ্দিন ভাইয়ের ইমেইল পেয়ে।
বাংলানিউজের এই নিয়মিত পাঠক এ প্রতিবেদক নেপালে আছে শুনে যোগাযোগের অনুরোধ করেছিলেন। প্রথম দিনেই দেখা মিলল কবির পরিবারের সঙ্গে।

হেঁটে চলা:
একটানা কাজের মাঝে নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছি অচেনা শহর। হিমালয়ের এ শহরে ট্যাক্সি ভাড়া খুব বেশি। কখনো এক কিলোমিটার যেতেই আপনাকে দিতে হবে দুইশ টাকা।

এদিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে এখানকার ট্যাক্সিওয়ালাদের মিল আছে। কোনোভাবেই তারা মিটারে যেতে চান না।

বলে রাখি এখানে খুব বেশি ভাড়ার হোটেল যেমন আছে তেমনি কম ভাড়ারও আছে। আপনার সাধ এবং সাধ্যমত নিজেই খুঁজে নিতে পারবেন। ট্যাক্সিভাড়া বাঁচাতে দু-একদিন পর আমি নিকট দূরত্ব হেঁটেই যাওয়া শুরু করলাম। মন্দ নয়। পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি শহরের রাস্তা। যে দূরত্বে হাঁটা সম্ভব নয় লোকাল মাইক্রো বাসের সাহায্য নিলাম।

কাঠমাণ্ডুর রাস্তা বাংলাদেশেরে যে কোনো মফস্বল শহরের রাস্তার চেয়েও দ্বিগুণ খারাপ। চিকন এসব রাস্তায় বড় বাস চলাচল সম্ভব নয় বলেই বোধ করি পাবলিক সার্ভিস হিসেবে মাইক্রোই চলে এখানে।

এছাড়া হোটেল, ট্রাভেল এজেন্সি সবাই আপনাকে কাঠমাণ্ডু শহরের মেপ দেবে। যেখানেই যেতে চান দেখিয়ে দেবে রাস্তা। হেঁটে চলার আরেকটি সুবিধা হল শহরটাকে খুব ভালভাবে দেখতে পারা। পথগুলো চিনে ফেলা এবং চলতে গিয়ে এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশতে পারা। এসব কারণেই নিকট দূরত্বে হেঁটেই চলেছি আমি।

বাংলাদেশ দূতাবাস দর্শন:
প্রথম দিনেই যোগাযোগ হল নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামসের সঙ্গে। গভীর আন্তরিকতায় দূতাবাসে তার আমন্ত্রণ লুফে নিলাম।
মাত্র ১০/১৫ মিনিটের পথ আড়াইশ’ রুপি ভাড়া মিটিয়ে সেখানে পৌঁছালাম। আন্তরিকতা আর আগ্রহ নিয়ে মাশফি আপা দেশের খবর নিলেন।
বাংলাদেশ থেকে বাসে করে একা নেপালে আসায় আমার সাহসের প্রশংসাও করলেন। নানা বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল।

এরই মাঝে  আসল একটি পারিবারিক খারাপ খবর। আমার দাদী শাশুড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আরো দু-একজন কর্মর্তার সঙ্গে আলাপ শেষে দ্রুত বেরিয়ে এলাম দূতাবাস থেকে।

সন্ধ্যা তখন কাঠমাণ্ডুকে ছেঁয়ে গেছে। হোটেলে ফেরার জন্য ট্রাক্সি ধরলাম। মিটারে আসার ভুলটা প্রথম অনুভব করলাম। ২৫০ রুপিতে যে পথ গিয়েছিলাম, ঘুরিয়ে ৫০০ টাকা বিল করে হোটেলে ছাড়ল ট্যাক্সিওয়ালা।

যাওয়ার সময় বলেও গেল পথ চেনা থাকলে এত ঘুরতাম না। আমরা ট্যুরিস্টদের থেকে খুব বেশি ভাড়া নেই না!

খাদ্য সংকট:
টাকা থাকলে তবু ট্যাক্সি মেলে, কিন্তু খাবারের বেলায় এটি সত্য নয় এখানে। বিশেষ করে যারা হালাল খেতে চায় তাদের জন্য এ সমস্যা প্রকট। খুব সীমিত হোটেলই পাবেন। তবে আমি পেয়েছি এক বাংলাদেশিকে। যিনি এখানেই হোটেল ব্যবসা শুরু করেছেন বিরাট বিনিয়োগে। খাবারের মূল্য বেশি হলেও কাজ শেষে হোটেল স্কাইলার্কে পেট ভরে খেয়ে নিজের হোটেলে চলে যাই।

এরই মাঝে সার্ক সচিবালয়ে যাওয়া হল। সেখানে কর্মরত বাংলাদেশ কর্মকর্তারাও আন্তরিকতা দেখালেন। পেরিয়ে গেল কাঠমাণ্ডুতে কয়েকদিন। তবে এখনও আমি কোনো সমস্যায় পড়িনি। একা হলেও কেউ বাঁকা চোখে তাকায় নি। বরং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আতিথেয়তা দেখিয়েছে কাঠমাণ্ডুবাসী।

এরমধ্যে একদিন রোসার ফোন আসে। কাঠমাণ্ডু ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ। কিন্তু কাজের চাপে সকাল থেকে সময় দিতে পারিনি আমি। শুক্রবার বিকেলে রওনা দিয়ে লোকাল মাইক্রোতে ওর কাছে, পৌঁছাতে বেশ সন্ধ্যা। আমাকে দেখে বিরাট চিৎকারে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, ঠিক ছোট বেলার সখীর সঙ্গে বহুদিন পর দেখা হওয়ার মতো।

বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে আমাকে আবারও হোটেলের উদ্দেশে পাঠিয়ে বিদায় নিল রোসা। আমার নেপালি ছোট কালের বন্ধুটি! নেপালে এলাম পোখারা যাব না সেকি হয়! তাই শনিবার (০১ নভেম্বর) সকাল ৭টার গাড়ির টিকিট নিলাম। কিন্তু আমি বাস মিস করবো না সে কী হয়!

এরপর তৈরি হয় আরেক ঘটনা। বলছি পরের পর্বে...

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৪

**একা হয়েও একা নই এখানে
** একা হয়েও একা নই এখানে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।