ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

আকাশের নীলে ভেজা দিন

আনিসুল কবীর খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৪
আকাশের নীলে ভেজা দিন

১০-১৫ বছর আগে সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘গর্ভধারিনী’ পড়েছিলাম। দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি ভারত-নেপাল সীমান্ত এলাকার সান্দাকফু ও ফালুট নামের পাহাড়ি এলাকার অদ্ভূত সুন্দর বর্ণানা আছে উপন্যাসটিতে।

বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের দৃশ্যপট লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন তা আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় গাঁথা আছে।

সেটা ছিলো উপন্যাসের একটি খণ্ডিত অংশ। কিন্তু আমাদের এবারের দার্জিলিং ট্যুর ছিলো যেনো বাস্তবের থেকেও নিজেদের উপন্যাসের চরিত্রে পরিণত করা চেষ্টা। হিমালয়ের সন্তান হয়ে ৫-৬টা দিন কাটিয়ে আসা।

সান্দাকফু না গেলেও সান্দাকফুর কাছাকাছি ঘুরে আসাটা বর্তমান তরুণদের ভাষায় যাকে বলে ‘সেইরকম’ টাইপের কিছু।  
   
পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু। আর সান্দাকফু ট্র্যাকের আরম্ভ হয় ‘মানেভঞ্জন’ থেকে। আর ‘মানেভঞ্জন’ আসলে একটি দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম।

এবারের আমাদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো দার্জিলিং ও তার আশপাশের সুন্দর জায়গাগুলো ভ্রমণ ও সাথে সাথে মাউন্টেন ট্র্যাকিংয়ের ছোটোখাট অভিজ্ঞতা অর্জন।

পুরো ভ্রমণ পথ যেভাবে সাজানো ছিলো
ঢাকা থেকে বুড়িমারি/চেংড়াবান্ধা বর্ডার (ভারত) - শিলিগুড়ি – মিরিক- মানেভঞ্জন- চিত্রি- দার্জিলিং - কালিম্পং- শিলিগুড়ি - ঢাকা। বেশ বড় ভ্রমণসূচি। কিন্তু আজ আমি শুধু মানেভঞ্জন ও চিত্রির অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।  
   
আগেই বলেছি সান্দাকফু ট্র্যাক শুরু হয় মানেভঞ্জন থেকে। পূর্ব হিমালয়ের ট্রেকিংয়ের উল্লেখযোগ্য একটি পথ হচ্ছে সান্দাকফু ট্র্যাক। ট্র্যাকটির মোট দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার (মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত)। সর্বোচ্চ স্থান সান্দাকফুর উচ্চতা ৩ হাজার ৬৫৮ মিটার বা ১২ হাজার ফুট।

মানেভঞ্জনের উচ্চতা ৬ হাজার ৮০০ ফুট। এটি একটি উপত্যকা। দু’পাশে বিশাল পর্বত খাড়া দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শীতকালে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত সব জায়গায় বরফ পড়ে। বেশিরভাগ মানুষ নেপালি বংশদ্ভূত।
   
আমরা মানেভঞ্জন এসে পৌঁছাই ভারতে ঢোকার একদিন পর। প্রথম রাতটি কেটেছিলো মিরিক শহরে। মিরিক থেকে সুখিয়াপোখরি ২ ঘণ্টার বাস জার্নি। সুখিয়াপোখরি থেকে মারুতি কারে ৭ কিলোমিটার রাস্তা ৩০ মিনিটে মানেভঞ্জন।

মানেভঞ্জন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিলো সেদিন। গাড়ি থেকে নামতেই স্থানীয় লোকদের মধ্যে দু’তিন জন এগিয়ে এসে  জিজ্ঞেস করলো হোটেল লাগবে কিনা?

চারজনের জন্য থাকার জায়গা লাগবে শুনে নিজেদের ভিতরে কথা বার্তার খোঁজ খবর করে এসে একজন জানালো কোনো হোটেলে জায়গা নেই, আমরা চাইলে হোম স্টের, অর্থাৎ মানুষের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা যাবে।

আমরা বাসায় থাকতে রাজি হয়ে যাই। মজার ব্যাপার আমরা যে বাসায় উঠেছিলাম সেই বাসাটার ভৌগোলিক অবস্থান নেপালের ভিতরে। মানেভঞ্জন শহরের মধ্যেই নেপাল বর্ডার। পরবর্তীতে চলাফেরা করার সময় প্রায়ই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিলাম আমরা কোথায় আছি, নেপালে নাকি ভারতে?

নেপাল-ভারত সীমান্ত নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই, দু’দেশের মানুষ একাত্ম হয়ে বসবাস করছে। কোনো চোরাকারবারি বা সীমান্ত সংঘাত নেই। মানেভঞ্জন পাহাড়ি শহর বা গ্রাম দু’টোই বলা যায়।

উপত্যকা হওয়ায় এখানে প্রচণ্ড বাতাস থাকে। আবহাওয়া দার্জিলিংয়ের মতোই। মার্চ মাসে বাংলাদেশের ডিসেম্বর মাসের মতো তাপমাত্রা এখানে। রাতে তাপমাত্রা আরো কমে আসে। সকালে হাতমুখ ধোয়া ও ওয়াসরুমে যাওয়াটা রীতিমতো কষ্টকর।
   
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় কাছাকাছি হিন্দুমন্দির ও বৌদ্ধ প্যাগোডায় ঘোরাফেরা করে আর বাজারের চায়ের দোকানে চা রসগোল্লা খেয়ে নেপালি বাসায় রাত কাটাতে খারাপ লাগেনি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো যখন চিন্তা করছিলাম আমরা নগর সভ্যতা থেকে কতো দূরে ৭ হাজার ফুট উঁচু উপত্যকায় এক নেপালি বাসায় রাত কাটাচ্ছি।

এখানকার মানুষ তাদের বাসাগুলোতে হোটেলের মতোই পরিসেবা দিয়ে থাকে। যখন চেয়েছি তখনই চা বানিয়ে দিয়েছে, গরম পানি করে দিয়েছে গার্গল করার জন্য। হোটেল না পাওয়াতে বরং মানেভঞ্জনে একটি নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হলো আমাদের।
   
পরদিন উত্তর দিকের খাঁড়া পাহাড় বেয়ে দু’হাজার ফুট উঠে চিত্রি গুম্ফা বা বৌদ্ধ মন্দির পর্যন্ত পৌঁছাই। মাত্র দুই কিলোমিটার রাস্তা পেরুতেই আমাদের লেগে যায় আড়াই ঘণ্টা সময়। যদিও স্থানীয় অধিবাসীদের এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না।

আমাদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কারো পাহাড়ে চড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকাতে, আস্তে আস্তে হাঁটা, ছবি তোলা, ভিডিও করা ইত্যাদি মিলিয়ে বেশি সময় লাগিয়ে ফেলি আমরা।

চিত্রিতে হক্স নেস্ট নামে একটি হোটেল বা গেস্ট হাউস ও খাবার দোকান আছে। এটির মালিক একজন তিব্বতি, নাম ফুংসুক। ফুংসুকের দোকানে চা, চিপ্স, ওমলেট খেয়ে ওর সাথে ছবি তুলে খুনসুটি করে খুব ভালো লেগেছিলো। আরও ভালো লাগছিলো যে এখানে দেশ, জাতি বা ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয়টিই সবচেয়ে বড় দেখে।

চিন্তা করে দেখুন আমরা এসেছি বাংলাদেশ থেকে ভারতে, অফিসিয়ালি বেড়াচ্ছি ভারতে, আর খাচ্ছি নেপালের ফুংসুকের হোটেলে বসে। ফুংসুকের বাড়ি তিব্বতে। এতো জটিল ইকুয়েশন আমাদের মধ্যে আন্তরিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এটাই বোধ হয় মানবতা।

আমাদের ছবিগুলো দেখলে হয়তো কল্পনায় ঘুরে আসতে পারেন মানেভঞ্জন চিত্রিতে।

মানেভঞ্জন যাবার জন্য যা যা লাগবে

১. মানেভঞ্জন ও সান্দাকফু ভ্রমণের জন্য মানসিক ও শারীরিক সামর্থ থাকতে হবে।
২.    ভারতের ভিসা লাগবে।
৩.    শীতের জামাকাপড় ও পাহাড়ে চলাফেরা জন্য উপযোগী জুতা।
৪.    ফাস্ট এইডের ওষুধপত্র
৫.    ম্যাপ।
৬.    মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাবার জন্য অবশ্যই গাইড নিতে হবে।
৭.    দুর্গম এলাকায় থাকা খাওয়ার জন্য টাকা পয়সা বেশি লাগে, তাই প্রয়োজনীয় টাকার থেকে বেশি টাকা সাথে থাকলে ভালো।
৮.    পারলে সান্দাকফু নিয়ে লিখা অনলাইন ব্লগ পড়ে আসবেন।

 যেভাবে যাবেন

১.    শ্যামলী বাসে করে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি 
২.    শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং
৩.    দার্জিলিং থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সরাসরি মানেভঞ্জন অথবা মিরিকের বাসে করে সুখিয়াপোখরি নেমে গাড়ি রিজার্ভ করে মানেভঞ্জন।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা, লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে একদম ভুলবেন না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  



বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।