ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

এভিয়াট্যুর

জার্নি বাই বাস- ফেনী টু মংলা

লিয়াকত হেসেন খোকন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৪
জার্নি বাই বাস- ফেনী টু মংলা

নানা বৈচিত্রের আধার আমাদের এই দেশ। এর ৬৪টি জেলাই বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ।

জেলাগুলো আয়তনেখুব বড় না হলেও দেখার আছে অনেক কিছু। বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী জেলায় গিয়ে বাস ধরে চললাম কুমিল্লা হয়ে অন্যান্য জেলায়। সফরসঙ্গী বিশ্বদ্বীপ চৌধুরী। ও  বার বার বলছিল, দূরে বহুদূরে যাব। দেখব শহর-বন্দর, গাঁও-নদী, খাল-বিল।  

 

বিশ্বদ্বীপ বয়সে আমার অনেক ছোট। বিশ্বদ্বীপ বলল, জানেন, কচুয়া থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়েও এলাকা জুড়ে পানি থাকে। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাড়ি-ঘর-দোর-বাস্তুভিটে। ওখানে প্রতিটি বাড়ির সঙ্গে একটি-দু’টি করে ছোট ছোট নৌকা বাঁধা থাকে। নৌকাই হলো বর্ষাকালে ওখানকার বাহন।  

 

শীতকালে পায়ে হেঁটে নয়তো রিকশায় এ পথে চলাচল করতে হয়। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়ল পরপর কয়েকটা পুকুর। বাস এতই দ্রুত গতিতে চলছে, যে একবার তাকালে কোনটা খাল আর কোনটা বিল বোঝা যায় না। ধানের ক্ষেত চোখেও পড়ে না।  

 

আপনা আপনি বেরিয়ে  এলো বাহ্ কী চমত্কার সড়কটি, চকচকে। যেতে যেতে হঠাতই চোখ আটকায় একটি লেখায় ‘মেঘনা সেতু’। প্রিয় মেঘনা নদীর নামেই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। বিশ্বদ্বীপ বলল, উপনদী গোমতী ওই মেঘনায় এসে মিশেছে। জানেন, গোমতী আর মেঘনা নদী দু’টি এখন শান্ত, স্তব্ধ, নীরব। মাঝে মেঘনার চর এতোটাই বড় যে আবার একটি সেতু তৈরি করতে হয়েছে ওখানে।  

 

এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। দেখি-দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট জেলে-নৌকায় ছইয়ের ভেতর জ্বলতে থাকা টিমটিমে লণ্ঠনের আলোগুলোর জন্য বোঝা যায়। আঁধারে মনে হয়, আকাশ নেমে এসেছে মেঘনার জলে। ছইয়ের ভেতর লণ্ঠনের আলোগুলোকে দূর থেকে মনে হলো, এ যেন তারা। এরা নড়ে, ঘুরে বেড়ায়, কাঁপে, ওঠানামা করে ওপর-নিচে। অপলক দৃষ্টিতে রাতের মেঘনাকে দেখি, মেঘনা কখন যেন আপন হয়ে যায় অনুভূতি আর উপলব্ধিতে।

 

বিশ্বদ্বীপ পিঠে হাত দিয়ে বলল, দাদা, গীতা দত্তের গাওয়া ‘তোমায় দেখেছি তন্দ্রাবিহীন রাতের তারায় মেঘের বরণ চাঁদের ইশারায়। কখনও-বা ঝরা শাখে কখনও-বা মধু মাসে ভ্রমরার গানে ফুলে ফুলে গানের ধারায়। তোমায় দেখেছি কুলকুল রবে নদী যেথা যায়...’ গানটি শুনেছেন! বললাম, হ্যাঁ শুনেছি। বিশ্বদ্বীপ বলল, বলুন  তো দাদা, এমন গান কি আর হবে! গীতা দত্তের সুমিষ্ট কণ্ঠের কী আর তুলনা হয়! গোসাইরহাটে জন্মেছিলেন গীতা। চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মার ওপারেই সেই গোসাইরহাট। কত স্মৃতি রেখে গেলেন গীতা দত্ত, তার কথা আজ ক’জনেইবা মনে রেখেছে! এই গীতা দত্তই তো ‘হারানো সুর’ ছবিতে গেয়েছিলেন, ‘তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার। কানে কানে বলো একবার...’।  

 

কথাগুলো শুনে সেই গোসাইরহাটে যাওয়ার স্মৃতি বার বার মনে পড়ল। যেদিকে তাকাই মনে হয়, গীতা দত্তের গানের কথার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকৃতির অপরূপ মিল রয়েছে।  

 

বাস চলছে। মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ জেলা পেরিয়ে আবার দুই নদী। আকারে তারা যেন দুই যমজ বোন- শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার তীরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। রাত সাড়ে ১২টায় চাঁদের স্নিগ্ধ জোছনায় ঢাকা শহরের চরাচর ভেসে যাচ্ছে। কিছু পথ এগোতেই সাভারে, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে আলোকসজ্জিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সামনের দীঘির জল আলোর বাহারে নীল-নীল মনে হলো। ভাবলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান শহীদদের অসামান্য ত্যাগ ও শৌর্যের স্মৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সৌধটিকে জোছনার আলোয় বড়ই মায়াবী লাগল।  

 

বিশ্বদ্বীপ এবার বলল, এই রাতে তো ঘুম আসছে না। কী সুন্দর লাগছে ভ্রমণের এই রাত। আহা, এমন রাত কী আর এ জীবনে কোনোদিন পাব! 

 

রবি ঠাকুরের লেখনীতে অমরত্ব পাওয়া ধলেশ্বরীর শাখানদী কালীগঙ্গা পেরিয়ে মানিকগঞ্জ। এই মানিকগঞ্জেই জন্ম নেন বিখ্যাত বম্বে টকিজের কর্ণধার হিমাংশু রায়। তিনি তো ‘কর্ম’ ছবি করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলে। হিমাংশু রায়ের স্ত্রী দেবিকা রানী ইন্ডিয়ান ফিল্মের ফার্স্ট লেডি ছিলেন। কথাগুলো শুনে বার বার মনে পড়ল দেবিকা রানীর কথা। তার অভিনীত ‘অচ্ছুত কন্যা’, ‘ইজ্জত’, ‘সাবিত্রী’, ‘জন্মভূমি’, ‘জাওয়ানী কি হাওয়া’। কথা বলতে বলতে প্রায় ত্রিশ বছর আগে ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই ক্ষণটি চোখের পাতায় বার বার ভেসে উঠল। দেখেছি, বৃদ্ধা বয়সে কী সুন্দরী ছিলেন তিনি। সিল্কের শাড়িই পরতেন দেবিকা রানী তার শেষ বয়সে।  

 

হঠাৎ দেখি মাঝরাতে পদ্মা নদীর তীরে বাস এসে দাঁড়ায় আরিচা ঘাটে। বাস উঠবে বার্জফেরিতে। তিন নম্বর জেটিতে ফেরি আসে, বাস ওঠে। সামনে বিশাল পদ্মা নদী। কিছু আগে পদ্মা ও যমুনার মিলন হয়েছে। তাই পদ্মা এখানে এতটাই চওড়া যে একূল থেকে ওকূল কিছুই দেখা যায় না।  

 

এই সেই পদ্মা যাকে বাঙালি ‘মা’ বলে ডাকে, গান বাঁধে ‘মেঘনা কাছের, পদ্মা হৃদয়ের...। ’ সেই ক্ষণে বিশ্বদ্বীপ আমার কানে শুনিয়ে দিল, ‘পদ্মা আমার মা, গঙ্গা আমার মা। ’ আকাশের পানে চেয়ে দেখি ‘চাঁদ’। সেই ক্ষণে কী সুন্দর লাগছিল এই পৃথিবীটা। তখনি মনে মনে আঁকলাম, ‘ওগো মায়াবী রাতের এক চাঁদ আমি আজ তোমারই মতোন। মনের মাধুরী দিয়ে পেতে চায় মন, পেতে চায় মন। ’ সেই ক্ষণে এমনটি ভাবতে বড্ড ভালো লাগছিল।  

 

বিশ্বদ্বীপ বলল, ফেরিতে একটু ঘোরাফেরা করি, চলুন। এগিয়ে চলা ফেরিটির তিনটি তলা। দোতলা আর তিনতলা জুড়ে ক্যান্টিন। ভাত, ইলিশ মাছের ঝোল পাওয়া যাচ্ছে। দেখলাম বহু যাত্রীই বাস থেকে নেমে রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছে। ক্যান্টিনের এক কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ইলিশ মাছ কোথাকার? কর্মচারী ভাইটি একটু হেসে বলল, পদ্মায় ধরা পড়া ইলিশ এখন আর পাচ্ছি না। যা কিছু ইলিশ ধরা পড়ে তা তো আগেই চালান হয়ে যায় ভারতে।  

 

আমি আর বিশ্বদ্বীপ ভাত খেলাম ইলিশ দিয়ে। খেয়ে-দেয়ে মনে হলো ষাট টাকায় ভাত ও এক টুকরো ইলিশে পেট ভরে তবে মন ভরে না। ক্যান্টিন থেকে নেমে ফেরির পাটাতনে এসে পদ্মার খুব কাছে ছলা‍ৎ ছলাৎ শব্দ শোনার অন্য এক অনুভূতি আসে মনে। গভীর রাতে পদ্মার জল সারা দেহে সযত্ন স্পর্শ রেখে যায় যেন। আহা, এমন রাতের কথা ভুলি কেমনে!

 

এবার ফেরি চলে আসে পদ্মা পাড়ের দৌলতদিয়া ঘাটে। ফেরি থেকে মুক্ত হয়ে বাস ছুটে চলে গড়াই ও কুমার নদের সেতু পেরিয়ে, যশোরের পথে। রাত সাড়ে তিনটায় যশোরে বাস থেকে নেমে খুলনার বাস ধরে ভোর সাড়ে পাঁচটায় খুলনা পৌঁছে দেখি তখনও আঁধার। ভোরের আলো ফোটেনি।  

 

বাসে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে মনে মনে ভাবলাম, মংলা গেলে কেমন হয়। কথাটা পাড়তেই বিশ্বদ্বীপ বলল, মংলা গেলে তো ভালোই লাগবে। প্রচণ্ড শীত। শীতে কাঁপছি, দেখি ওই যে রূপসা কুয়াশায় ঢেকে আছে। রূপের ডালি নিয়ে রূপসা এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। পাড়ে কত সব নৌকা।  

 

কাউকেই দেখা যাচ্ছে না—মনে হলো শীতে মাঝি ঘুমাচ্ছে, নৌকাগুলোর অবস্থাও বুঝি তাই। রূপসাকে বহুবার দেখেছি, আজও মনে হলো রূপসা কত চঞ্চলা, কত প্রাণময়। ভরা যৌবনা রূপসার পাড়ে খুলনা। পৌঁছে গেলাম বাংলাদেশের পুব থেকে পশ্চিমে। বাস ধরে এবার আমরা এগিয়ে চলছি মংলার দিকে।  

 

রূপসা ব্রিজে বাস উঠতেই বিশ্বদ্বীপ গান ধরল, ‘এই দেশ এই মাটি বুক ভরা এই নদী ফুলে ফলে ধন্য এই মাটি। এ দেশ তোমার আমার/ এই শস্য ভরা মাঠে যখন কালবোশেখী ডাকে/ এই সোনা ফলা মাটি যখন ধানের জলে ভাসে...। ’ গানের কথাগুলো মনে করিয়ে দিল এই বাংলাদেশের রূপের কথা।  

 

খুলনা থেকে জাতীয় সড়কের রাস্তা ডান দিকে বেঁকে গিয়েছে। দক্ষিণে মংলা বন্দর। খুলনার রূপসার ওপর দিয়ে যে ব্রিজটি গিয়েছে এর নাম এখন খান জাহান আলী সেতু। এই সেতু থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব ৪২ কিলোমিটার। বাসের এক যাত্রীর মুখে শুনলাম, এই রূপসা নদী খুলনা ও বাগেরহাট জেলার সীমানা। মংলায় এসে এক হোটেলে উঠলাম। তখন সকাল ৮টা বেজে গেছে। মংলা বন্দরে গিয়ে দেখি ছোট বড় জাহাজগুলো মংলা নদীতে স্থির হয়ে ভেসে আছে। কোনো নড়ন-চড়ন নেই, যেন এতটা সকালে ঘুম ভাঙেনি কারও।

 

হোটেলে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত বিশ্রাম নিলাম। এদিকে যে রাত ৮টার বাস ধরে ঢাকায় ফিরতে হবে। বিশ্বদ্বীপ বলল, ঘণ্টা দুই সময় হাতে নিয়ে নদীতে ঘুরে বেড়াই। মংলা নদীর তীরে এসে নৌকা ভাড়া নিলাম। ভেসে চলছে নৌকা। মাঝি বলল, এই মংলা নদী পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে। তখন ছিল পশুর জোয়ার জলে ভরা। নদী-বাঁধ তেমন কিছুই চোখে পড়ল না। যা কিছু নদী তীরে তা একটি মানুষের হাঁটার পক্ষেও যথেষ্ট নয়। দেখলাম, ওই নদী বাঁধ মাঝে মাঝে ধান গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।  

 

ধান ক্ষেত আর পশুরের জলস্তর এখানে মিলেমিশে একাকাকার। আরও চোখে পড়ল, নদীর পাড়ে ছোট ছোট বাড়ি, তাতে গোলপাতার ছাউনি। নদীর কোলে গোলপাতাও যেন গলা জলে দাঁড়িয়ে। তার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় ধবধবে সাদা রাজহাঁস। রাজহাঁস জল থেকে মাঝে-মধ্যে উঠে আসে ডাঙায়। এক সঙ্গে হাঁটে, যেন মিছিলে শামিল। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এলাম মংলার তীরে।  

 

তারপর রেস্টুরেন্টে নাস্তা খেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। বাস ছেড়ে দিল। তখন মনে পড়ল, ‘বেলা যে ফুরায় আঁধার ঘনায়/ মোর দ্বারে কেন এলো পান্থ/ কি গান যে শুনাব তোমারে প্রিয়/ বাঁশরীর সুর হলো শ্রান্ত...’ গানের এই কথাগুলো।

 

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি..., ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।