ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

খেলা

দেশের প্রথম দাবা অলিম্পিয়াড ও কিছু কথা

এ কে এম মাজহারুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১২

ঢাকা ‍: অনুভবের বয়স তিন বছর চার মাস। কম্পিউটার বিজ্ঞানের শিক্ষক পিতার কাঁধে চড়ে হাজির দেশের প্রথম দাবা অলিম্পিয়াডে।

সেখানে অংশ নিয়ে সেরা পঞ্চাশে স্থান করে নিয়েছে ছোট্ট অনুভব।

সমবেত দাবায় অংশ নেয় গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে। অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া এই সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা প্রায় দুইশ’ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে গত ২৭ নভেম্বর দেশের প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো এই দাবা অলিম্পিয়াড।

প্রখ্যাত লেখক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবালের উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণায় শাহজালালে অনুষ্ঠিত এই অলিম্পিয়াডে আরো অংশ নেন দেশের দুই গ্র্যান্ডমাস্টার  রিফাত বিন সাত্তার ও এনামুল হোসেন রাজীব।

যোগ দেন বিশিষ্ট দাবা অনুরাগী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মাদ কায়কোবাদ ও ড. শাহাদাতুল্লাহ খান মিল্টন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াসমিন হক,  অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস,  অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল গণি,  রেজিস্ট্রার ইসফাকুল হোসেনসহ তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।

সমবেত দাবা ছাড়াও গ্র্যান্ডমাস্টাররা অংশ নেন চোখবাঁধা বা ব্লান্ড ফোল্ড দাবা প্রতিযোগিতায়।

সকাল সাড়ে নয়টায় জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই অলিম্পিয়াড। নানা রঙের পোশাক পরে ছোট ছেলে-মেয়েরা যখন সাদাকালো সারি সারি দাবাবোর্ডের সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে দাবা খেলছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চের সামনের খেলার মাঠটিতে তখন এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়।

গ্র্যান্ডমাস্টার রিফাত বিন সাত্তার বার বারই বলছিলেন বাংলাদেশের দাবার এত বড় আয়োজন আর কখনো হয় না। স্বাধীনতার ৪০ বছরে দেশকে দেওয়া এ এক দারুণ উপহার।

দাবা অলিম্পিয়াডের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণ জানার চেষ্টা করেছিলাম বাংলাদেশের দাবার ইতিহাস সম্পর্কে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নিজেকে দাবার উৎপত্তিস্থল বলে দাবি করে এসেছে।

ভারতীয় উপমহাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অনেকের মতে, গাঙ্গেয় সমতলভূমিতেই প্রথম দাবা খেলার সূচনা হয়েছিল। ৮ম থেকে ১০ম শতকে রচিত চর্যাপদে দাবাখেলার বর্ণনা পাওয়া যায়। দাবাকে এই অঞ্চলে ‘নওবল’ বলে আখ্যায়িত করা হতো।

মুঘল আমলে এটা শুধু রাজা-বাদশাদের খেলা বলেই পরিচিতি লাভ করেছিল। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা কেন্দ্রিক দাবাখেলার একটা ধারণা তৈরি হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে নওয়াব ওয়াজেদ আলী খান কলকাতায় দাবা টুর্নামেন্ট চালু করেন।

পূর্ব বাংলার আব্দুল হামিদ চৌধুরী নামে এক যুবক একবার সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব লাভ করেন।
নওয়াব সাহেব খুশি হয়ে তাকে ‘দাবার রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ’৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে দাবা বেশ জনপ্রয়িতা লাভ করে।

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেনের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান দাবা সংঘ গঠিত হয়।
১৯৭০ সালে কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দ জাহিদ মনসুরকে সঙ্গে নিয়ে সারা পাকিস্তান দাবা ফেডারেশন গঠন করেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজী মোতাহার হোসেনই এই অঞ্চলে দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।

১৯৬১ সালে পূর্ব-পাকিস্তান দাবা সংঘ গঠিত হবার পর প্রথম টুর্নামেন্টে তিনিই চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে কাজী মোহাম্মাদ শাকুর, কাজী মোতাহার হোসেনকে হারিয়ে চ্যাম্পয়িন হন এবং টানা ’৭০ সাল পর্যন্ত খেতাব ধরে রাখেন।
স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন গঠিত হয়। কাজী মোতাহার হোসেন এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি মনোনীত হন।

তখনকার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দাবা খেলোয়াড়রা হলেন- অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক শরফুদ্দিন রেজা হাই,  কেএম শাকুর, কামবার আলী, ড. মির্জা আকমল হোসেন,  এসএম বখত,  কাজী সাদেক হাসান,  ফেন্সি মনসুর এবং মিয়া আব্দুস সালেক। সেই সময় চ্যাম্পিয়নকে বলা হতো চ্যালেঞ্জার।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত নিয়াজ মোরশেদ টানা চারবার চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু হয় জাতীয় মহিলা দাবা। রানী হামিদ পর পর ১২ বার চ্যাম্পিয়ন হন।

১৯৮৬ সালে নিয়াজ মোরশেদ উপমহাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার হবার কৃতিত্ব লাভ করেন।

এরপর জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, এনামুল হোসেন রাজীব ও আব্দুল্লাহ আল রাকিব যথাক্রমে গ্রান্ডমাস্টার লাভ করেন।

কেন এ খেলা উৎসাহিত করা প্রয়োজন : দাবা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও জটিল খেলা। বিভিন্ন  গবেষণায় দেখা গেছে- দাবাখেলায় স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। দাবাখেলা মনোযোগ বাড়িয়ে শিশুদের স্বাধীন ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শেখায়।

বৃদ্ধি করে কল্পনাশক্তি ও সৃষ্টিশীলতা। দাবা সাবধানী করে এবং দুই দিকে তাকিয়ে পথ চলতে সাহায্য করে। এ খেলা শিশুদের স্কুল-গ্রেড উন্নীত করে। এছাড়াও এ খেলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্ততিতে আগ্রহী করে তোলে।
মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়, সহনশীল অথচ প্রতিযোগী মনোভাব তৈরি করে। সর্বোপরি বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে টিকে থাকার মানসিক সক্ষমতা অর্জন করতে সহায়তা করে দাবাখেলা।

সম্প্রতি আর্মেনিয়া স্কুল পর্যায়ে দাবা খেলা বাধ্যতামূলক করে সারাবিশ্বে দৃষ্টি আর্কষণ করেছে। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক, মনোযোগী ও মেধাসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম গঠনে দাবা হতে পারে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

দাবা শুধু একটি খেলাই নয়, এটি একটি দর্শন। চলুন, আমরা সবাই দাবার শক্তিতে অনুপ্রাণিত হই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ণৃবিজ্ঞান বিভাগ,  শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদশে দাবা অলিম্পিয়াড কমিটি।

বাংলাদেশ সময় : ১৬৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad