ঢাকা, বুধবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ক্রিকেট

৪৯-এ পা দিলেন ‘মুলতানের সুলতান’ ইনজামাম

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪০ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৯
৪৯-এ পা দিলেন ‘মুলতানের সুলতান’ ইনজামাম ইনজামাম-উল-হক/সংগৃহীত ছবি

১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। কিউইদের বিপক্ষে ১৪২ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে পাকিস্তান। জিততে হলে তখনো ৯০ বলে দরকার ১২০ রান। ক্রিজে আছেন সেসময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদ। ব্যাট হাতে তাকে সঙ্গ দিতে মাঠে নামলেন এক তরুণ ‘ব্যাটিং দানব’। মাঠে নেমে নিজের জন্মদিনে নিজেই নিজেকে জীবনের অন্যতম সেরা এক উপহার দিলেন। খেললেন ৩৭ বলে ৬০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। ১ ছক্কা আর ১০ বাউন্ডারিতে সাজানো ওই ইনিংসে অনায়াস জয় তুলে নিয়ে ফাইনালে পা রাখে পাকিস্তান। সেদিনই ক্রিকেট বিশ্ব পরিচিত হয় তরুণ ব্যাটসম্যান ইনজামাম-উল-হকের সঙ্গে।

ভক্তরা তাকে আদর করে ডাকে ‘মুলতানের সুলতান’। আর ডাকবে নাইবা কেন? ক্রিকেট পিচে তার বিশাল দেহের অলস ব্যাটিং, বিশ্বের বাঘবাঘা সব ফাস্ট বোলারদের আগুনে সব বলকে অনায়াসে মাঠের বাইরে ছুড়ে ফেলা, রান নিতে অনীহা মিলিয়ে সুলতানের মতোই ভঙ্গি ছিল তার।

তার সামনে গতিদানবদেরও মনে হতো মিডিয়াম পেসার। বিশেষ করে তার পুল আর স্ট্রেইট শট ছিল দেখার মতো। বলা হয় ফাস্ট বোলারদের স্বর্গ পাকিস্তানে তার চেয়ে সেরা ব্যাটসম্যান আর আসেনি।

আজকের দিনেও পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান অধিনায়ক হিসেবে দেখা হয় ইনজামামকে। ১৯৯২ সালের যার অধীনে তিনি বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পেয়েছিলেন সেই ইমরান খানের পর তাকেই পাকিস্তানের সেরা অধিনায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্রিকেট মাঠে তার সিনা টান করে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার মুহূর্ত ক্রিকেটভক্ত মাত্রই মনে থাকার কথা।

বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সঙ্গেও বিশেষভাবে জড়িয়ে ইনজির নাম। ১৬ বছর আগে মুলতান টেস্টেই নিজেদের প্রথম টেস্ট জয়ের খুব চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এদিকে ইনজামাম তখন প্রায় বাতিলের খাতায়। ম্যাচটা হারলেই দল থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা। ম্যাচের চতুর্থ দিন পর্যন্ত ম্যাচের লাগাম ছিল বাংলাদেশের হাতেই। কিন্তু ঘরের ছেলে ইনজি দাঁড়িয়ে গেলেন চওড়া ব্যাট হাতে। ডুবতে বসা ক্যারিয়ার বাঁচানো এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দলও জেতালেন, দলকে এনে দিলেন ১ উইকেটের এক মহাকাব্যিক জয়। বাংলাদেশের সমর্থকদের মনে যে ওই মুহূর্ত কাঁটার মতো আজও বিঁধে আছে তা না বললেও চলে। বাংলাদেশের বিপক্ষে মুলতান টেস্টে প্রায় একাই হেরে যাওয় ম্যাচ জিতিয়ে দেন ইনজিপাকিস্তানের সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান বলা হয় ইনজামামকে। তার ঝুলিতে আছে ২০ হাজার ৫৮০ আন্তর্জাতিক রান, যা পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ওয়ানডে ক্রিকেটে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় শীর্ষস্থানে আছেন তিনি। ৩৭৮টি ওয়ানডে ম্যাচে ১১ হাজার ৭৩৯ রান করেছিলেন তিনি। এছাড়া ১২০ টেস্টের ক্যারিয়ারে নিজের নামের পাশে যুক্ত করেছিলেন ৮ হাজার ৮৩০ রান, যা পাকিস্তানের হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ। টেস্টে তার সর্বোচ্চ ৩২৯ রানের ইনিংসটি তার টেস্ট সামর্থ্যের একটি ঝলক মাত্র।

উইকেটের চতুর্দিকে শট খেলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ১৯৯১ সালে অভিষিক্ত হওয়া ইনজামামের। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৯২ সালের ওই সেমিফাইনাল দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের আগমন বার্তা জানানো এই ডানহাতি ফাইনালেও খেলেন ৩৫ বলে ৪২ রানের ইনিংস। ওই বয়সেই বিশ্বকাপের ট্রফি জেতার অনন্য স্বাদও পেয়ে যান তিনি।  ১৯৯৪ সালে করাচীতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ উইকেট জুটিতে মুশতাক আহমেদের সঙ্গে তার ৫৭ রানের জুটিও স্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯৯৫ সালে আইসিসি’র টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে আরোহণ করেন ইনজামাম। এক বছরের জন্য হাতছাড়া হওয়ার পর ১৯৯৭ সালে ফের শীর্ষস্থান নিজের দখলে নেন। ২০০১-০২ মৌসুমে লাহোরে কিউইদের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে ৩২৯ রান করেন, যা তার ক্যারিয়ার সেরা আর পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও সবমিলিয়ে ১১তম। ভারতীয় গ্রেট শচীন টেন্ডুলকারের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ১০ হাজার রান করা কীর্তিও তার দখলে।

আইসিসি’র ২০০৫ সালের বর্ষসেরা টেস্ট ও ওয়ানডে একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন ইনজামাম। তার দু’বছর আগেই অবশ্য তাকে নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব দেয় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড।  একসঙ্গে তিন গ্রেট- ওয়াসিম আকরাম, ইনজামাম ও ওয়াকার ইউনুস২০০৭ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে বাদ পড়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন ইনজামাম। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অবসরে যান। ম্যাচ শেষে তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা। একই বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলেন। তবে অবসরের আগ পর্যন্ত র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে বিশের বাইরে যাননি তিনি, এটাও একটা রেকর্ড।

এমনিতে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ ইনজামামের ক্যারিয়ারে তেমন কোনো বিতর্ক নেই। তবে সাহারা কাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি তিনি। গ্যালারি থেকে এক ভারতীয় সমর্থক তাকে ক্রমাগত স্লেজিং করছিল। মূলত তার স্বাস্থ্য নিয়ে কটাক্ষ করছিল ওই দর্শক। অনেকটা সময় সহ্য করলেও একসময় মাথা বিগড়ে যায় তার, সোজা গ্যালারিতে গিয়ে ওই দর্শককে পিটিয়ে আসেন তিনি। সেসময় তার হাতে ব্যাটও ছিল।  

ওই ঘটনা ছাড়া ইনজিকে মাঠে অতি শান্ত হিসেবেই দেখা গেছে। সেঞ্চুরি হাঁকিয়েও স্মিত হাসি আর হালকা ব্যাট তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেওয়া এমনকি দলের জয়েও তার অভিব্যক্তি ছিল অতি সাধারণ। শুধু তাই না, ব্যাট হাতে বোলারদের নাকের জল আর চোখের জল এক করে ফেলার সময়ও তার অভিব্যক্তি ছিল একই।

অবসরের পর আফগান ক্রিকেটে কোচ হিসেবেও সফল সময় কাটিয়েছেন ইনজি। তার অধীনে ক্রিকেটের সেসময়ের নবাগত আফগানরা প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলুড়ে দেশের (জিম্বাবুয়ে) বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বাদ পায়। বর্তমানে নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডে নির্বাচক হিসেবে যুক্ত আছেন তিনি। পাশাপাশি ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেও রয়েছে তার সরব উপস্থিতি।  

৪৯তম জন্মদিনে ‘মুলতানের সুলতান’র জন্য শুভকামনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৯
এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।