ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

থাইল্যান্ড

অনিশ্চয়তা-কষ্ট কাটিয়ে থাইল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত শাহিন

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
অনিশ্চয়তা-কষ্ট কাটিয়ে থাইল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত শাহিন শাহিনুল ইসলাম/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফুকেট (থাইল্যান্ড থেকে) থেকে ফিরে: কঠোর পরিশ্রমই সাফল্য এনে দিয়েছে শাহিনুল ইসলামকে (৩৩)। নিজের চেষ্টা আর এ পরিশ্রম দিয়েই বিদেশের মাটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি।

 

 

এক সময় ছিলেন সামান্য পরিচ্ছন্নতাকর্মী। যে মানুষটি মোটরসাইকেল ভ্যান চালিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, আজ তিনিই চালান লেটেস্ট মডেলের দামি জিপ।

নিজের দেশ বাংলাদেশ দেখাতে ভিনদেশি স্ত্রীকে নিয়ে ঘোরেন হেলিকপ্টারে।

গাড়ি-বাড়ি, কোটি কোটি টাকার সম্পদ- মর্যাদাপূর্ণ এ জীবনের অধিকারী খুলনার ছেলে শাহিন থাকেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডে। রাজধানী ব্যাংকক থেকে প্রায় ৮৬০ কিলোমিটার দূরের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আন্দামান সাগর তীরের পর্যটন নগরী ফুকেটে থাকেন তিনি।

যুগ যুগ ধরে অনেক বাংলাদেশিই বসবাস করছেন ফুকেটে। তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম শাহিন। সেখানে বাংলাদেশি হিসেবে অনেকের কাছেই তিনি এখন সাফল্যের প্রতীক।
ভিনদেশি স্ত্রীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে শহিনুল ইসলাম/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
এতো অর্জনের পরও চলাফেরায় খুবই সাধারণ, বিনীত আর নিরহঙ্কারী শাহিন কখনোই ভোলেন না ফেলে আসা জীবনের কথা। সামর্থ্য দিয়ে উপকার করেন প্রবাসীদের। বেশ গর্ব নিয়েই বলেন, ‘যখন ক্লিনার ছিলাম, তখন তো টয়লেটও পরিস্কার কইরেছি। কোনো কাজকেই ছোট ভাইবতে নেই। তাই তো আল্লাহ আমাকে এতোকিছু দিয়েছেন’।

খুলনার কয়রা উপজেলার অন্তাবুনিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র মৎস্যচাষি আব্দুল হাকিম সর্দারের ছেলে শাহীন। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট শাহীন ভাগ্যান্বেষণে ২০০৭ সালের আগস্টে পাড়ি দেন মালয়েশিয়ায়। ক্লিনার বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর ভিসায় মালয়েশিয়ায় যেতে খরচের দুই লাখ ২০ হাজার টাকা জোটাতে হয় সম্পত্তি বন্ধক আর ধার-দেনা করে।

শাহিন বলেন, মালয়েশিয়ায় বেতন ছিল মাত্র সাতশ’ রিঙ্গিত। বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। মালিক আটকে রাখলেন পাসপোর্ট। অত্যাচার আর দুর্ব্যবহার সইতে না পেরে পাসপোর্টের মায়া ছেড়ে চলে যাই অন্যত্র’।

সেখানে একই পেশায় কাজ করতেন থাই মুসলিম তরুরী মিমি ইসলাম। সেই থেকে বন্ধুত্ব।

২০০৮ সালের অক্টোবরে পুত্রজায়ায় এক অভিযানে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে ধরা পড়েন শাহিন। জেল হলো ১৫ দিন। দেশে ফিরবেন, সে প্লেন ভাড়া নেই। তখন মিমিই পাশে। অর্থের অভাবে তিনমাস জেলে থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হলো দেশে।

ফের মালয়েশিয়া যেতে চাইলেন। এবার সোজা পথে নয়। যেতে হবে ঘোরা পথে। থাইল্যান্ড হয়ে ঢুকতে হবে মালয়েশিয়ায়- দালালদের এমন প্ররোচনায় তাদের হাতে এ পর্বে তুলে দেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

কথা ছিলো সিঙ্গাপুর হয়ে থাইল্যান্ড। সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে ঢুকবেন মালয়েশিয়ায়।

২০০৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দালালরা নামিয়ে দেন থাইল্যান্ডের ফুকেটে। অচেনা দ্বীপ শহরটিতে নেমেই মনে পড়লো, মালয়েশিয়ায় একসঙ্গে কাজ করা থাই নাগরিক মিমির কথা। যোগাযোগ করে চলে গেলেন মিমির গ্রামের বাড়ি নারাতিয়ায়।

সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে গেলেন ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসে।

ততোদিনে হাতের টাকা শেষ। মিমির পরিবারের কাছ থেকে ধার-দেনা করেই চলতে হচ্ছে। তবুও অদম্য ইচ্ছে মালয়েশিয়ায় যাওয়া।

বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে সেখানে এক প্রবাসীর মাধ্যমে জানতে পারেন, শের আলী সানী নামের এক বাংলাদেশির নাম। যিনি থাকেন ফুকেটের পাতং বিচ এলাকায়।

চলে গেলেন তার কাছে। সেখানে সানির দর্জির দোকানে জুটলো কাজ। বেতন ৫ হাজার বাথ। টাকার অংকে সাড়ে ১১ হাজার। কাজ সেলসম্যানের। বাইরে থেকে গ্রাহক ডেকে আনা।

ইতোমধ্যে জুটে গেলো স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাওয়ার ভিসা। সব দেখে-শুনে ফরহাদ নামের একজন পরামর্শ দিলেন, প্রথমত ট্যুরিস্ট ভিসা, নেই দুইমুখি টিকেট, নেই পর্যাপ্ত অর্থও। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নামলেই নিশ্চিত আটক হতে হবে। আবারো ফেরত যেতে হবে দেশে।

এ পরামর্শে বিচলিত শাহিন থাইল্যান্ডেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বছরখানেক দর্জির দোকানে কাজ করে নিজেই চেষ্টা করলেন উদ্যোক্তা হওয়ারও।

বিয়ে করলেন মিমিকে। প্রথমদিকে মোটরবাইকের সঙ্গে ভ্যান যুক্ত করে তা নিয়ে নেমে পড়লেন রাস্তায়। সড়ক থেকে সড়কের ফুটপাতে বিক্রি করতে লাগলেন নুডুলস।

মোটরবাইক যুক্ত এ বিশেষ ভ্যানকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘সামলো’।

সূচনাতেই সাফল্যের ঝলকানি। পরে তার সঙ্গে যোগ করলেন বার্গার। এভাবে থাই ফুড, সি-ফুড নিয়ে শুরু হলো নবযাত্রা।

এখন একাধিক সামলো নিয়ে তার ব্যবসা। অভিজাত মার্কেটগুলোর সামনে বিকেল না হতেই বসে সি-ফুডসহ রকমারি খাবারের পসরা। মিমি আগে কাজ করতেন স্থানীয় একটি দোকানে। সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে দু'জনে মিলেই ব্যবসা সামলান এখন।


এখন পাতং বিচের মতো অভিজাত এলাকায় শাহিনের কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ডুপ্লেক্স বাড়ি, দামি গাড়ি। আর ব্যবসা সামলাতে রয়েছেন ১৬ জন কর্মচারী।

প্রথমবারের মতো স্ত্রীকে নিয়ে দেশে গিয়ে চমকে দিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দাদের। হেলিকপ্টারে করে অজো পাড়া-গাঁয়ে নেমেছেন স্ত্রীকে নিয়ে।

শাহিনের বদৌলতে পাল্টে গেছে তার গ্রামের বাড়ির চিত্রও। বড় ভাই এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বাবা মৎস্যজীবী থেকে হয়েছেন ইউপি সদস্য।

শাহিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ছিলাম সাধারণ একজন ক্লিনার। এখন আমার বাসাতেই সে কাজ করেন তিনজন। তবে আমি তাদের ক্লিনার ভাবি না। ভাবি পরিবারের সদস্য’।

‘আমার ইচ্ছে, দেশের মানুষের জন্যে কিছু করা। খোদার কাছেও আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ভাবছি, দেশে কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করে দেবো’- বলেন শাহিনুল ইসলাম।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০১৭
জেডআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।