ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

তাসনুভার গল্পটি সংগ্রামের, ভালোবাসার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৬
তাসনুভার গল্পটি সংগ্রামের, ভালোবাসার

তাসনুভা সারোয়ার তুন্না। মালয়েশিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডিধারী বাংলাদেশি নারী।

লজ্জাবতী থেকে ডায়াবেটিকের ওষুধ তৈরি কৌশলের ওপর তার গবেষণা সাফল্য থেকেই এই ডিগ্রি অর্জন। যারই ফল হিসেবে নামের আগে এখন ডক্টর শব্দটিও যোগ করতে পারছেন এই সংগ্রামী নারী।

বাংলানিউজকে তিনি শোনালেন তার সংগ্রামের গল্প। যার পেছনে প্রধানতম শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তার মা। আর ছিলো তার নিজের প্রচণ্ড মনোবল। এখন অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করছেন তার স্বামী।  

তাসনুভার এই জীবনের ছোট্ট কাহিনী তিনি লিখে পাঠিয়েছেন বাংলানিউজকে। প্রিয় পাঠকের উদ্দেশে সে গল্প তুলে ধরা হলো এখানে-
আমি তাসনুভা সারোয়ার তুন্না। বাবা গোলাম সারোয়ার ভূঁইয়া মা পারভীন সারোয়ার তুনি। আমার জীবনটা ছিলো সংগ্রামের, দারিদ্রের। আর তার মধ্যেই ছিলো ছোট ছোট কিছু তৃপ্তির তুষ্টির অর্জন। আরো লাখো মানুষের মতো আমার জীবনেরও রয়েছে কিছু অজানা দিক, না-বলা গল্প। তারই কিছু এখানে শেয়ার করবো। আমার জীবনের, আর যতটুকু সাফল্যই আমি অর্জন করতে পেরেছি তার অন্যতম ভিত হয়ে রয়েছেন আমার মা। তিনি ছিলেন গৃহবধু আর শ্বশুরবাড়ির সকলের আপত্তি সত্বেও তিনি আমাকে বাংলাদেশের সেরা স্কুলগুলোর একটিতে পড়িয়েছেন। সেটি ছিলো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। এমন একটি দামী স্কুলে পড়ানো সে পরিবারে ছিলো স্বপ্নেরও অতীত। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমার মা তার সংগ্রাম অব্যহত রেখে আমাকে একের পর এক ক্লাশ ডিঙ্গিয়ে অবশেষে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পড়া শেষ করান। এরপর তিনি আমাকে একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেন। প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটি নামের এই প্রতিষ্ঠান থেকে আমি আমার বি.ফার্ম, এম.ফার্ম সম্পন্ন করি। মাস্টার্সে আমি ছিলাম ভিসি গোল্ড মেডালিস্ট। আর এই মাস্টার্স যখন করছিলাম তখন আমি একটি স্কুলের পূর্ণকালীণ শিক্ষকও ছিলাম। সে ছিলো আমার অসম্ভব কষ্টের ব্যক্তিজীবন, যার সঙ্গে জড়িত ছিলো কিছু না-বলা দুঃখও। আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিলো আমি বিদেশে গিয়ে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করি। প্রথমে পারিনি, অবশেষে আল্লাহর রহমতে আমি মালয়েশিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ফার্মাসিউটিক্যাল টেকনোলজি বিভাগে পিএইচডি’র জন্য ভর্তি হলাম। সেও ছিলো এক সার্বক্ষণিক সংগ্রামের গল্প। ইউরোপীয় কোনও দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি যেতে পারতাম, কিন্তু আমার বাবা চাইছিলেন কাছাকাছি কোনও দেশেই যেনো পড়ি, আর সে কারণেই আমি ইসলামিক ইউনিভার্সিটিকেই বেছে নিলাম। আমার প্রধান সুপারভাইজার ছিলেন ড. জাইদুল ইসলাম সরকার। তিনিই আমাকে স্কলারশিপ পেতেও সহায়তা করেন।

লজ্জাবতী (বৈজ্ঞানিক নাম মিমোসা পুডিকা) থেকে ডায়াবেটিকের ওষুধ তৈরিই ছিলো আমার গবেষণার বিষয়। আমার মা একজন ডায়াবেটিক রোগী। ১৭ বছর ধরে তিনি এই রোগে ভুগছেন। তার এই রোগের প্রধান কারণই ছিলো আমার ও ভাই-বোনদের জন্য তার অব্যহত সংগ্রাম। আমার মায়ের জন্য আর সেইসব বাবা-মায়ের জন্যই আমার এই গবেষণা, যারা তাদের সন্তানের জন্য অত্যাহত সংগ্রাম করে করে তাদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতেই জীবনে নানা ধরনের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে এই ভয়াবহ রোগটির শিকার হন।
মালয়েশিয়ায় আমার জীবন ছিলো ঘুর্ণাবর্তের মতোই, চাপ, কঠোর পরিশ্রম, স্বপ্নভঙ্গ আর অব্যাহত সংগ্রামের। এটা সেই সব উন্নত দেশের মতো না, যেখানে আমরা চাইলেই খণ্ডকালীন কাজ করে কিছু অর্থ আয় করতে পারবো। সুতরাং এখানে আমার জীবন ছিলো আর্থিক টানাটানিরও। তবে মালয়েশিয়া আমাকে শিখিয়েছে আরও শক্ত হতে, আত্মনির্ভরশীল হতে, স্বাধীন হতে আর একজন ভালো মানুষ, ভালো মুসলমান হয়ে বেঁচে থাকতে। এসব কিছুই আমার অন্তরের শান্তি এনে দিয়েছে। আর মহান আল্লাহর সান্নিধ্য অনুভব করতে পারছি। এর মধ্যে অনেকটা নাটকীয়ভাবে আমার বিয়েও হয়ে যায়। আর আমার স্বামীও পড়াশোনায় সহায়তা করতে আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমার সংগ্রামের সঙ্গী হন। আমরা মালয়েশিয়ার বিচ টাউন কুয়ানতানে থাকি অতি স্বল্প সুবিধা নিয়ে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমরা যেকোনও পরিস্থিতিতেই একে অপরকে সহযোগিতা দিয়ে ভালবাসাপূর্ণ জীবন যাপন করছি। এভাবেই সম্প্রতি আমি আমার পিএচইডি সম্পন্ন করেছি। এখন কেউ চাইলে আমাকে ডক্টর বলে সম্বোধন করতে পারবেন।

জীবন কখনোই সহজ নয়, গোলাপের বিছানাও নয়। জীবন সার্বক্ষণিক সংগ্রামের, অব্যাহত যুদ্ধের। আর যখন সবকিছু কঠিন হয়ে ওঠে তখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় পরিবার, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর আর বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য। প্রত্যেকেরই তার নিজের গল্প থাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই পূর্ণ অধিকার রয়েছে তার কতটুকু অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবো আর কতটুকু গোপন রাখবো তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

এই প্রসঙ্গে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাসনুভা সারোয়ার তুন্না। গত ১৭ আগস্ট ‘ভালোবাসায় বিপত্তি ডিপেন্ডেবল ভিসা!’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

আমি মনে করি, খবর তৈরি আর পাঠক সৃষ্টির লক্ষ্যে সাংবাদিকদের কখনোই সাধারণ মানুষকে পূঁজি করা উচিত নয়। আমার জীবন নিয়ে তৈরি সাম্প্রতিক খবরটি আমাকে উভয়সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে- কী এমন ভুল আমি করলাম। আমিতো স্রেফ কিছু প্রশ্নের উত্তরই দিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিই জানতাম না তার মধ্য দিয়ে আমি জাতীয় খবরে পরিণত হব, আর তাও এক অসহায় দম্পতি হিসেবে!! এই সময়ের সামাজিক পরিস্থিতি দেখে আমি খুব দুঃখবোধ করছি, যেখানে সত্য গল্পগুলো অগোচরে থেকে যায় আর অতটা সত্য নয় এমন কিছুকে রঙ চড়িয়ে আমাদের জীবনের ওপর লেপন করা হয়।

বাংলানিউজের বক্তব্য: তাসনুভা সারোয়ার তুন্না ও তার স্বামীকাজী ইয়াসির জহির উদ্দিনকে নিয়ে বাংলানিউজে প্রকাশিত খবরটিতে একটি বিষয়কে সামনে আনা হয়েছে যা মূলত ডিপেন্ডেবল ভিসায় যারা মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন তাদের সমস্যাকে ফোকাস করে। এই দম্পতিকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য নয়। তারপরেও খবরটি সংগ্রামী এই দম্পতির মনোকষ্টের কারণ হলে, তার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।

বাংলাদেশ সময় ১১৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৬
এমএমকে   

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad