ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

ধূমপানে ২ বছর জেল, জরিমানা ২ লাখ

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১১ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৬
ধূমপানে ২ বছর জেল, জরিমানা ২ লাখ ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মালয়েশিয়া থেকে ফিরে: ডান্ডা মেরে নয়, ডেন্ডা দিয়ে ধূমপায়ীদের ঠান্ড‍া করে রেখেছে মালয়েশিয়া। মালয় ভাষায় এই ‘ডেন্ডা’ শব্দটির অর্থ শাস্তি।

পাবলিক প্লেসে ধূমপানের শাস্তি হিসেবে ১০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে মালয়েশিয় স্বাস্থ্য আইনে। বাংলাদেশি টাকায় যা প্রায় ২ লাখের সমান। ওই টাকা দিতে না পারলে নির্ঘাৎ জেলের ঘানি টানতে হবে ২ বছর। কপাল আরো খারাপ হলে একই সঙ্গে পড়তে হতে পারে জেল-জরিমানার খাঁড়ায়। তার মানে ২ লাখ টাক‍া জরিমানা দিয়েও গুণে গুণে ২ বছর কাটাতে হবে কারাগারে।

ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করতে মালয়েশিয় সরকারের এমন অহিংস নীতি অবশ্য কাজেও দিয়েছে বেশ। নিত্যদিনই যে আইন ভঙ্গের দায়ে কাউকে শ্রীঘরে পুরতে হচ্ছে তা নয়, শাস্তির বিধানটা কেবল আমজনতার চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে এই যা।
তবে অবস্থান ভেদে এই শাস্তির বিধান একেক স্থানে একেক রকম। কুয়ালালামপুর ও এর আশপাশের এলাকা ঘুরে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা ২ বছর জেলের ঘোষণা সম্বলিত সাইনবোর্ড পাওয়া গেলো বেশ কিছু স্থানে।

পুত্রাজায়া সেন্ট্রালে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময়ে কেউ টার্মিনালের এক পাশে গিয়ে ধূমপানের উদ্যোগ নিলেই ধাক্কা খাবেন একাকি দাঁড়িয়ে থাকা সাইনবোর্ডে। কোথাও কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হওয়ারও জো নেই। লুকোনো সিসি ক্যামেরায় ঠিকই ধরা পড়ে যাবে ‍‌আইন অমান্য করার জারিজুরি।
টার্মিনালের কিনারা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা সাইনবোর্ডটির শীর্ষভাগে লালের ভেতরে রিভার্স করে লেখা ‘দিলারাং মেরোকক’। এই মালয় শব্দ দু’টির বাংলা অর্থ ধূমপান নিষিদ্ধ। এর নিচে সাইনবোর্ডের জমিন জুড়ে সিগারেটের প্রতীকী ছবি লাল কালির ক্রস রেখায় নিষিদ্ধ করা। তারও নিচে কালো কালিতে শাস্তির বিধান।

টার্মিনাল বারসিপাডু সেলানটান (টিবিএস) থেকে বুকিত জলিলগামী লাইট ৠাপিড ট্রানজিট (এলআরটি) ট্রেনে দুই বগির সংযোগ স্থলে দরোজার উপরের একপাশেও দেখা গেলো, ১০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা বা ২ বছর জেলের সতর্কবাণী।
কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল থেকে কমিউটার ট্রেনে এসে বাতু কেভ স্টেশনে নামতেই চোখে পড়লো ওই ১০ হাজারেরই নিষেধাজ্ঞা। তবে স্থানভেদে এই জরিমান‍া ২০০ রিঙ্গিত থেকে ১০ হাজার রিঙ্গিতের মধ্যে ওঠানামা করে।

এই যেমন, মালয়ান অ্যালাইড হেলথ সায়েন্স একাডেমি (মাহসা) ক্যাম্পাসে ধূমপানের শাস্তি হিসেবে ২০০ রিঙ্গিত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। পাশেই ইউনিভার্সিটি অব মালয় ক্যাম্পাসে এই শাস্তি ৫০০ রিঙ্গিত।
এছাড়া সুনগাই বেসি, কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল ও টিবিএস স্টেশনে ৫০০ রিঙ্গিত, টিটিবাংসা থেকে কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল পর্যন্ত চলাচলকারী একমাত্র রুটের মনোরেল, মসজিদ জামেক থেকে তামান জায়াগামী এলআরটি, কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল থেকে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট (কেএলাইএ) গামী এক্সপ্রেস ট্রেন, বুকিত জলিল থেকে তামানজায়াগামী এলআরটি, পুডু সেন্ট্রাল, টিবিএস ও মালাক্কা সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাল ইত্যাদি স্থানে ‘দিলারাং মেরোকক’ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো।

যদিও অনেক স্থানেই সাইনবোর্ডে ‘ডেন্ডা’ বা শাস্তির বিধান না লিখে কেবল ধূমপানে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।   যেমন কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে কেবল সিগারেটের ওপর ক্রস দিয়ে ‘দিলারাং মেরোকক’ লেখা দেখা গেছে। তাতে শাস্তির বিধান তুলে ধরতে দেখা যায়নি।
উপরন্তু, কেবল, ধূমপান নয়, স্টেশন ও ট্রেননগুলোতে ধূমপান বিষয়ক সতর্কতার পাশাপাশি গণ-আচরণ নিয়ন্ত্রণে আরো কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে-প্লাটফর্ম ও ট্রেনে খানা-পিনা না করা,  প্রসাব না করা,  ময়লা না ফেলা,  গ্যাসীয় পদার্থ না নেওয়া,  পোষা প্রাণী না নেওয়া আর দৃষ্টিকটূ অন্তরঙ্গতা না দেখানোর সতর্কতা। এগুলোর যে কোনোটির জন্য ৫০০ রিঙ্গিত পর্যন্ত জরিমানার ঘোষণা চোখে পড়ে। মেগা শপিং মল আর বিপণীবিতানগুলোতেও এমন নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়ে হরহামেশা।

আর শাস্তির খাঁড়ায় পড়ার ভয়ে সবাই সতর্ক থাকায় কুয়ালালামপুরের টার্মিনাল, ট্রেনসহ পাবলিক প্লেসগুলো বেশ ঝকঝকে, তকতকে। শাস্তির চোখরাঙানি এড়িয়ে পাবলিক প্লেসে বেপরোয়া ধূমপায়ীর সংখ্যা নেহায়েতই হাতে গোনা। তবু বিকেলে গেন্টিং হাইল্যান্ডস সেন্ট্রাল, রাতে কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল, এমনকি এয়ারপোর্টেও কাউকে কাউকে ধূমপান করতে দেখা গেছে। যদিও পরিসংখ্যানের বিচারে এমন বেপরোয়া ধূমপায়ীর সংখ্যা নিতান্তই কম।
এমন কঠোর আইন করা গেলে বাংলাদেশেও প্রকাশ্যে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো নি:সন্দেহে।   বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপানের জন্য মাত্র ৫০ টাকা জরিমানার যে বিধান রয়েছে, তারও কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। এক্ষেত্রে স্পষ্টতই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ মালয়েশিয়া হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

মালয়েশিয়া ২০০৫ সালের ১৫ ডিসেম্বরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের গৌরবময় অংশীদার। দেশটির গণ-পরিবহন, সুনির্দিষ্ট পাবলিক প্লেস ও কর্মপরিবেশে ধূমপান নিষিদ্ধ। ব্যাংকের কাউন্টার, ইনডোর স্টেডিয়াম ইত্যাদি স্থানে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয় ধূমপান বিরোধী আইন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতীয় আইনের চেয়েও এই আইন শক্তিশালী।
দেশটিতে সব ধরনের ইনডোর স্টেডিয়াম, পাবলিক প্লেস, গণপরিবহন, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ট্রেন, বাস, প্লেন, লিফট, টয়লেটে ধূমপান নিষিদ্ধ।

সিগারেট ও তামাকের পক্ষে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ দেশটিতে।
মালয়েশিয়াতে ১৯৮৩ সালের খাদ্য আইনের আওতায় ধূমপান নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য কিছু সংশোধন এই আইনকে আরো কার্যকর করে তোলে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-তামাকজাত পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৪, তামাকজাত পণ্য (সংশোধন) আইন ২০০৮, ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ এবং ধুমপান মুক্ত এলাকা ঘোষণা ২০১১ ও ২০১২। ধূমপানের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার অবস্থান অনেকটা সর্বাত্বক যুদ্ধের মতো।

বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।