ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মালয়েশিয়া

এক টিলাতেই এক ডজন জাদুঘর!

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৬
এক টিলাতেই এক ডজন জাদুঘর! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

মালাক্কা থেকে: ছোট্ট এক পাহাড়ের ঢালেই অন্তত এক ডজন জাদুঘর গড়া হয়েছে ইতিহাসের শহর মালাক্কায়। বিশ্বের প্রধান বাণিজ্য রুট মালাক্কা প্রণালীর পূর্বপাড়ের এই টিলাটি মালাক্কা পাহাড় নামেই পরিচিত ছিলো।

১৪ শতকের আগ পর্যন্ত সাগরজীবীদের সব তৎপরতা পরিচালিত হতো ছোট্ট এই টিলা থেকেই।

শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের যুবরাজ পরমেশ্বর ১৪০০ সালে মালাক্কা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করে তার প্রশাসনিক কেন্দ্রও স্থাপন করেন এই পাহাড়েই। ১৫১১ সালে পর্তুগিজরা মালাক্কা দখল করে এই পাহাড়েই গড়ে তোলে দুর্গ আর গির্জা। মালাক্কা পাহাড়ের নাম পাল্টে রাখে সেন্ট পল’স হিল। ১৬৪১ সালে মালাক্কার মুসলিম শক্তির সহায়তায় পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে ডাচরা দখল করে নেয় সেন্ট পল হিল। দুর্গ ব্যবস্থাকে করে তোলে আরও শক্তিশালী। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ শক্তি মালাক্কা অধিকার করলে এই পাহাড়ই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মালাক্কা পাহাড় চলে যায় জার্মান-জাপান শক্তির কব্জায়।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শিকল গলে ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট মালয়েশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর একের পর এক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয় ইতিহাসের বিচিত্র গল্প ধারণ করা মালাক্কা পাহাড়ে।    বলা যায়, এ পাহাড়ের প্রতিটি ঢালেই একটি করে জাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। উত্তর-পূর্ব দিকে গড়া হয়েছে সুলতানের প্রাসাদ জাদুঘর।

মালাক্কার সুলতান মনসুর শাহ-এর রাজত্বকালে ১৪৫৮ থেকে ১৪৭৭ সালের মধ্যে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু পর্তুগিজরা মালাক্কা জয়ের পর ওই প্রাসাদ ধ্বংস করে দেয়।   পরবর্তীতে মালয় কাহিনিতে বর্ণিত তথ্য থেকে তৈরি করা হয় মালাক্কা প্রাসাদের রেপ্লিকা। সেই রেপ্লিকা প্রাসাদটি পরিণত করা হয় জাদুঘরে। তবে জাদুঘর ঘুরলে এটা যে রেপ্লিকা তা বুঝে ওঠা মুশকিলই বটে। প্রতিটি গ্যালারিতেই সাড়ে চারশো বছর আগের আবহ জীবন্ত হয়ে ফুটে রয়েছে।

প্রাসাদ মিউজিয়ামের পূর্ব দিকে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। সেখান থেকে প্রাচ্যের সবচেয়ে পুরনো উপনিবেশিক স্থাপত্যের নিদর্শন ১৫১১ সালে নির্মিত পর্তুগিজ দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পেরিয়ে একটু দক্ষিণে এলেই পাহাড়ে শরীর ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মালয় জাদুঘর। মালয়েশিয়ার ইতিহাস আর সংস্কৃতির পুরোটাই যেনো ঢেলে সাজানো হয়েছে এ জাদুঘরে। পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় জনগণের জাদুঘর (পিপল’স মিউজিয়াম) যুগান্তকারী এক ভাবনাই বটে। দক্ষিণ কোলে আছে ইউএমও জাদুঘর, ডাকটিকিট জাদুঘর, স্থাপত্য জাদুঘর আর ইসলামিক জাদুঘর। মালাক্কা তথা মালয়েশিয়ায় কী করে ইসলাম এলো, কোথায় কখন মসজিদ হলো- এর ধারাবাহিক বর্ণনা ও চিত্র ফুটিয়ে রাখা হয়েছে এই ইসলামী জাদুঘরে।

পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম ঢালে শহরের সবচেয়ে পুরনো ডাচ বিল্ডিং ক্রিস্ট চার্চের পাশে সিধওয়াস জাদুঘর। সেখান থেকে ক্রমে পূর্ব দিকে পাহাড় বেয়ে উঠলে মিলবে গণতন্ত্র জাদুঘর, শিক্ষা জাদুঘর আর সংস্কৃতি জাদুঘর। সংস্কৃতি জাদুঘরের পাশেই উপনিবেশিক আদলে গড়া গভর্নর ম্যানশন। এছাড়া সেন্ট পল দুর্গ ও গির্জার অবস্থান পাহাড়ের মাথায়। উত্তর-পূর্ব ও পূর্ব ঢালে ডাচ কবরস্থান।

সব মিলিয়ে তাই ইতিহাসেরই আধার হয়ে উঠেছে মালাক্কা বা সেন্ট পল পাহাড়। আর জাদুঘরগুলোতে প্রদর্শিত নিদর্শন তুলে ধরেছে মালাক্কা তথা মালয়েশিয়ার সমৃদ্ধ অতীতের সবটুকু রঙ।

এসব জাদুঘর দেখে ধারণা করতে কষ্ট হয় না, পাঁচশো বছর আগেও সুষম আইনের সুসংগঠিত সরকার ছিলো মালাক্কায়। মিলেমিশে বাস করতো বহুভাষী আর ধর্মবিশ্বাসের মানুষ। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য আর মধ্যপ্রাচ্যের মহামিলন ঘটেছিলো এই মালাক্কাতেই। এই মালাক্কার রীতি ও প্রথা যে ধ্রুপদী মালয় ভাষার জন্ম দেয়, পরবর্তীতে তাই পরিণত হয় অত্র অঞ্চলের ল্যাংগুয়া ফ্যাংকায়।

জাদুঘরে ইতিহাস জানিয়ে দেয়, ১৬ শতকে প্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বন্দর হয়ে উঠেছিলো এই মালাক্কাই। বিশ্ববাণিজ্যে যা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিলো পুরো ইউরোপকেও। পর্তুগিজ লেখক টম পিয়ারসের ভাষায়, পশ্চিমের টুটি চেপে ধরেছে মালাক্কার প্রভু। কার্যত এই মালাক্কার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে আধুনিক মালয়েশিয়া।  

১৯৪৬ সালে মালাক্কা হয় মালয়ান ইউনিয়নের অংশ। মালয় ফেডারেশনের অংশ হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পেদাং পাহলেয়ানে প্রথম মালয় প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের ফলশ্রুতিতে ১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জন করে মালয়। ১৯৬৩ সালে সাবাহ, সারওয়াক ও সিঙ্গাপুর নিয়ে মালয়েশিয়া গঠন হলে মালাক্কাও তার অংশ হয়। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল মালাক্কাকে ঐতিহাসিক শহর ঘোষণা করা হয়। ২০০৮ সালের ০৭ জুলাই ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা পায় মালাক্কা।   এমন বর্ণিল ইতিহাস ও বৈচিত্র্য চাক্ষুষ করতে এস জাদুঘর ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য কেনাকাটারও অনেক সুযোগ রয়েছে মালাক্কা পাহাড়ে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আসে ঐতিহাসিক স্যুভেনির থেকে শুরু করে হাল আমলের অনেক আধুনিক পণ্যের পসরা। রঙ-তুলি নিয়ে বসে রয়েছেন আঁকিয়েদের দল।     

ঘোড়ার গাড়ি আর সুসজ্জিত বর্ণিল রিকশায় সুযোগ রয়েছে পাহাড় প্রদক্ষিণ ও এর আশপাশের ঐতিহাসিক এলাকা পরিদর্শনের। ভাগ্য ভালো হলে মিলতে পারে পর্তুগিজ নাচ-গান দেখার মওকাও। রয়েছে প্রতীকী পর্তুগিজ জাহাজে জলদস্যুদের সঙ্গে সময় কাটানোর বিরল আয়োজন। বিভিন্ন জাতির খাবার-দাবারের স্বাদ নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে মালাক্কা বা সেন্ট পল পাহাড়ে। শেষ বিকেলে অন্যরকম সুন্দর হয়ে ধরা দেয় মালাক্কা পাহাড়। শহর ও প্রণালীর অনেকটা জুড়েই প্রসারিত দৃষ্টি জুড়ে যায় অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক আকর্ষণে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
জেডএম/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।