ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরে স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া বাংলাদেশি

ডলার না থাকলে এখানে ভাই ভাইকেও চেনে না

আনোয়ার হোসেন, সিঙ্গাপুর করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৭ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
ডলার না থাকলে এখানে ভাই ভাইকেও চেনে না ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সিঙ্গাপুর: ভোর হতেই কর্মস্থলে হাজির হয়ে কাজে নেমে পড়েন জামাল উদ্দিন। প্রখর রোদের তাপে সিদ্ধ হয়ে আর প্রতি মুহূর্তে মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর দিনশেষে কোম্পানির নির্ধারিত ডরমিটরিতে ফিরে গিয়ে ছোট্ট জায়গাটুকুতে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটি এলিয়ে দিতেই তাঁর চোখের সামনে নিজের পরিবারের ছবি ভেসে উঠে।

তার পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ আপন মানুষগুলো অন্তত পেট ভরে খেতে পারছে – এটা ভাবতেই যেন সব ক্লান্তি আর অবসাদ দূর হয়ে যায়।  

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কিংশ্রীপুর গ্রামের মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন (৩৪) আট মাস আগে সিঙ্গাপুরের একটি গৃহ-নির্মাণ কোম্পানিতে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসেছিলেন। দেশে স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধা মা আর পঙ্গু ছোট ভাই– এই তাঁর সংসার।  

মাসে বাংলাদেশি টাকায় চল্লিশ হাজার টাকা বেতনের কথা শুনে আগ পিছ না ভেবেই মনস্থির করে ফেলেছিলেন বিদেশে যাবেন। ধার দেনা করে দুই লক্ষ টাকা জোগাড় করে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান জামাল উদ্দিন।

কিন্তু, এক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, এখানে আয়ের পরিমাণ যেমন বেশি, ঠিক তেমনই খরচও হয়ে যায় চোখের পলকে। সারা মাস হাড়কিপটের মত চলার পরেও কোনমতে আয়ের অর্ধেক টাকা পাঠাতে পারেন দেশে। বিভিন্ন জনের পাওনা টাকাগুলো পরিশোধ করার জন্য তাই এবার প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে ওভারটাইম কাজ করতে লাগলেন তিনি।

কিন্তু পারিশ্রমিক নিয়ে কোম্পানি তাঁর সাথে প্রতারণা করবে– এটা তিনি কখনও ভাবেননি।

তিন মাস পর ওভারটাইমের পাওনা এগারশ’ ডলার চাইতে গেলে কোম্পানি থেকে তাঁকে জানানো হয়, নির্ধারিত মাসিক বেতনের বাইরে কোন পারিশ্রমিক তিনি পাবেন না। কারণ, তাঁর নিয়োগপত্রে ওভার টাইমের কোন শর্ত ছিল না।

দিগ্বিদিক হারিয়ে কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে তর্ক শুরু করেন। টাকা না দিলে তাঁকে দিয়ে ওভার টাইম করানো হল কেন?

ফলাফল – সাথে সাথেই তাঁকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে তাঁর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়া হল।

এবার চোখে অন্ধকার দেখছেন জামাল উদ্দিন। পারমিট বাতিল হওয়ায় তাঁকে দ্রুত সিঙ্গাপুর ত্যাগ করতে হবে। একদিকে দেশে পাওনাদারের টাকা আর অপরদিকে পরিবার আর নিজের স্বপ্ন ধুলিস্যাত হয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে গেলেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের মোঃ রাসেলের (২৪) কাহিনী কিছুটা ভিন্ন।

রোদের মধ্যে নির্মাণাধীন ভবনে একনাগাড়ে কাজ করতে করতে আর দুপুর বেলা কোম্পানির দেয়া নিন্ম মানের খাবার খেয়ে ফুড পয়জনিং হয়ে যায় তাঁর। জুরং পলি ক্লিনিকে চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ বাবদ বারশ’ ডলার খরচ করতে হয় তাঁকে। কোম্পানি থেকে এই টাকা চাইতে গেলে দুর্ব্যবহার করা হয় তাঁর সাথে।

কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হওয়ায় চিকিৎসার খরচ পাওয়ার অধিকার তাঁর আছে – এই দাবি করার কারণে তাঁকে বহিষ্কার আর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়া হল।

সহকর্মীদের পরামর্শে উভয়েই কোম্পানির বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরের শ্রম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করলেন। ফলাফল – অভিযোগ নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদেরকে সিঙ্গাপুরে থাকার অনুমতি দেয়া হল। কিন্তু, এই সময়ে সিঙ্গাপুরে কোথাও কাজ করতে পারবেন না তাঁরা। এখন নতুন করে চোখে অন্ধকার দেখছেন তাঁরা। কোম্পানি থেকে বহিষ্কার হওয়ায় তাঁরা আর ডরমিটরিতে থাকতে পারছেন না। অপরদিকে পেট চালাতে গিয়ে জমানো সম্বলটুকু প্রায় শেষ হওয়ার পথে।

বুধবার কর্মব্যস্ত দিনে সারা সিঙ্গাপুর যখন কাজে ডুবে আছে এই দুইজন তখন সেরাঙ্গুনের মুস্তাফা শপিং সেন্টারের সামনে শূন্য দৃষ্টিতে বসে ছিলেন।

কাছে গিয়ে আলাপ করতেই দুজনের বুক ফেটে হতাশার সাথে বেরিয়ে এল তাঁদের করুণ কাহিনী। দেশে নিজেদের কোন গতি করতে না পেরে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁরা। বিদেশ মানেই টাকা– এই ধারণা নিয়ে সবাইকে ছেড়ে এসে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন দুজনেই। এখন চাকরি হারিয়ে মানুষের কাছে হাত পাতার মত অবস্থা হয়েছে তাঁদের। আবার খালি হাতে দেশে ফিরে যাবেন – এই সাহসও করতে পারছেন না।

“এটা ডলারের দেশ। ডলার না থাকলে এখানে ভাই ভাইকেও চেনে না। নিজ দেশের অনেকেই আমাদের কাহিনী শুনেছে। সহানুভূতি দেখিয়েছে। কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়ায়নি কেউ। ” হতাশ কণ্ঠে বললেন জামাল উদ্দিন ।

“আমাদের মত আরও অনেকেই এখানে কোম্পানিগুলোর আমানবিক আচরণের স্বীকার হয়ে এখন শ্রম মন্ত্রণালয়ের বিচারের অপেক্ষায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিচারের রায়ে পাওনা টাকা ফেরত পাওয়া গেলেও চাকরিচ্যুত হওয়ার কারণে সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে হয় ” - জানালেন রাসেল ।

ছবি তুলতে চাইলে দুজনেই নিষেধ করেন। বলেন- আমাদের সব কিছুই তো শেষ হয়ে গেছে। এখন দেশে কারো কাছে আর মুখ দেখানোর জো নেই। দয়া করে পত্রিকায় আমাদের ছবি দেবেন না।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৬ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।