ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

রাজনীতি

আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, খালাস পাওয়ার যোগ্য: খালেদা

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৭
আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ, খালাস পাওয়ার যোগ্য: খালেদা আাদালতে হাজিরা দিতে গেলেন খালেদা জিয়া/ছবি: শাকিল

ঢাকা: বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। অন্যদিকে অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আত্মপক্ষ শুনানিতে নিজেকে পুরোপুরি নিদোষ দাবি করে খালাস পাওয়ার যোগ্য বলে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেছেন। 

মঙ্গলবার ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে জামিন পাওয়ার পরপরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এভাবেই ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন বিএনপি প্রধান।

এর আগে গত ৩০ নভেম্বর সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী ওই আদালতে যথারীতি হাজির না হওয়ায় তাঁর জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

একই সঙ্গে অরফানেজ মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানির এবং চ্যারিটেবল মামলায় সাফাইয়ের জন্য ৫, ৬ ও ৭ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়।

মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) ১১টা ৮ মিনিটের দিকে রাজধানীর বকশিবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ জজ আদালতে পৌঁছান খালেদা জিয়া । মামলার কার্যক্রম শুরুর জন্য ১১টা ১৪ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এরপর দুই মামলায় আদালতের কাছে খালেদা জিয়ার আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেন। চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার সাফাই সাক্ষ্য এবং অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় অসমাপ্ত যুক্তিতর্ক থেকে অবশিষ্ট আত্মপক্ষ-শুনানি গ্রহণ করার জন্য আবেদন করে শুনানি করেন তার আইনজীবীরা।

শুনানিতে আইনজীবীরা বলেন, গত ৩০ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে অসমাপ্ত বক্তব্যের জন্য দিন ধার্য ছিলো। ওইদিন আমরা আশা করেছিলাম, তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেবেন। কিন্তু হরতালে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার আদালতে আসতে বিলম্ব হয়।  

আদালতের উদ্দেশে খালেদার আইনজীবীরা আরও বলেন, আপনি তার (খালেদা জিয়ার)  নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিনের জন্য আবেদন করেছেন। তার জামিন মঞ্জুর করতে আমরা বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।  

আর দুই মামলায় অসমাপ্ত বক্তব্য না দিলে খালেদা জিয়ার ন্যায়বিচার হতে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা  রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তার আইনজীবীরা।  

এরপর দুদকের পক্ষে আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, জামিনের বিরোধিতা না করলেও খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে অসমাপ্ত বক্তব্যের বিষয়ে বিরোধিতা করছি।

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক জানতে চান,  বক্তব্য দিতে আর কত সময় লাগবে। ১৩৪ পেজ লিখেছি। কনসিডার করবো যদি বক্তব্য লিখিত আকারে দেন। আর বক্তব্য দিতে চাইলে দেবেন। তবে সেটা লিখবো না, শুধু শুনবো। প্রতিটা ওয়ার্ড লিখেছি। এভাবে কতদিন চলবে? আজকেই শেষ করবেন। আমি এটা আজকের মধ্যেই শেষ করতে চাই।  

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, আজকে কিছু বলবেন আর কিছু বাকি থাকলে লিখিত আকারে জমা দেবেন। তখন ‘কাউকে বঞ্চিত করবো না’ বলে বিচারক খালেদা জিয়াকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেন। এরপর সকাল ১১ টা ৩৭ মিনিটে খালেদা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। চার মিনিট আযানের বিরতি বাদে খালেদা জিয়া টানা ২ টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত আত্মপক্ষ শুনানিতে ক্তব্য দিয়ে তা শেষ করেন।

অরফানেজ মামলায় খালেদা জিয়ার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর আইনজীবী আব্দুর রেজ্জাক খান ৬ ও ৭ ডিসেম্বর ধার্য তারিখ পরিবর্তনের আবেদন করে বৃহস্পতিবার টু বৃহস্পতিবার মামলার ধার্য তারিখ রাখার আবেদন করেন।

দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এর বিরোধিতা করে বলেন, আগামীকাল ও পরশুদিন মামলার  তারিখ ধার্য রয়েছে। আমরা ওইদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করব।  

উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক আগামী ১৯, ২০ ও ২১ ডিসেম্বর ৩ দিন মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন। একই সঙ্গে ওইদিন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে খালেদা জিয়াকে তার অবশিষ্ট বক্তব্য লিখিতভাবে জমা দিতে বলেন।

খালেদা জিয়া আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রায় ৩ ঘন্টা বক্তব্যের উল্লেখযোগ্য অংশে বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট একটি প্রাইভেট ট্রাস্ট। এনিয়ে কারো কোনো ভিন্নমত নেই। প্রাইভেট ট্রাস্টটির আর্থিক কোনো অনিয়ম হয়েছে মর্মে ট্রাস্ট-সংশ্লিষ্ট কারো কোনো অভিযোগ নেই।  

সরকারের কোনো ফান্ড দিয়ে অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন হয়নি। কুয়েতের এককালীন অনুদান যে তদানীন্তন পররাষ্টমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক আনীত হয় মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুদকের তদন্তে বৈদেশিক অনুদান প্রাপ্তির বিষয়ে কোনোরূপ ভিন্ন দাবি কেউ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল নামে কোনোদিন বাস্তবভিত্তিক কোনো তহবিল ছিল এ জাতীয় কোনো ডকুমেন্ট প্রধানমন্ত্রীর দফতর হতে আসেনি এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কোনো অভিযোগও কেউ করেননি। নিয়মিত এবং আইনে বর্ণিত পন্থায় কোনো আপত্তিও বিজ্ঞ আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। আমাকে, জিয়া পরিবারকে এবং বিএনপিকে সম্পূর্ণ রূপে হয়রানি করার প্রয়াস এবং রাজনীতি থেকে দূরে রাখার অপপ্রয়াসে অনুমাননির্ভর ও কাল্পনিক অভিযোগে এ মামলায় মিথ্যা বর্ণনায় আমাকে জড়িত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মামলার অনুসন্ধানকালে বা তদন্ত কর্মকর্তা ১ নং সাক্ষী হারুন অর রশিদ এমন কোনো দালিলিক বা সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেননি। যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে পারেন যে আমি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করেছি। অথচ কোনো রকম প্রমাণাদি ছাড়া সাক্ষী হারুন অর রশিদ মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র এবং তার জবানবন্দিতে আমার বিরুদ্ধে এই মর্মে একটা ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন যে, আমি নাকি আমার দুই পুত্র এবং আমার আত্মীয় মোমিনুর রহমানকে দিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট গঠন করিয়েছি।

সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আরো বলেন, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ বিশেষ করে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের কতিপয় সদস্য প্রায় আমাকে জড়িয়ে জনসমক্ষে মিথ্যা বক্তব্য প্রচার করছেন। সাক্ষী হারুন অর রশিদ জবানবন্দিতে আমাদের বিরুদ্ধে যেসব মনগড়া ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে সেই সব অপপ্রচারণার একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। যা থেকে আপনি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন হারুন অর রশিদকে এই মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা, মামলার বাদী এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়েছে।  

বক্তব্যের শেষাংশে খালেদা জিয়া বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগসমূহ আমি প্রত্যাখান করে আমি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। আশা করি, এ মামলায় আমি বেকসুর খালাস পাওয়ার যোগ্য।  

আমি আমার বক্তব্য পেশ করছি সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতের তরজমার মধ্য দিয়ে। যার অর্থ হলো:
‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা ন্যায়ের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো। যদি তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা, কিংবা তোমাদের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষতির কারণও হয়; (যদি পক্ষগুলোর একটি) বিত্তবান হয় অথবা বিত্তহীন, তবু আল্লাহই তাদের শুভাকাঙক্ষী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর, কামনা-বাসনার অনুবর্তী হয়ো না। যদি তোমরা ন্যায়কে বিকৃত কর এবং ন্যায়বিচারকে অস্বীকার কর, অবশ্যই তোমরা যা করো সে সম্বন্ধে আল্লাহ ভালোভাবেই অবগত। ’ 

এর আগে গত ১৯ ও ২৬ অক্টোবর এবং ২, ৯, ১৬ ও ২২ নভেম্বর অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় এবং ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে দীর্ঘ বক্তব্য দেন।  

মামলায় বলা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায়  মামলাটি দায়ের করা হয়।  

২০০৯ সালের ৫ আগস্ট দুদক আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।  

অভিযোগপত্রে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে আসামি করা হয়।

২০১১ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটি দায়ের করে দুদক। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এ মামলায় ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়।

মামলাটিতে বিএনপি নেতার সচিব হারিছ চৌধুরী এবং তার তৎকালীন একান্ত সচিব বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খানকে আসামি করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৭
এমআই/ইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।