ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বিএনপি

দিশেহারা বিএনপি-৪

কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন

পলিটিক্যাল ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭
কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন

১/১১-এর পর বিএনপি একেবারেই হাত গুটিয়ে বসে আছে, কিছুই করেনি, এটা ঠিক বলা যায় না। নানা ইস্যু ও প্রসঙ্গে দলটি আন্দোলন করেছে বা আন্দোলনের চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আন্দোলন ও কৌশলের ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটি সমন্বয়হীনতায় আটকে থেকেছে বিএনপি। সম্ভাবনাময় আন্দোলন থেকেছে উপসংহারহীন। কোনো রেজাল্টাই পাওয়া যায়নি। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার প্রায় এক যুগ সময়েও দলের সাংগঠনিক কাঠামো পরিকল্পনা ও কৌশলগত দিকে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

আগের কিস্তি পড়ুন
** দিশেহারা বিএনপি-৩: নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য
** দিশেহারা বিএনপি-২ : দুর্নীতি-সুবিধাবাদে গ্রাস নেতৃত্ব
** 
দিশেহারা বিএনপি-১: দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প
১/১১-এর পর সংসদের ভেতরে ও বাইরে আন্দোলনের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নানাভাবে উত্তেজিত ও উস্কানির ফাঁদে বিএনপিকে ফেলে দিয়েছে।

বিভিন্ন কুতর্কে ও অহেতুক বিষয়ে বাক্য ও শক্তি ব্যয় করে বিএনপি কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি।

পরে নির্বাচন ও আন্দোলনের যুগপৎ পথও ধরতে পারেনি বিএনপি। বিগত নির্বাচনে যাওয়া ও না-যাওয়া নিয়ে দু’টি মত তৈরি হয়। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে পেশাজীবী-বুদ্ধিজীবীদের সভায় একজন বলেছিলেন নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তিনি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুদার মনিরুজ্জামান। তার মত ছিল, নির্বাচনে গেলে দল সাংগঠনিকভাবে শক্ত হবে, জনশক্তি প্রস্তুত হবে। প্রয়োজনে নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে অনিয়মের কারণে নির্বাচন থেকে সরে এলে বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বাধ্য হতো সরকার ও নির্বাচন কমিশন। বিদেশিরাও প্রধান অংশগ্রহণকারী বিএনপির সরে আসাকে মেনে নিতো না। তখন ওই একক নির্বাচনের বৈধতা থাকতো না।  

সভায় উপস্থিত বাকি সকলেই উগ্রভাবে নির্বাচনে না-যাওয়ার পক্ষে মত দেওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামানের মত গ্রাহ্য হয়নি। অনেকে মনে করেন, জামায়াত নির্বাচনে না-যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে বিএনপিকে ওই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। আবার আরেকটি শক্তিশালী মত এ রকম, সরকার প্রথম থেকেই চাইছিলো বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছে এবং সরকারকে একতরফা নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়েছে। এতে বিএনপি কী পেলো বা হারালো, সে হিসাব কষতে পারেনি দলটি।

নির্বাচন ছাড়া আন্দোলনের প্রশ্নেও বিএনপিকে সমন্বয় ও সিদ্ধান্তহীন দেখা গেছে। আন্দোলনের পাশাপাশি সংলাপ ও বিদেশি দূতদের সঙ্গে আলোচনায় দক্ষতা দেখাতে পারেনি তারা। নির্বাচন ও আন্দোলন যেমন বিএনপি একইসঙ্গে সফলভাবে করতে পারেনি, আন্দোলন আর আলোচনাও যৌথভাবে চালিয়ে যেতে পারেনি। আন্দোলনের বিভিন্ন গতিপথ ও মাত্রা তৈরি করতে পারেনি। একরেখায় আন্দোলন চালানোর সরকার যখন খালেদা জিয়াকে দৃশ্যত গৃহবন্দি করে ফেলে, তখন আর কিছুই করার থাকেনি দলটির পক্ষে।  

কৌশলগত দিক থেকে নানা বিকল্প নিয়েও পথ চলেনি বিএনপি। মনে হয়েছে, বিএনপির সকল পরিকল্পনা, কৌশল ও কর্মসূচি সরকার আগেই জেনে বসে আছে এবং নানা ব্যবস্থা নিয়ে সেটা বানচাল করছে। তীব্র সন্দেহ সৃষ্টি হয় কিছু নেতার সরকারের সঙ্গে আঁতাতের বিষয়ে। কর্মী ও সমর্থকরা আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত ও প্রস্তুত না থাকায় ব্যাপক জনগণের মতো তারাই নির্বাক দর্শক হয়ে থাকে।  

দেশের একাধিক বারের প্রধানমন্ত্রী, অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে শীর্ষ নেত্রীর পুলিশ ও প্রশাসনের হাতে অসহায়ভাবে বন্দি থাকার দৃশ্য টেলিভিশনে দেখে লাখ লাখ মানুষ হায়-আফসোস করেছে। কেউ কেউ গোপনে অশ্রুপাতও করেন। কিন্তু বিএনপি সেদিন দলীয় নেত্রীকে রক্ষা করতে এবং সরকারের একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। যে ব্যর্থতার মাশুল কেবল বিএনপি নয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও দিতে হচ্ছে। দল হিসাবে এই ব্যর্থতা সাধারণ মানুষের চোখে বিএনপিকে আস্থাহীন করেছে।

আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিএনপির সামগ্রিক প্রস্তুতি ও কৌশলজনক অবস্থানের প্রতিও মানুষের বিশ্বাস সৃষ্টি হয়নি। বিভিন্ন সেক্টরে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে সেটাকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। সরকার যখন মূলকেন্দ্রটিকেই অকেজো করে দিয়েছে, তখন পুরো আন্দোলনই মুখ থুবড়ে পড়ে। আন্দোলনে আহত-নিহত, মামলায় জর্জরিতদের রক্ষার জন্যও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সবাই তখন ব্যস্ত ছিল নিজেকে বাঁচাতে। এমতাবস্থায় তীব্র আন্দোলন অসম্ভব ব্যাপার। আন্দোলনে মানুষ টানাও কষ্টকর।  

নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিএনপি সামনে রেখেছে এমন কিছু মুখকে, যারা আমলাতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হলেও রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাহীন ছিলেন। পরে ঢাকা মহানগরের নেতৃত্বে থাকা সাদেক হোসেন খোকার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, যাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সবাই সেটা সঠিকভাবে পালন করেননি। আন্দোলনের মাঠে দায়িত্বের গাফিলতি আড়াল করতে তখন নেতারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ ও বিষোদগারে লিপ্ত হন। একটি বড় দলের মধ্যে ঐক্যের বদলে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সুপ্ত লড়াই দলটির আন্দোলনসহ সব কার্যক্রমের জন্যই ক্ষতিকর প্রবণতা।  

এমন দূরাবস্থা থেকে বিএনপিকে বের করে আনার দৃশ্যমান ব্যবস্থাও চোখে পড়ছে না। ফলে কৌশল ও কর্মসূচির দিক থেকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও দূরত্ব সঙ্গী করে আন্দোলনের মাঠে বিএনপি বেশি দূর যেতে পারছে না। বিএনপির এই সীমাবদ্ধতার পূর্ণ সুযোগ নিচ্ছে সরকার। আর সমন্বয়হীন বিএনপির দেশব্যাপী বিপুল নেতা-কর্মী ক্রমেই হতাশার গহ্বরের দিকে চলে যাচ্ছে।

দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল, নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত যে ব্রিজ জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া দিনে দিনে গড়ে তুলেছিলেন সেটাও ক্ষয়ে গেছে। সাংগঠনিক যোগাযোগ, নীতি-কৌশল-কর্মসূচি নিয়ে মত-বিনিময় ও প্রশিক্ষণ না থাকায় দলের সঙ্গে জনশক্তির সম্পর্ক আলগা হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব হচ্ছে না। দলের ও শীর্ষ নেতার ঘোরতর বিপদের সময় এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের সর্বাত্মক ও কার্যকরী অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এসব সমস্যা জিইয়ে রেখে বক্তৃতা, ভাষণ-বিবৃতির তুবড়ি ছুটিয়ে দলের সাফল্য আনাও সম্ভবত অসম্ভব ব্যাপার। দুঃখজনকভাবে বিএনপি এখন সেই অসম্ভব কাজটিই করছে, যার ফলাফল হবে আগের মতোই ব্যর্থতাপূর্ণ। আত্মসমালোচনা ও আত্মসমীক্ষার কষ্টি পাথরে ভুলের চোরাবালি থেকে সংশোধনমূলক শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোনোর প্রচেষ্টা বিএনপিতে এখনও ভীষণভাবে অনুপস্থিত।

পরের কিস্তি পড়ুন: দিশেহারা বিএনপি-৫: সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৭

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।