ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

বিএনপি

ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বনাম মাঠ নেতাদের দ্বন্দ্বে কাবু বিএনপি!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বনাম মাঠ নেতাদের দ্বন্দ্বে কাবু বিএনপি! ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বনাম মাঠ নেতাদের দ্বন্দ্বে কাবু বিএনপি!

ময়মনসিংহ: ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ডা. মাহাবুবুর রহমান লিটন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়কের পদ বাগিয়ে নেন। দলের ভেতরে-বাইরে তার একচ্ছত্র দাপটে সেই সময়ে অনেকেই ছিলেন কোণঠাসা।

ত্রিশাল উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি হওয়ায় পদাধিকার বলেই তিনি এখন ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি। আন্দোলন-সংগ্রামে এতোদিন মাঠমুখী না হলেও ঢাকায় বসে দলীয় রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতেই এখন উঠে-পড়ে লেগেছেন।

আর এ জন্যই ‘গাঁটছড়া’ বেঁধেছেন নিজের মতোই পেশায় ব্যবসায়ী দলীয় আরো তিন নেতা জাকির হোসেন বাবলু, মোর্শেদুল আলম ও লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবুর সঙ্গে।

দল পুনর্গঠন প্রশ্নে এ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে মাঠের নেতাদের মতবিরোধ ও বিভক্তি স্পষ্ট হওয়ায় নূন্যতম সাংগঠনিক অবয়বও হারাতে বসেছে দলটি। দু’বার সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়েও আর সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি।

কেন্দ্রে লবিইংয়ের জোরে মাঠ নেতারাও এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। ফলে ময়মনসিংহে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না দলটি।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালের দিকে কাউন্সিলের মাধ্যমে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র নতুন কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২০১২ সালের মার্চে কেন্দ্র থেকে ১৮৪ সদস্যের কমিটি করে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল গঠন করা হয় উত্তর জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি।

মাস দু’এক আগে দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র নেতারা সম্মেলন ড‍াকলেও প্রশাসনের বাধায় পণ্ড হয়ে যায়। এরপর আরেক দফা প্রস্তুতি নিয়েও কাজ হয়নি।

তবে দু’বারই আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে থাকা নেতারা অভিযোগ তোলেন, ঢাকায় বসে ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চালবাজি করছে। আর তাই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সম্মেলন।

দলের অনেক নেতা-কর্মীর ভাষ্যে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হিসেবে রয়েছেন ডা. লিটন। আর গেইম মেকারের দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সভাপতি এ.কে.এম. মোশাররফ হোসেনের সৎ ছোট ভাই ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বাবলু ওরফে ক্লাসিক বাবলু।

তাদের সিন্ডিকেটে রয়েছেন ‘টাকার কুমির’ খ্যাত ব্যবসায়ী মুর্শেদুল আলম ও মাজেদ বাবু ওরফে কালা বাবু। এর মধ্যে ডা. লিটন বাদে অন্যদের ছাত্র রাজনীতির কোনো অভিজ্ঞতা নেই! দলীয় রাজনীতিতেও তাদের বয়সও বস্তুত কম।

আন্দোলন-সংগ্রামে না থেকে নিজেদের ব্যবসা নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকেন বেশি, এমন অভিযোগও রয়েছে।

সূত্র মতে, এ সিন্ডিকেটের নেতারা চান কাউন্সিলের বদলে কেন্দ্র থেকে বিএনপি’র কমিটি। কাউন্সিল হলে তারা মাঠে টিকতে পারবে না- এমন আগাম শঙ্কায় নিজেদের পছন্দমতো কমিটি বাগিয়ে নিতে চাচ্ছে সিন্ডিকেট।

তবে মাঠের নেতা হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ, সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ফখরুদ্দিন বাচ্চু, দক্ষিণের সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ওয়ালিদ, ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন, মুক্তাগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক জাকারিয়া হারুন, দক্ষিণের সদস্য ফুলবাড়িয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমানসহ সাবেক ছাত্রনেতাদের বড় একটি অংশ প্রত্যাশা করছে- সম্মেলনের মাধ্যমেই আসবে নতুন নেতৃত্ব।

এ প্রসঙ্গে ত্রিশাল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকায় বসে দল চালানো ব্যবসায়ী নেতারা সম্মেলনকে বাধাগ্রস্ত করছে। আন্দোলন-সংগ্রামে এরা মাঠে থাকে না। ‘অতিথি’ হয়ে এলাকায় আসে। আমরা মাঠে থাকি, কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি।

এসব নেতারা মূলত ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ মন্তব্য তার।

সূত্র জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ.কে.এম. মোশাররফ হোসেন নিজের ছেড়ে আসা ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসন থেকেই পরবর্তী সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে ইচ্ছুক। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকেই দলীয় টিকিট পাওয়া বাবলু তাকে ছাড় দিতে নারাজ।

বছরখানেক যাব‍ৎ এ নিয়েই দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। একজন আরেকজনের ছায়াও মাড়াননি অনেকদিন।

কিন্তু দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র নতুন কমিটি গঠন প্রশ্নে একটি সুপারিশপত্র নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে নতুন করে ‘সমঝোতা’ হয়েছে, জানাচ্ছে সূত্র।

তবে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় মহাসচিব বরাবর লেখা নতুন কমিটির জন্য সুপারিশপত্রে তার স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগ তুলেছেন মোশাররফ হোসেন।

আর তার অনুসারী হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ জেলা যুবদলের সভাপতি শামীম আজাদ অভিযোগের আঙুল তুলেছেন বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন ও সাবেক ছাত্র নেতা, ভালুকা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ফখরুদ্দিন বাচ্চুকে।

তবে বাচ্চু ঠিকাদার হলেও দলীয় রাজনীতিতে তার শ্রম-ঘাম ও ত্যাগ নিয়ে কোন বিতর্ক নেই! আন্দোলনে মাঠে থেকে গুলিবিদ্ধ হওয়া ও তিন বার কারাবরণের রেকর্ড রয়েছে তার।

এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী শামসুদ্দিন আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র কমিটির জন্য মোশাররফ হোসেন গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ১১ ইউনিটের ২২ নেতার স্বাক্ষর করা খসড়া সুপারিশপত্রে নিজেও স্বাক্ষর করেছেন। হয়তো বা তিনি ভুলে গিয়ে অস্বীকার করছেন।

তিনি বলেন, পয়সা নিয়ে খেলা ব্যবসায়ী নেতারা মাঠে না থাকলেও দলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতের মুঠোয় রাখতে চান। প্রশাসনকে এরাই ভুল বুঝিয়েছে। এদের কারণেই সম্মেলন বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে।

প্রকৌশলী শামসুদ্দিনের কথায় সমর্থন দিয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামে না থাকলেও ব্যবসায়ীরা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে নেতৃত্বে আসতে চায়। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া কেবল দলের স্বার্থই দেখবেন।

আমি শতভাগ আশাবাদী, যারা দলের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত হামলা-মামলা উপেক্ষা করে কাজ করছেন তাদেরকেই নেতৃত্বে আনবেন।

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে ত্রিশাল উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ডা. মাহবুবুর রহমান লিটনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোর্শেদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, রাজনীতিতে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যারা সিন্ডিকেট বলে অপপ্রচার করছে তারা অতিরঞ্জিত করে এসব বলছে। কেন্দ্র যদি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি দেয় তবে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।