ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

আমলাদের প্রভাবে রাজনীতিতে কর্তৃত্ব হারাচ্ছেন রাজপথের নেতারা

মান্নান মারুফ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১০
আমলাদের প্রভাবে রাজনীতিতে কর্তৃত্ব হারাচ্ছেন রাজপথের নেতারা

ঢাকা: রাজনীতিতে আসা সাবেক সেনা কর্মকর্তা-আমলা আর ব্যবসায়ীদের প্রভাবে ক্রমেই কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছেন রাজপথে  লড়াই করা রাজনীতিকরা। ফলে তৃণমূল থেকে উঠে আসা পরীক্ষিত অনেক নেতাই হয়ে পড়ছেন রাজনীতি বিমুখ।

অনেক নেতাই গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেদের। দেশের প্রধান দুই দলের চিত্রই বলে দিচ্ছে এর সত্যতা।    

বর্তমান সরকারের মন্ত্রিপরিষদে স্থান পেয়েছেন ৬ জন সেনাকর্মকর্তা-আমলা। এছাড়া সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন আরও ২৭ জন। অন্যদিকে, বিএনপিও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এরকম ১৯ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়।

সংখ্যার দিক থেকে কিছুটা কম হলেও প্রভাব ও ক্ষমতায় এগিয়ে আমলারাই। সরকারি দল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার উপদেষ্টা হিসেবে যাদের নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও আমলারাই প্রভাবশালী। এরমধ্যে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহম্মেদ সিদ্দিকী, সাবেক আমলা এইচ টি ইমাম, তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী  ও ড. মশিউর রহমান সরকারের কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

প্রধান বিরোধীদল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসের সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশের সাবেক আইজি আব্দুল কাইয়ুম। তাকে গত বছর চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা করা হয়েছে।   এছাড়া সাবেক সচিব জহিরুল ইসলাম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা,সাবেক সেনা প্রধান মাবুবুর রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সাবেক কেবিনেট সচিব আব্দুল হালিম,মুফিকুর রহমান,সাবিহ উদ্দিন সহ ডজন খানেক আমলা বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।   অথচ উপেক্ষিত রয়ে গেছেন দল অন্তঃপ্রাণ অনেক নেতা। এ ছাড়াও একাধিক আমলা ও সামরিক কর্মকর্তা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

এসব ব্যাপারে দুই দলেরই প্রকৃত রাজনীতিকদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না নিজেদের অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে উপেক্ষিত এসব নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বেশিরভাগই নাম প্রকাশ করতে চাননি।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, ‘দল ক্ষমতায় আছে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমলাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। কোনো কাজ নিয়ে গেলেই নানা কথা বলে বিদায় করে দেয়। আমরা এখন সাবেক ও বর্তমান সব আমলাদের কাছেই বিরক্তিকর। ’

বড় দুই দলের ছাড়াও তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জাতীয় পার্টিতে আছেন এমন বেশ কয়েকজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। এ দলটির প্রধানই ছিলেন সামরিক শাসক।

বিএনপি’র একজন নেতা বলেন, ‘দীর্ঘ চাকরি জীবনে সুসময় পার করার পর এসব অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা শুধু লাভের আশাতেই দলে ভেড়েন তা সবাই জানে। ’

তাদের অবস্থানকে পাকা পোক্ত করতেই তারা দলগুলোতে যোগ দেন বলেও অভিমত ওই নেতার।    

বাংলাদেশের জন্ম থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনৈতিক পরিম-লে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।

বিশ্লেষকদের মতে, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি সুবিধাভোগী সেনা কর্মকর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতিমুখী করে তোলে।

জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থেকে উর্দি পরেই প্রেসিডেন্ট হন এবং পরে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তার আমলেই মূলত ১৯৭৮ সালের পরে দলে দলে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা রাজনীতিতে নিজেদের নাম লেখান।

একইভাবে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও রাষ্ট্র মতায় আসেন উর্দি পরে। এরশাদের শাসনামলে রাজনৈতিক দলসমূহে সাবেক আমলা-সেনা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে আসার হার আরও বেড়ে যায়।

নব্বই দশকের শুরুতে গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র পুনররুদ্ধারে কাজ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ওই সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেয়। অপরদিকে নতুন মুখ এনে চমক দেখায় বিএনপি, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতি।
 
১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ত্রিশ জনেরও বেশি ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও আমলাকে মনোনয়ন দিয়ে সুফল পায়। এর পর থেকেই ব্যবসায়ী-আমলারা বিভিন্ন দলে ভিড়তে শুরু করেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ সদস্যদের জবাবদিহি করতে হয় জনগণের কাছে। সেখানে দলে সাবেক আমলারা ঢুকে দল বা দেশ নিয়ন্ত্রণ করে এটা দুঃখজনক। ’

দেশের রাজনীতিতে সাবেক আমলা-সেনা কর্মকর্তাদের কর্তৃত্বের কারণে মূলধারার রাজনীতিবিদদের উপর জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুও এই সংস্কৃতির বিপক্ষে তার অভিমত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘পরীক্ষিত রাজনীতিকদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। এখন সব দলেই সাবেক আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রভাব বাড়ছে। এ কারণেই রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ’

রাজনীতিবিদরা যেভাবে জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে বা জনগণের দুঃখ কষ্ট বুঝতে পারে আমলারা তা বুঝার কথা নয় বলেও মন্তব্য করেন আবদুল মতিন খসরু।
 
বাংলাদেশ সময়:  অক্টোবর ০৪, ১০৪৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।