ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ভারতের ‘প্রথম নাগরিক’র অপেক্ষায় চট্টগ্রাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৮
ভারতের ‘প্রথম নাগরিক’র অপেক্ষায় চট্টগ্রাম ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়

এই সেদিন পর্যন্ত চল্লিশ মিনিটে চার দশমিক দুই কিলোমিটার হাঁটতে পারতেন। মানে কিলোমিটার পিছু দশ মিনিটেরও কম সময়। সম্প্রতি সেটা সামান্য নেমে হয়েছে তিন দশমিক সাত কিলোমিটার। আর তাতেই কিঞ্চিত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি।

ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘ব্যাপারটা কী হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। কিছু দিন আগেও তো দিব্যি আরও জোরে জোরে হাঁটতে পারতাম?’ চিকিৎসক উত্তর দেন, ‘আপনার কিছুই হয়নি স্যার।

কেবল নিজের বয়সটা আপনি খেয়াল করতে ভুলে গিয়েছেন। দিনে দিনে হাঁটার গতি যদিও কমে যায়, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। কেবল দেখবেন হাঁটাটা যেন বন্ধ না হয়। ’

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে রচিত সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের জীবনীগ্রন্থ ‘প্রথম নাগরিক’ শিরোনামের গ্রন্থটির শুরুটা এই রকম। ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম নিয়ে বিরাশি বছর ছুঁয়ে এখনও তিনি বেশ তরতাজা যুবক। অশীতিপর চেহারাতেও সংযম আর সদভ্যাসের ছাপ স্পষ্ট। এখনও চলিষ্ণু। বীরভূমের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উত্তর ভারতের ক্ষমতার শীর্ষ কেন্দ্র রাইসিনা হিলস হয়ে ঠিকই চলে আসছেন উপমহাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের শেষ বিন্দুটিতে।

১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাউজানের বিপ্লবী সূর্যসেনের স্মৃতিময় প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখবেন তিনি। একই দিনে বক্তৃতা করবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া বিশেষ সম্মানসূচক ডিলিট প্রদানের অনুষ্ঠানেরও। ‘অনুষ্ঠানটি হবে সংক্ষিপ্ত এবং ভাব-গাম্ভীযপূর্ণ’, বাংলানিউজকে জানান চট্টগ্রাম বিশবিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ফরিদউদ্দিন আহামদ। ‘স্বাগত ভাষণ দেবেন উপাচার্য, ধন্যবাদ জানাবেন উপ-উপাচার্য, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির বক্তৃতাই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ’, বলেন ড. ফরিদ। মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) দুপুরে ক্যাম্পাসের মধ্যস্থলে শহীদ আবদুর রব হল মাঠে আয়োজিত হবে অনুষ্ঠানটি।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আগমনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের মুকুটে আরেকটি সোনালি পালক সংযোজিত হবে। উৎসাহ ও উদ্দীপনা ক্যাম্পাসের চারদিকে। ‘আমরা একটি সর্বাঙ্গ সুন্দর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই’, বাংলানিউজকে বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কার্যকরী সদস্য মো. বখতেয়ার উদ্দিন। ‘এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার একাডেমিক মানচিত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আরও উজ্জ্বল ও সংহত হবে’, অভিমত এই তরুণ শিক্ষক নেতার।

প্রণব মুখোপাধ্যায় জীবনভর একজন বাংলাদেশ-সুহৃদ হিসাবে পরিচিত। জ্যোতি বসুর মতোই তিনিও পদ্মা-মেঘনা পাড়ের মানুষের চোখে একান্ত আপনজন। ছোটখাট গড়নের হলেও পণ্ডিত-ব্রাহ্মণ প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবনের পরিধি বহুধাবিস্তৃত এবং ঘটনাবহুল। জীবনের গোড়ায়, বস্তুত যৌবনের বেশ কয়েকটি বসন্ত পর্যন্ত রাজনীতিতে আদৌ রুচি ছিল না তার। লেখাপড়া আর শিক্ষকতা নিয়েই তিনি মত্ত ছিলেন।

বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের মাঝামাঝি তিনি রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন হঠাৎ করেই। ১৯৬৯ সালে বাংলা কংগ্রেসের তরুণ সদস্য হিসাবে সংসদের উচ্চকক্ষে তার প্রবেশ ঘটে। সেই থেকে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে নির্মাণ পর্যন্ত বিস্তৃত তার ক্রিয়া-কলাপ, বাংলা বা ভারতের রাজনীতিতে কেন, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেই যার সমতুল্য নজির নেই বললেই চলে।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ই একমাত্র বঙ্গসন্তান, যিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। সেটা তার সাফল্যের মুকুটে একটি উজ্জ্বল পালক অবশ্যই। কিন্তু সম্ভবত তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিয়য়টি হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এতো দীর্ঘদিন যাবৎ দ্বিতীয় কোনও বঙ্গসন্তান সদর্পে নিজের অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠা করে রাখতে পারেননি।

গত অর্ধ-শতক ধরে দিল্লির রাজনীতিতে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই ‘মিস্টার ইনডিসপেনসিবল’। ক্ষমতাসীন অবস্থায়তো বটেই, ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থাতেও। তিনি ছিলেন ভারতের ‘প্রথম নাগরিক’। মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে সেই অভিধাটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, এমন নয়। ভাবী ইতিহাস তো আরও অনেক পরিচয়ের সঙ্গেতাঁর এই অবিস্মরণীয় পরিচয়টিও স্মরণে রাখবে। আর তার স্বজাতির মণিকোঠায় তিনি তো বেঁচে আছেন এবং থাকবেন ‘প্রথম নাগরিক’ হয়েই।

দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে সমুদ্র ও পাহাড়-সংলগ্ন চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বিভাময়তার মতোই সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতিও অগ্রসরতার প্রতীক। স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে অগ্রণী চট্টগ্রামে সমসময়ের একজন বর্ষীয়ান-অগ্রগণ্য নেতার আগমন ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়রূপেই সবার কাছে বিবেচিত হচ্ছে।

প্রবণ বাবুর এটাই প্রথম চট্টগ্রাম সফর। এর আগে তিনি বাংলাদেশে এসে তার স্ত্রী’র পূর্ব-পুরুষের এলাকা নড়াইল সফর করেন। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে অবশ্য আরেকটি তথ্যও সংযুক্ত হলো। তিনিই প্রথম কোনও ভারতীয় শীর্ষ নেতা, যিনি চট্টগ্রামে আসছেন। এর আগে ভারতের কোনও সাবেক বা চলতি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রামে আসা হয় নি। চট্টগ্রামে প্রবণ মুখোপাধ্যায়ের সফর বহু দিক থেকে ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসে চিহ্নিত হবে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবেও।

বাংলাদেশ সময়: ২২১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৮
এমপি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।