ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ফিরে দেখা রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৭
ফিরে দেখা রুশ বিপ্লবের শতবর্ষ রুশ বিপ্লব। ফাইল ফটো

১৯১৭ সালে রুশ দেশে যে বিপ্লব হয়েছিল, ২০১৭ সালে তার শতবার্ষিকী। ১৯১৭ সালে সেখানে একটি নয়, ঘটেছিল দুটি ঘটনা।

প্রথমটি ঘটে ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন তৎকালীন শাসক জার নিকোলাস রাজদণ্ড পরিহার করে শাসন ক্ষমতা ত্যাগ করলেন, তখন। তৈরি হলো এক নতুন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার প্রধানমন্ত্রী হলেন আলেকজান্ডার কেরেন্সকি।

তার দলের নাম মেনশেভিক পার্টি। তিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী এবং রাজনীতিতে নরমপন্থি। তিনি ছিলেন রাজনীতিতে সংঘাতময় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের বদলে শান্তিপূর্ণ ক্রমপরিবর্তনের পক্ষপাতি।

মাঠে ছিলেন আরেক নেতা, নাম ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। তিনি বিপ্লবপন্থি। তাকে বলা হয় বলশেভিক। তিনি হুলিয়া মাথায় নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের আন্দোলনমুখর ঘটনার সময় আত্মগোপন করে ছিলেন ইউরোপের ছোট্ট দেশ সুইজারল্যান্ডে।

রুশ বিপ্লব।  ফাইল ফটো ১৯১৭ সালের শুরুর দিকে রুশ দেশের ঘটনাগুলো আরও আগেই সলতে পাকাতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি জার্মানি চাচ্ছিল রাশিয়ায় গৃহবিবাদ লেগে যাক। এজন্য রুশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে জার্মানির পক্ষে নানা রকম সংযোগ ও সম্পর্কও গড়ে উঠে। ভেতরে কেরেন্সকি আর লেনিন এবং বাইরে থেকে জার্মানি ছিল জার-পরবর্তী এবং বিপ্লব-পূর্ব রুশ দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ফ্যাক্টর।

কেরেন্সকি ঠিক করেছিলেন, সমাগত অক্টোবর মাসে নতুন সংবিধান পাশ করিয়ে রাশিয়ায় চালু করবেন প্রজাতন্ত্র।

এভাবেই তিনশ’ বছরের জার শাসিত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এর আগেই দেশে এসে লেনিন আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজের কব্জায় নিয়ে বৈপ্লবিক পন্থায় সংগঠিত করেন অক্টোবর বিপ্লব। জনচাপে অবস্থা বেগতিক দেখে কেরেন্সকি দেশত্যাগ করলেন এবং পরে তিনি মারাও গেলেন প্রবাসে, আমেরিকায় বসবাসকালে। নভেম্বর থেকে সূচিত হয় নতুন সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া।

অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, কাজাকস্তান, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, মলডোভা, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান, এই পনেরটি দেশ একত্রিত হয়ে ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ গঠন করে। পরে পূর্ব ইউরোপের পোলান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়া এবং সাবেক যুগোশ্লাভিয়া প্রভৃতি দেশেও সমাজতন্ত্রপন্থি দল ক্ষমতা দখল করে এবং দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসারীতে পরিণত হয়।

রুশ বিপ্লব।  ফাইল ফটো এই সমাজতন্ত্রকরণ সর্বক্ষেত্রেই শান্তিপূর্ণ ছিল না। রক্তাক্ত ও সহিংস ছিল। সৈন্য ও সাঁজোয়া বাহিনির শক্তি প্রয়োগ ছিল।

পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক বাহিনির অনুপ্রবেশ ও কিছু রক্ষপাতের ঘটনাও ঘটেছিল। ফলে রুশ বিপ্লবের পরে ক্রমে ক্রমে বিশ্ব বিভক্ত হয়ে যায় মতাদর্শিক কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের পর এই বিভাজন বিশ্বব্যাপী আরও তীব্র আকার ধারণ করে। তখন বিশ্বব্যাপী শক্তির লড়াইয়ে একদিকে ছিল সোভিয়েতভুক্ত ও পন্থি দেশসমূহ, আর অন্যদিকে পশ্চিমা দেশসমূহ। সরাসরি যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-যুদ্ধে উত্তেজক প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতির নাম দেওয়া হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডাযুদ্ধের কাল।

দুই বলয়ের মধ্যে বিভাজিত দ্বিমেরুকেন্দ্রিক পৃথিবীতে তখন ছিল টানটান উত্তেজনা।

১৯১৭ সালের দীর্ঘ ৭৪ বছর পর এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে।

আরও পরে, এ বছর (২০১৭) রুশ বিপ্লব যখন ১০০ বছর স্পর্শ করেছে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই, সেটাও প্রায়-তিরিশ বছর ধরে। সমাজতন্ত্রের তীর্থস্থান রাশিয়াও সেই আদর্শ ত্যাগ করে চলছে ভিন্নপথে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়েই রুশরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছে। ফলে খোদ রাশিয়াতেই বিপ্লব নিয়ে কোনও হৈচৈ নেই। প্রেসিডেন্ট পুতিন স্বয়ং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত আমলে ছিলেন রাষ্ট্রীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘কেজিবি’র অফিসার। তিনি নিজে সমাজতন্ত্র ত্যাগ করে ক্ষমতায় এসেছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে। সাবেক কেজিবি হলেও তিনি এমন কিছু পদ্ধতি পছন্দ করবেন না, যা তার দেশবাসী চাচ্ছে না। ফলে ১৯১৭ সালের বিপ্লব নিয়ে ক্রেমলিন চুপ, পুরো রাশিয়া নিশ্চুপ।

রাশিয়ার মতোই চুপচাপ পূর্ব ইউরোপের একদা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও। চীন সমাজতন্ত্রের নিজস্ব ধারায় চলছে, সেখানে কতটুকু লাল রং অবশিষ্ট আছে, সেটাই প্রশ্ন। চীনা অক্ষরে লেখা ‘সমাজতন্ত্র’ পশ্চিমী হাওয়ার নানা পালাবদলে টালমাতাল।

বিশ্বের কোনও কোনও প্রান্তিক বুদ্ধিজীবী এবং ভারতের অনেকগুলো রাজ্যের মধ্যে মাত্র কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদিতে কিঞ্চিত নাড়াচাড়া দেখা গেছে রুশ বিপ্লব নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের মেজোশরিক সিপিআই সামান্য আলোচনা করেছে বিপ্লবের স্মৃতি নিয়ে। বাংলাদেশে লাল পতাকা মিছিল করেছে ক্ষুদ্র বামধারার গ্রুপগুলো। এক সময় অর্ধ-দুনিয়া ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ বলে উচ্চকিত হলেও বিপ্লবের শতবর্ষের প্রান্তে সেই স্লোগান প্রায়-অন্তর্হিত, ক্ষীণ, কিন্তু লুপ্ত হয় নি।

রুশ বিপ্লব।  ফাইল ফটো রুশ দেশে লেনিন যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করেছিলেন, তার পেছনে ছিল মতাদর্শটির আদিগুরু কার্ল মার্ক্সের প্রণোদনা।

মার্ক্সই ভয় করেছিলেন গোঁড়ামি ও কুসংস্কারকে। বলেছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক গড, অ্যাই অ্যাম নট অ্যা মার্কসিস্ট। ’ সেই কট্টর দলতন্ত্র, একনায়কতা ও আমলাতান্ত্রিকতাই গিলে গেলো সব কিছু। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের গলা টিপে গোঁড়ামির মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে পরিচালিত করার নীতির জন্যই শেষ পযন্ত ভরাডুবির কারণ হলো, এমন মত বিশেষজ্ঞদের।

জার্মানির ত্রিয়া শহরের এক ইহুদি পরিবারে জন্ম নেওয়া দেশান্তরী কার্ল মার্ক্স (৫ মে ১৮১৮-১৪ মার্চ ১৮৮৩) সুদূর লন্ডনের মরাব্ল আর্চের কবরগাহে ঘুমিয়ে হয়ত সেই পরিণতির কথাই ভাবছেন। আর পৃথিবীর মানুষ চার পাউন্ড দামের টিকিট কেটে তার সমাধিগাত্রে লেখা ‘Workers of all Lands Unite’ বা ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বাণীটিই সমাজতন্ত্রের স্মৃতিস্বরূপ পাঠ করছে।

বস্তুতপক্ষে, ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর মাঝরাতে লেনিনের নেতৃত্বে রুশ দেশের পেত্রাগ্রাদ শহরের নেভা নদীতে ভেসে থাকা একটি জাহাজ থেকে যে বিপ্লবের ঘোষণা এসেছিল, তা তোপধ্বনির মাধ্যমে জয়োল্লাসে ছড়িয়ে পড়েছিল শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও বিপ্লবের সমর্থক সৈনিকদের জীবনে। মূলত সোসাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স বা বলশেভিক পার্টি ও এর সমর্থকদের নিয়ে লেনিন সেদিন ইতিহাসের পাতায় উৎকীর্ণ করেছিলেন, ‘মহান রুশ বিপ্লব’ নামক শব্দত্রয়। যদিও রুশ সম্রাট জারের পতনের পর পরই ১৯১৭ সালের প্রথমার্ধে ক্ষমতায় চলে এসেছিল শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি সোসালিস্ট রেভলুশনারি পার্টি বা মেনশেভিক দলের নেতা কমরেড কেরেন্সকির হাতে। কিন্তু অচীরেই কেরেন্সকিকে সহিংস অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে লেনিন হাসিল করেন মূল নেতৃত্ব ও ক্ষমতা। শেষ পযন্ত রুশ বিপ্লব-এর কর্তৃত্ব থাকে লেনিনেরই হাতে, যা সারা বিশ্বকে নানাভাবে আলোড়িত করে। সমাজতন্ত্রের স্লোগানে মুখর এ বিপ্লব পুঁজিবাদী বিশ্বকে ত্রস্ত করেও তুলেছিল। সর্বহারারা ভেবেছিলেন, ধনতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটবে, শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী সমাজবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে।

কিন্তু তা হয় নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর (১৯৯১) প্রশ্ন ওঠে, রুশ বিপ্ল কি ব্যর্থ? সমাজতন্ত্র কি অকার্যকর? পুঁজিবাদই কি শেষ পর্যন্ত বিশ্বের অদ্বিতীয় নিয়ন্ত্রক শক্তি?

বিশ্বের সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিতগণ নানাভাবে, নানা দিক থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেছেন এবং করছেন।

আরও দেখা গেল, লেনিন ও অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের মূর্তি উপড়ে ফেলার মধ্যে মানুষের ক্ষোভের একটি দিক যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনিভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আস্থা জ্ঞাপনের মধ্যে কমিউনিস্ট ইশতেহারকে ‘বিজ্ঞান’ বলতে জনগণ আর সম্মত হচ্ছে না। মতাদর্শ হিসাবে ‘বর্তমানহীন সমাজতন্ত্র’ সম্পর্কে অতএব সকল চিন্তাভাবনা ও আলোচনাই চলছে মূলত এর অতীতের সাফল্য-ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা নিয়ে। সমাজতন্ত্রের টিকে থাকার আশঙ্কা ও সম্ভাবনা ঘিরেই চলছে সকল বাদানুবাদ। কেউ কেউ আলোচনায় স্মৃতি রোমন্থন করছেন সোভিয়েতের লৌহ যবনিকার অন্তরালের নিবর্তনমূলক দিনগুলোকে; কেউ বলছেন হারিয়ে যাওয়া লাল স্বপ্নের কথামালা। এমনই বহুমুখীনতায় ইতি ও নেতির তুলাদণ্ডে পরিমাপ করা হচ্ছে রুশ দেশের বিপ্লবকে।

কিন্তু বুর্জোয়া সভ্যতার অবলুপ্তি ঘটিয়ে শোষিতের-রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও সমাজতন্ত্র পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছিল। মানুষের জীবনে একটি আশাবাদী স্বপ্ন এনে পরবর্তীতে ব্যর্থ হলেও সমাজতন্ত্র নামক মতাদর্শটি চরম শিহরণ জাগিয়েছিল।

রুশ বিপ্লব।  ফাইল ফটো বর্তমান কালে সেসব ইতিহাসের গর্ভে অদৃশ্য হলেও সমাজতন্ত্র পুরোটাই ব্যর্থ হয় নি। কারণ ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সমাজতন্ত্রের নানা স্মৃতি, পাওয়া ও না-পাওয়ার বিষয়গুলো এখনও মানুষকে ভাবাচ্ছে। এমন কি, সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ হয় নি বা মাটি-চাপা পড়ে নি সমাজতন্ত্র নামক রাজনৈতিক মতাদর্শের ভবিষ্যত সম্ভাবনার প্রসঙ্গটি।

ফলে বর্তমান বিশ্বের শাসন ব্যবস্থায় উহ্য ও নিঃশব্দ রাজনৈতিক মতাদর্শ হলেও রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে সমাজতন্ত্রের অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীর এখানে সেখানে কিছু আলাপ-আলোচনা স্থান পাচ্ছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।