ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

রোহিঙ্গাদের বাঁচতে দিন, ওরাও মানুষ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
রোহিঙ্গাদের বাঁচতে দিন, ওরাও মানুষ রোহিঙ্গা। ছবি: বাংলানিউজ


মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আছে। অথচ তারা আজ নিজ দেশের সরকারের অমানুষিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়ে বাঁচার অধিকারটুকু যেন হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে তাদের মৌলিক অধিকার বলতে কিছুই নেই। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসতবাড়িতে আগুন জ্বলছে, সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা সহস্রাধিক বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

গত দুই সপ্তাহে ২ লক্ষ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। প্রতিদিন এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা বাড়ছে।

তবে জাতিসংঘের অনুমান, সহিংসতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

আজ বড় প্রশ্ন বিশ্ব বিবেক কোথায়? মানবাধিকার নিয়ে যারা বড় বড় কথা বলেন তারাও কেমন যেন নীরব হয়ে গেছেন। জাতিসংঘসহ বিশ্ব সংস্থাগুলোর যে ভাবে এগিয়ে আসার কথা, সেভাবে কাউকে কার্যকর  ভূমিকা রাখতে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায়ও আমাদের দেশের সরকার ও জনগণ যেভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগিয়ে এসেছে তা প্রশংসনীয়।

রোহিঙ্গাদের উপর এ ধরনের নির্যাতন দীর্ঘ চার দশক ধরে চলছে। বলতে গেলে তাদের ইতিহাস খুবই করুণ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নানামুখী বৈষম্যের শিকার। যদিও যুগ যুগ ধরে তারা মিয়ানমারে বসবাস করছে। কিন্তু তাদের নাগরিকত্বের অধিকারটুকু ১৯৮২ সালে সামরিক শাসক দ্বারা প্রণিত আইনের মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়। অবাক লাগে তা কিভাবে সম্ভব, আমরা যত অবাক হই না কেন, বাস্তবতা হলো তারা নিজ দেশেই স্বীকৃতিহারা। তাদের যেন নিজস্ব ঠিকানা নেই, এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়তে পারে।

১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হয়। দেশটির স্বাধীনতার পরেও সেখানে রোহিঙ্গাদের বসবাস করতে কোন অসুবিধা হয় নি। নাগরিক হিসেবে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মতো তারাও নাগরিক সুবিধা ভোগ করত। কিন্তু ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তাদের উপর দমন নিপীড়ন শুরু হয়। সরকারি বাহিনী কিংবা রাখাইন উগ্রপন্থিদের ধাওয়া খেয়ে প্রায় সময়ই তাদের নিজস্ব আবাসভূমি ছেড়ে পালাতে হয়।

সামরিক জান্তাকে পরাভূত করে অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে আশা করা হয়, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা কিছুটা লাঘব হবে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারধারী সুচি সরকারের শাসন মানবতার পক্ষে থাকার প্রত্যাশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বের শান্তিকামী মানুষদের প্রত্যাশা সুচির কাছে অগ্রাধিকার পায় নি। তার নেতৃত্বাধীন শাসনামলে সামরিক সরকারের প্রণীত জাতিগত বিরোধ সৃষ্টিকারী নীতি বাতিল করা হয় নি। রোহিঙ্গাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে আসেনি, বরং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

এ নির্যাতন যেন থামছে না। এজন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে হবে। কারণ বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা দিন দিন প্রকট হবে। আমাদের এমন কোন অবস্থা নেই যে, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সাহায্য ছাড়া সহায়তা করা যাবে। এছাড়া মায়ানমার সরকার ও তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যার দায় আমরা কেন বহন করব।

এই রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ফিরিয়ে না দিয়ে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ঘটনা, অনেক বড় ঘটনা। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে ঘটনা তুলে ধরা হচ্ছে। যদিও মায়ানমার সরকারের বিবৃতিতে নির্যাতনের এসব ঘটনা অস্বীকার করা হচ্ছে। তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন মিডিয়ায় রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের খবর প্রচার হচ্ছে। শান্তিকামী মানুষ হিসেবে তা কারো উপেক্ষা করার উপায় নেই।

নাফ নদীতে লাশের সারি। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ, নদীতে ভাসছে শিশুর লাশ, কোথায় যেন বিশ্ব বিবেক আটকে আছে! মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের জোরালো প্রতিবাদ দরকার তা এখনও দেখা যাচ্ছে না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান থেকে কিছুটা আশা জেগেছে। অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন সিনেট এক যৌথ প্রস্তাবে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দলকে মিয়ানমার যেতে দেওয়া এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর অংসান সুচি গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন, যাতে বাইরের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি মিয়ারমার সরকারের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। গত ২৪ আগস্ট কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি, রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা, তাদের অবাধ চলাচল এবং সকল জনগোষ্ঠীর সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু এই প্রতিবেদন দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ২৫ আগস্ট রাখাইনে একযোগে ৩০ টি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয় বলে দাবি ওঠে সরকারের পক্ষে। এর জন্য রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) কে দায়ী করা হয়!

এ ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

রোহিঙ্গাদের এই দুঃসহ অবস্থা দেখতে ৭ সেপ্টেম্বর তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোগান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেগলুত কাভাসোগলুও কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে যান। রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।

কিন্তু সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর জোরালো তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি। তবে সব মিলে মিয়ানমার সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আগের চেয়ে বাড়ছে।

চলতি মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষণসহ একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তব্যে রাখাইনের সংঘাত ও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি গুরুত্ব পেতে পারে। ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতের অবস্থান মিয়ানমার সরকারের পক্ষে। এর পেছনে তাদের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িত বলে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল জ্বালানি সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে চীনের দৃষ্টি পড়ে। ২০১৩ সাল নাগাদ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ করে দেশটি। তেলের এ পাইপ লাইনটির মাধ্যমে বেইজিং মিডল ইস্টার্ন ও আফ্রিকায় তেল সরবরাহের সুযোগ পায়।

অন্যদিকে চীনকে রুখতে ভারতের কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সুচিকে। যার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন কিয়াওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অংসান সুচির সঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন পর্বের সূচনা করেন।

এদিকে রোহিঙ্গা সংকট ও তাদের উপর নির্যাতনে সুচির নীরবতার চড়া মূল্য দিতে হবে বলে নোবেল জয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা ও ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটু এক খোলা চিঠিতে সামাজিক মাধ্যমে সুচিকে উদ্দেশ্য করে তাকে সরব হতে আহবান জানান। শান্তিতে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি রোহিঙ্গাদের পক্ষে মুখ খোলার জন্য মিয়ানমারের নেত্রী অংসান সুচির প্রতি আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে সুচি কারাবন্দি থাকা অবস্থায় নোবেল পুরস্কার পান। নোবেল কমিটি হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিল। আজ তার দেশেই অশান্তির আগুণ, বিষয়টি ভাবতে অবাক লাগে!

সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির: অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।