ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ঈদ-উৎসবের একাল-সেকাল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৭
ঈদ-উৎসবের একাল-সেকাল ঈদ-উৎসবের একাল-সেকাল

ছোটবেলায় ঈদ ছিল অন্যরকম এক আকর্ষণ। ঈদকে কেন্দ্র করে সবার মধ্যে উৎসব ও আমেজের ভাব বিরাজ করতো। ছোটবেলায় আমার গ্রামের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় ঈদ উদযাপন করা হতো। বাড়িতে ছোটদের সবাই দল বেঁধে রমজান মাসের শেষের দিকে এসে ঈদের অপেক্ষায় থাকতাম। এর অবশ্য অন্য একটা বড় কারণ ছিল ঈদকে কেন্দ্র করে বড়দের থেকে নতুন কাপড়চোপড়সহ নানা উপহার সামগ্রী পাওয়া যেতো। আর ভালো খাওয়া দাওয়ার নানা আয়োজন চলত। আমাদের বড় পরিবার। তাই ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে নিয়ে ঈদকেন্দ্রিক নানা আয়োজন হতো। এর মধ্যে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোসহ আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার অন্যরকম মজা ছিল।

এ-মজা আজকাল যেন অনেকটা কমে গেছে। কারণ বর্তমান সময়ে ঈদের জামাত আদায় করার পর কোলাকুলি পর্ব শেষে খাওয়া দাওয়া করে অনেককেই টেলিভিশনের হরেক রকমের অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই দেখা যায়।

নানা ব্যস্ততায় এখন আর আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া খুব একটা হয়ে ওঠে না। তবে তরুণদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর প্রচলন এখনও আছে।  

রমজান মাসে রোজা শেষে ঈদ হলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য উপহার। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবদেশে বাৎসরিক নানা উৎসব হতো। মহানবী (সা:) ইসলামী শাসন কায়েম করার পর মুসলমানরা বাৎসরিক দু’টি ঈদের উৎসব করে থাকেন।

আমাদের দেশে অনেক ঈমানদার মুসলমান আছেন যারা রমজান মাস ও ঈদকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে সুন্দর পরিকল্পনা করেছেন। রমজানের পূর্বে পুরো মাসের বাজার থেকে শুরু করে এমনকি ঈদের বাজারও শেষ করেছেন। তাঁদের একটি লক্ষ্য, যাতে রমজান মাসের পুরোটা সময় এবাদত বন্দেগি করে সুন্দরভাবে কাটাতে পারেন।

বদর যুদ্ধের পর মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ঈদুল ফিতর উৎসব পালিত হয়। ইবনু ইসহাক বলেন, রমাজানের শেষে বা শাওয়াল মাসে রাসূল (সা:) বদর যুদ্ধ (ইবনু হিশাম ২/৪৩) সমাপ্ত করেন। অতঃপর এ মাসেই অর্থাৎ ২য় হিজরি সনে রমাজানের সিয়াম ও যাকাতুল ফিতর ফরজ করা হয়। যাতে যাকাতের নিছাবসমূহ বর্ণিত হয় (মিরআত ৬/৩৯৯,৩)। আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশির্বাদ হিসেবে দেখা দেয়। এ বছর ১ শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিতরের উৎসব পালিত হয়, যা মুসলমানদের নিকটে সত্যিকার বিজয়োৎসবে পরিণত হয় (আর-রাহীক্ব ২৩১-৩২ পৃঃ)।

ঈদ হল সেই দিন পালনের নাম, যা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। ঈদ মানে ফিরে আসা। যেহেতু খুশির বার্তা নিয়ে ঈদ প্রতিবছর ফিরে আসে এবং মানুষ তা পালন করে। তাই তাকে ঈদ বলা হয়। মুসলমানদের ঈদ হয় কোন দ্বীনী উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। মহান আল্লাহর ইবাদত পরিপূর্ণ করে এবং তাঁর রাসূল (সা:) এর বিধিবদ্ধ শরিয়ত অনুযায়ী তাঁকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে তা পালন করা হয়।

সহজ ভাষায় ঈদের অর্থ হচ্ছে নতুনকে পাওয়া, দিনটি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটিয়ে দেওয়া। যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ-দুর্দশা। প্রাণ খুলে আমরা শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অন্বেষণে ঈদ উদযাপন করতে পারি। ঈদের দিন মানুষে মানুষে মিলনের অঙ্গীকার। কিন্তু বর্তমান সমাজের বাস্তবতায় এই অঙ্গীকার যেন আগের মতো থাকছে না। ধনী-গরিবের বৈষম্য এতো বেড়ে গেছে যে, ঈদের দিনের মিলনটা একটা প্রথাগত মিলনে পরিণত হতে যাচ্ছে।

ঈদের দিনে আত্মীয়তার একটি বন্ধন নির্মিত হয়। এ আত্মীয়তা হচ্ছে কাছের ও দূরের সকলের সাথে আত্মীয়তা। আমরা ঈদের দিনে সমাজের নানাবিধ বৈষম্য থাকা সত্বেও একে অন্যের কাছে আসি। কর্মক্ষেত্রে মিলনের মধ্যে অনেক সময় স্বার্থের সম্পর্ক বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ঈদের দিনের মিলনে একটি সুন্দর অভিব্যক্তি আছে। এই মিলনে স্বার্থের সম্পর্ক নেই, আছে কেবল ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার তাগিদ।  

ঈদে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বেশ গতি সঞ্চার হয়। গ্রামীণ অর্থনীতি মূলত উৎসব এবং মৌসুমকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়। ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছরই দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায়। দেশে থাকা আত্মীয় স্বজনের অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। ব্যাংকিং চ্যানেল ও হুন্ডির মাধ্যমে তা দেশে এসে থাকে। রেমিট্যান্সের বড় অংশই ভোগবিলাসে ব্যয় হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে মোট রেমিট্যান্সের ৩২ শতাংশই বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে যাচ্ছে। এরপর বেশি যাচ্ছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে থাকেন। তারা তাদের কষ্টার্জিত অর্থের একটি বড় অংশ দেশে পাঠিয়ে থাকেন। এজন্য এই রেমিট্যান্স দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। গত মে মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১২৬ কোটি ডলার যা গত বছরের চেয়ে বেশী। ২০১৬ সালের মে মাসে এসেছিল ১২৪ কোটি ডলার।  

ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের তাঁতশিল্প প্রাণ ফিরে পায়। ঈদের সময় তাঁতবস্ত্র, টাঙ্গাইলের শাড়ি, লুঙ্গি, জামদানি ও বেনারসি শাড়ির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া রেশম, খাদি গামছার চাহিদাও বাড়ে। আর শহরের অভিজাত মার্কেটগুলোতে হাল আমলের দেশি-বিদেশি কাপড়ের অভাব নেই। শহরকেন্দ্রিক ঈদের বাজার একটু অন্যরকম। কেউ হয়ত নিজের ও পরিবারের চাহিদামত শপিং (কেনাকাটা) করতে পারছেন। উচ্চবিত্ত ও ধনী পরিবারের অনেকে আবার ঈদের সময়ও বেড়ানোর জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। তরুণ-তরুণীদের অনেকে শুধু ঈদের বাজার করেই ক্ষান্ত হন না; ফেইসবুকে তা পোস্ট করে নিজের আনন্দ বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করেন। আধুনিক সমাজে একালে এসব আনন্দ উচ্ছ্বাস যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সেকালে ঈদের বাজারের সময় গরিব আত্মীয়স্বজন ও কাজের লোকদের চাহিদার দিকটিতেও খেয়াল রাখা হতো। তারা নতুন কাপড় পরতো এবং আমরা যা খেতাম তাতে তাদেরও অবারিত সুযোগ ছিল। এখনও অনেক পরিবারে এ-ধারা অব্যাহত আছে। তবে বলা যায়, তা আর আগের মতো নেই।  

এদিকে ঈদকে সামনে রেখে পুঁজিবাজারের শেয়ার বিক্রির চাপও বেড়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী ঈদের জন্য শেয়ার বিক্রি করেন। এজন্য বাজারে এক ধরনের বিক্রয়-চাপ তৈরি হয়। মূলত তা ১৫ রোজার পর বেড়ে যায়। অনেকে আবার এই সুযোগে একটু কম দামে শেয়ার কেনার সুযোগ কাজে লাগান। শেয়ার বিক্রির টাকা দিয়ে ঈদের কেনাকাটা ছাড়াও যাকাত দিয়ে থাকেন। আমার পরিচিত মহলের কেউ কেউ শেয়ারবাজার থেকে এরই মধ্যে টাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। এরা অবশ্যই স্মার্ট বিনিয়োগকারী। বাজারের অবস্থা ভালো থাকতেই প্রয়োজনীয় টাকা বের করে ফেলেন।  

ঈদের সময় সারাদেশে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। ছোট ছোট খাত হলেও সব মিলিয়ে তা পরিমাণে অনেক। অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হবে লক্ষ কোটি টাকা। ঈদের মতো উৎসবকে সামনে রেখে টাকার প্রবাহ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কারণ পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিন সামগ্রী কেনাকাটা, নগদ উপহার বিনিময় ও ভ্রমণ ঈদে মওসুমেই বেশি হচ্ছে। তবে বাড়তি টাকার প্রবাহে ঈদের সময় মূল্যস্ফীতির হার ৫.৩৯ শতাংশে ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তা কিছুটা বেড়ে যাবেই।  

তবে এবার ঈদবাজারে ব্যাংকগুলোর কলমানি মার্কেটে আগ্রহ নেই। ঈদের আগে নানা কাজে নগদ টাকার প্রয়োজন হয়। ঈদের সময় চাকুরীজীবিসহ সকল ধরনের গ্রাহকেরই নতুন টাকার চাহিদা বাড়ে। এজন্য ব্যাংগুলোতে নগদ টাকার প্রয়োজন বেড়ে যায়। আর বাড়তি চাহিদার যোগান দিতে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। এ বছর বেশিরভাগ ব্যাংকেই উদ্বৃত্ত তারল্য (নগদ মুদ্রা) থাকায় অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ ধার করার প্রয়োজন পড়ছে না। ফলে কলমানি মার্কেটে (স্বল্প সময়ের জন্য আন্ত:বাংক লেনদেন) সুদের হারও স্বাভাবিক রয়েছে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে এবারের ঈদের আগে ৩০ হাজার কোটি টাকা নতুন করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো প্রভাব নেই কলমানি মার্কেটে। চাঙ্গা হওয়া দূরের কথা, উল্টো কলমানি মার্কেটে ভাটার টান পড়েছে।  

ছোটবেলার ঈদ উদযাপন সবার কাছেই অন্যরকম মজা। যদি বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘ঈদের মজা আপনার কাছে এখন কেমন?’--তবে একবাক্যে সবাই ছোটবেলার ঈদ উদযাপনের কথাই বলবেন। তখন দল বেঁধে ঈদের জামাত শেষে ঘুরে বেড়ানো, নতুন কাপড়চোপড় পরা, বড়দের কাছ থেকে নগদ টাকা পাওয়া ও বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে গিয়ে খাওয়া দাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।

ঈদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝার জন্য রমজানের তাৎপর্য অনুভব করতে হয়। রমজানের সিয়াম সাধনার পরিণতিতেই ঈদ উৎসবের আয়োজন। এ উৎসবের প্রধান অংশই হচ্ছে ঈদের জামাত ও খুতবা। ঈদের জামাতে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ একত্রিত হয় এবং পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। ঈদের জামাতের খুতবায় দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির জন্যও দোয়া করা হয়। ঈদের নামাজে আত্মার শান্তি পাওয়া যায় এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। ঈদের জামাতের সাহায্যে পরিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতা প্রকাশের চেষ্টা করা হয়। ঈদের দিনে আনন্দ উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি আমাদের এ উৎসব হোক ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণের দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক
সৈয়দ ছলিম মোহাম্মদ আব্দুল কাদির
অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad