ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মুসলিম অভিবাসীদের জন্য অশনি সংকেত

সাজেদুল চৌধুরী রুবেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১১
মুসলিম অভিবাসীদের জন্য অশনি সংকেত

আয়ারল্যান্ডের একটি টিভি চ্যানেল ‘টিভি থ্রি’। হরহামেশাই এ চ্যানেলটিতে ‘আইরিশ মুসলিম’ নামে একটি টক শো সম্প্রচার হয়ে থাকে।

এতে ইসলামের আদর্শ, গুণাবলি, মানবতাবোধ সর্বোপরি আমাদের প্রিয় রাসুল হজরত মোহম্মদের (সা) আদর্শিক জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, দশ বছর আগে রাজধানী শহর ডাবলিন ছাড়া অন্য কোনো কাউন্টিতে (জেলা) যেখানে কোনো মসজিদ ছিল না বলেই বিবেচনা করা হয়, সেখানে আজ মুসলিম অভিবাসীরা প্রতিটি কাউন্টিতে দুই বা তিনটি কিংবা আরো বেশি মসজিদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামের আদর্শ ও ঐতিহ্যের যে প্রসার ও প্রচার ঘটাচ্ছেন, তাও মিডিয়াটি এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরে সুনিপুণভাবে।

একটি ভিন্নধর্মী দেশের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জন্য নিঃসন্দেহে এটি যথেষ্ট উদার, সাহসী ও প্রশংসনীয় কাজ। এ অনুষ্ঠান প্রচারের ফলে মুসলিম সমাজব্যবস্থার যে আদর্শ ও রূপরেখা, তা কিছুটা হলেও অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর রেখাপাত করছে। আমার এক আইরিশ ক্রিশ্চিয়ান কলিগের কথা থেকে তা সহজেই অনুমেয়।

সম্প্রতি প্রচারিত টক শোটি দেখার সুযোগ হয় তার এবং অনুভূতির কথা জানায় আমাকে। বিশেষ করে রমজান মাসে আমরা অনাহারে থেকে যে সিয়াম সাধনা করি তা নাকি তাকে খুব আকৃষ্ট ও অবাক করেছে। তার কথার রেশ ধরে তাকি আমি রমজানের আরো বিভিন্ন ফজিলত ও ইসলামের আদর্শিক গুণাবলি বিশ্লেষণ করে বুঝাতে চাইলে সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমাদের ইসলাম ত্যাগ-তিতিক্ষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার বিধান করে, তবে কেন তোমাদের আল-কায়েদা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে?

সহাস্য প্রতিবাদে তাকে বললাম, তোমার ধারণা মোটেই সঠিক নয়। যারা আল-কায়েদা, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তাদের ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। এরা এক ধরনের বিকৃত মন-মানসিকতাসম্পন্ন কট্টরপন্থি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী মাত্র, যারা প্রতিটি ধর্মের ভেতরেই ওত পেতে আছে। তাছাড়া একচেটিয়াভাবে আল-কায়েদাকে দোষ দিয়েই বা লাভ কী? বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখো, সম্প্রতি অসলোর সহিংসতা, ব্রিটেনের দাঙ্গাসহ আরো অনেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে যেগুলোতে আল-কায়েদা বা কোনো ইসলামী মৌলবাদীর সম্পৃক্ততা নেই। তোমরা শুধু ‘আল-কায়েদা’ ‘আল-কায়েদা’ বলে গলা ফাটাও অথচ একবারো আল-কায়েদার জন্ম-ইতিহাস জানতে চেষ্টা করো না। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই, নিকট অতীতে বুশ ও ব্লেয়ার প্রশাসন সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন তা যেন কেবলই ছিল আল-কায়েদা ও মুসলিম দমননীতি।

সম্প্রতি ব্রিটেনের ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি আমাকে হতবাক করেছে। আমি এতদিন কেবল বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো নিয়েই ভাবতাম। কিন্তু আজ এককালের বিশ্ব শাসনকারী দেশ ব্রিটেনেও দেখা গেল দাঙ্গাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ব্যাংকের ক্যাশ মেশিন ভাঙাসহ লুটপাটের করুণ  চিত্র। দাউ দাউ করে পুড়ে বিধ্বস্ত হলো দোকান-পাট, গাড়ি, বাড়িসহ অনেক সহায়-সম্পত্তি। লন্ডনসহ অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল এ দাঙ্গা। টানা দু-তিন দিন পুলিশের সঙ্গে টিএন এজ দাঙ্গাবাজদের চলেছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার খেলা। স্কাই নিউজে টিভি ফুটেজে যখন এসব চিত্র দেখছিলাম তখন আমার চোখের সামনেই ভেসে উঠছিলো বাংলাদেশেরই হরতাল-বিক্ষোভের করুণ চিত্র। বাংলাদেশে পুলিশের সাথে হাতাহতি, ধস্তাধস্তি, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সহিংসতা ডালভাত হলেও ব্রিটেনের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে এসব চিত্র এর আগে কখনো দেখা যায়নি। কোনো ব্যক্তিকে রাস্তায় থামিয়ে দেহ তল্লাশি করা কিংবা ঊনত্রিশ বছরের মার্ক ডুগান নামের যুবক পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়াই কি এ ঘটনা সূত্রপাতের একমাত্র কারণ? নাকি এর পেছনে আরো অনেক গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে? অনেক বিজ্ঞজনের মতে, অভিবাসীদের সাথে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণই নাকি  এমন ঘটনার জন্য দায়ী।

সত্যিকার অর্থে বিশ্বে এসব কী ঘটছে! কিছুদিন আগে এন্ডারসন ব্রেইভিক নামের বত্রিশ বছরের এক মুসলিম-বিদ্বেষী চরম ডানপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী যুবক নরওয়ের রাজধানী অসলোতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশে ও উতোয়া দ্বীপের একটি ইয়ুথ ক্যাম্পে জোড়া হামলা চালিয়ে সহিংস ঘটনার মাধ্যমে অনেক নিরীহ লোককে হত্যা করে। এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে সে বলে, মুসলিম অভিবাসীর ভারে নুয়ে পড়া ইউরোপকে মুসলিম উপনিবেশ থেকে বাঁচানোর জন্যই তার এ কাজ। নিজ কৃতকর্মের জন্য বিন্দু পরিমাণ অনুতপ্ত না হয়ে বরং সে ব্যাখ্যা দিলো এভাবে : ‘আমার হামলাগুলো ছিলো ভয়ঙ্কর কিন্তু দরকারি’।

অর্থাৎ যারা সাধারণ নিরীহ মানুষ, যাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা বর্ণবৈষম্যবোধ নেই, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে কাজ করতে যাদের কোনো বিরোধ বা সমস্যা হয় না, তাদের ওই চরম কট্টরপন্থি ব্রেইভেক আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইল যে, আল-কায়েদার প্রতি বিশ্ব নেতৃত্ব যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তোমাদেরও উচিত একই কায়দায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম অভিবাসীদের উচ্ছেদ করার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া।

আল-কায়েদার প্রতি আমার কোনো দরদ বা সহনশীলতা নেই। কিন্তু কেউ যখন আল-কায়েদার নাম করে মুসলিম অভিবাসীদের হেয় প্রতিপন্ন করতে চায় তখনই বড্ড দুঃখ হয়। কেন আজ বিশ্বে অভিবাসীদের প্রতি বা তাদের কেন্দ্র করে এ নির্মমতা? আল-কায়েদা, তালেবান গোষ্ঠী ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু উচ্চাভিলাষী ধনাঢ্য লম্পট (যারা মুসলিম নামের কলঙ্ক) ছাড়া বিশ্বের সিংহভাগ মুসলিমই ধর্মপরায়ণ, সৎ ও সাধাসিধে মানুষ। তাছাড়া মুসলিম অভিবাসীরা তো কারো বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছে না। তারা প্রতিভা, যোগ্যতা ও শারীরিক শ্রম দিয়ে যে দেশে বাস করে মূলত সে দেশকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসলাম কারো জন্য কখনো কোনো অকল্যাণ বয়ে আনে না। তাই সেদিন হোয়াইট হাউসে এক ইফতার পার্টিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দেশ ও সমাজ গঠনে মুসলিমদের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়ে ইসলামকে ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্র“তিবদ্ধ এক মহান ধর্ম বলে অভিহিত করেন। পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার্থে তিনি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আরো বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার তাগাদা অনুভব করেছেন।

আবার কিছুদিন আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ব্রিটেনে মুসলিম কমিউনিটি ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য যে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড দান ও সংগ্রহ করে থাকেন, তাতে তার গর্ববোধ হয়।

বারাক ওবামা ও ডেভিড ক্যামেরন দুজনকেই অভিবাদন। ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে তাদের যে ইতিবাচক মনোভাব, তা যদি তারা সত্যি সত্যি মন থেকে করে থাকেন তবে তাদের অনুরোধ করে বলতে চাই, বিশ্বসন্ত্রাস নির্মূল করে ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙা করার মাধ্যমে আবারো যদি বিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হয় তবে একচোখা নীতি পরিহার করে শুধু আল-কায়েদার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ নয়, বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্র ডানপন্থি ও নব্য নাৎসিবাদী যেসব সংগঠনের জন্ম হয়েছে সেগুলোর ওপরও কড়া নজরধারীর মাধ্যমে যুদ্ধ ঘোষণা করুন।

লেখক : আয়ারল্যান্ড প্রবাসী
[email protected]

বাংলাদেশ সময় ২২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বও ৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।