ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

বাংলা ভাষা ও বর্তমান প্রজন্ম | আদনান সৈয়দ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
বাংলা ভাষা ও বর্তমান প্রজন্ম | আদনান সৈয়দ বাংলা ভাষা

ভাষার মাসে ভাষা নিয়ে আলোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। ফেব্রুয়ারিতে প্রত্যাশিত শীতের পরিবর্তে চারদিকে যখন উষ্ণতার ছড়াছড়ি তখন নিউইয়র্ক সাহিত্য একাডেমির আসরে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ জমিয়ে এক আলোচনা হয়ে গেলো। কেমন আছে আমার স্বরবর্ণ? কেমন আছে আমার ব্যাঞ্জন বর্ণমালা? না, তারা খুব একটা ভালো নেই। 

বাংলাদেশ বলুন আর কলকাতা, অথবা নিউইয়র্ক- বাংলা ভাষা এখন সত্যিকার অর্থেই হুমকির সম্মুখীন। কেউ কেউ ভাষাকে বিকৃতি করছে, কেউ ভাষায় আরবি, ফারসি লাগিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় পরিণত করছে আবার কেউ কেউ বাংলা শব্দের সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে বাংরেজি তৈরি করে ফেলেছে।

বিষয়টা আমাদের জন্যে মোটেও সুখকর কোনো সংবাদ নয়। এই বিষয়কে নিয়েই একটি আলোচনা জমে উঠেছিল সাহিত্য একাডেমির আসরে। সেই আলোচনায় অন্যদের মধ্যে ছিলেন ঠিকানার প্রধান সম্পাদক ফজলুর রহমান, কবি ফকির ইলিয়াস, কথা সাহিত্যিক ফেরদৌস সাজেদিন, নীরা কাদরী, লেখক মনিজা রহমান ও এই প্রতিবেদনের লেখক।

সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রধান সম্পাদক ফজলুর রহমান বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থাকে ‘খিচুড়ি’ ভাষার সঙ্গে তুলনা করেন। তার কথায় অবশ্যই যুক্তি রয়েছে। আমি নিজেও তা সমর্থন করি। যে ভাষার জন্যে এতো রক্ত ক্ষয় সেই ভাষা এমন খিচুড়ি ভাষায় রূপ নেবে তা ভাবা যায় না। বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা এখন রীতিমত কঠিন আর দুঃসাধ্য এক বিষয়। সেই সঙ্গে রয়েছে মিডিয়া ডাকাতদের ভাষা নিয়ে নানা রকম ষড়যন্ত্র।  

রেডিওতে বাংলাকে এমনভাবে উচ্চারণ করে মনে হয়, মুখে বুঝি গোটা আস্ত একটা মারবেল পুরে বসে রয়েছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বিকৃত উচ্চারণে এভাবে বাংলা উচ্চারণ এখন যেনো ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হায়! এর জন্যেই কি সালাম, বরকত, জব্বাররা রক্ত দিয়েছিলেন? বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে আরও ভয়বাহ এক ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত দিলেন কবি ফকির ইলিয়াস।  

বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী খুব সুচতুরভাবে জোরপূর্বক বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি ফার্সি ভাষা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে সমস্যা আরেকটি শুরু হয়েছে। ইদানিং কেউ কেউ মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন। সেদিকে ইঙ্গিত দিলেন লেখক মনিজা রহমান। তিনি প্রমথ চৌধুরীর উক্তি দিয়ে প্রমিত ও চলিত রীতির একটি ব্যাখা দেন। তবে কেন জানি প্রমথ চৌধুরীর যুক্তির সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। যে ভাষায় কথা বলি সেই ভাষায় সাহিত্য কীভাবে সম্ভব? চরিত্রের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হতেই পারে কিন্তু সাহিত্যের শিল্পিত রূপ নির্মাণে সেটি কতোটুকু কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে সেটাই হলো কথা। মুখের ভাষা কি সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব? 

একদিন এই প্রশ্নটি রেখেছিলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত কবি শহীদ কাদরীকে। শহীদ কাদরী কথাটা শুনে প্রথমে তার মুখটা বিকৃত করলেন, তারপর তার স্বভাবসুলভ নিজস্ব ঢংয়ে এর উত্তর দিলেন। ‘কও কি মিয়া, ঘরে বউয়ের সাথে যেই ভাষায় কথা কই ওই একই ভাষায় উত্তর আধুনিক কবিতার উপর প্রবন্ধ লিখতে কও নাকি?’ 

তবে নীরা কাদরী ভাষার বিষয়ে জানালেন, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা নিয়ে ভালো কাজ হচ্ছে।  

তিনি মনে করেন, বিভিন্নরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভাষা নিজেই একটি শক্ত জায়গা নিয়ে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।

বেশ কদিন আগে ঢাকায় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বন্ধুটির সঙ্গে আড্ডার এক ফাঁকে দূর থেকে লক্ষ্য করছিলাম, একটি পাঁচ-ছয় বছর বয়সী শিশু আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ইশারায় কাছে ডাকতেই শিশুটি ধীরে ধীরে আমার কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো, ‘আংকেল, হাউ ইজ আমেরিকা’। কী অবাক কাণ্ড? বাঙালি রক্তের একটি শিশু আমার সঙ্গে কথা বলছে ইংরেজিতে? আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বন্ধুটিকে বললাম, ‘কিরে দোস্ত, তোর ছেলে কি বাংলায় কথা বলতে পারে না’? এ ধরনের কথা শুনে বন্ধুটি প্রথমে তার ভ্রু কুঁচকালো তারপর যথাসম্ভব মুখে একটি গর্বের হাসি ফুটিয়ে ধীরে ধীরে বললো, ‘দোস্ত, ছেলেটা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ার কারণে বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই বেশ ভালো কথা বলতে পারে। জানিসতো, ইংরেজিটা জানা থাকলে এর কদরই কিন্তু আলাদা’। বন্ধুটি আপন খেয়ালে তার কথা বলেই চলেছে। আমাদের দু’বন্ধুর আলোচনার কোনো এক ফাঁকে ধীরে ধীরে যোগ দিলেন বন্ধুটির স্ত্রী। ‘ভাই জানেনতো, আমাদের কমল (নামটা কাল্পনিক) ইংরেজির পাশাপাশি দুর্দান্ত হিন্দিও কিন্তু বলতে পারে’। বন্ধুটির স্ত্রী ততোক্ষণে তার একমাত্র পুত্রের ভাষাজ্ঞানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর আমি তখন ভাবছিলাম অন্যকথা।  

বন্ধুপুত্রের জন্যে একুশের বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে আসা বাংলা ভাষায় লিখিত বিভিন্ন রঙ-বেরঙের বইয়ের প্যাকেটটি যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করলাম। আর সেই সঙ্গে ভাবতে লাগলাম, যে বাংলা ভাষার আদি নিবাস খোদ বাংলাদেশে, সেখানেও ভাষাটি কী ভয়াবহ আর মারাত্মক রকমভাবেই না ইংরেজি আর হিন্দির আগ্রাসনের শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে।  

এই তো সেদিন বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইয়ের দোকানে এক অনুষ্ঠানে খুব আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে দিলেন, ‘বাংলা ভাষা যদি টিকে থাকে তাহলে তা বাংলাদেশেই টিকে থাকবে’।  

সেদিন কথাটা শুনে সত্যি মনটা খুব ভালো হয়ে গিয়েছিল। আর এমন সুন্দর কথা শুনলে কার না ভালো লাগে? ‘বাংলাদেশেই টিকে থাকবে’ কথাটার ভেতর কোথায় যেনো একটা অধিকারের ঘ্রাণ খুঁজে পেলাম। তাইতো, ৫২ সালে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে এই বাংলাকে উদ্ধার করেছিলাম আমরাই? নাকি? সেদিন ঢাকার রাজপথ রফিক, সালাম, জব্বারের মতো আরও অনেকের রক্তে একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল আর সেই রক্তবীজ থেকে জন্ম নিয়েছিল বাংলা নামে একটি ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার। সেই অর্জিত প্রাণের ভাষাটি তার চারপাশে ডালপালা ছড়িয়ে আপন মনে আনন্দের সঙ্গে নাচতে নাচতে বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চিতে আজীবন ছোট্ট কিশোরীর মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে এইতো স্বাভাবিক। এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।

আঠারো দশকের আমেরিকার কবি রাফ ওয়ালডো এমারসন বলেছিলেন, ‘Language is a city to the building of which every human being brought a stone’। খুবই সত্য কথা। যে জাতি মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্যে রক্ত দিতে পারে, বাংলাদেশ নামে একটি দেশের জন্ম দিতে পারে, সেই জাতি নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে বাধ্য।  

আচ্ছা আমরা সবাই মিলে কি প্রতিদিন একটি একটি বাংলা শব্দ কাঁধে বয়ে আমাদের ঘরে নিয়ে আসতে পারি না? বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির যথাযথ লালন আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারি না?

বাংলা ভাষার জয় হোক। ভাষার মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে তাতে কী, সাহিত্য একাডেমিতে বাংলা ভাষা নিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত ঘটাবার জন্যে কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাই। সেদিনের উপস্থাপনায় সাহিত্য একাডেমির পরিচালক মোশারফ হোসেন ছিলেন খুবই প্রাণবন্ত। তাকে ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।