ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

বহুমাত্রিক আপসহীন স্পষ্টবাদী

সুকান্ত পার্থিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১১
বহুমাত্রিক আপসহীন স্পষ্টবাদী

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাঁর অবাধ পদাচারণায় নতুন ধারায় শিল্পমন্ডিত হয়েছে তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চার অকুতোভয় পথপ্রদর্শক, আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল হুমায়ুন আজাদ। তিনি একাধারে বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, সমলোচক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার ।

তাঁর বিপুল রচনা সুসমৃদ্ধ করেছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে যখন এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তির অপেক্ষায়, ঠিক তার আগমুহূর্তে ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে।

বেড়ে ওঠার সাথে সাথে যখন সত্যকে বাস্তবতার আয়নায় উপলব্ধি করতে শিখলেন তখন থেকেই  তিনি বর্জন শুরু করলেন এই তথাকথিত সমাজব্যবস্থার হাজার বছর ধরে ব্যাপকভাবে মহামারী আকারে  প্রচলিত চিরাচরিত সব প্রথা ও বিশ্বাসের ভিত্তিকে। জীবন, জগৎ ও মানুষকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন স্বাধীনচেতা ও মানবতাবাদী হিশেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে নিজের মধ্যে জন্ম দিয়েছিলেন প্রগতিমুখী মুক্ত চিন্তাধারার দর্শনের । আজীবন জ্ঞানসমুদ্রে জ্ঞান অন্বেষণের মহৎ সাধনায় নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে ছাত্র-যুবসমাজের মাঝে অকুন্ঠিত বোধে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের দর্শন ও চেতনাকে। সত্যকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করে স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন। রাষ্ট্র ও সমাজ পরিবর্তনের দৃঢ় চেতনায় কলমকে মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে কখনো নির্দ্বিধায় পত্রিকায় লিখে গেছেন নিবন্ধ, কখনো কবিতার মাঝে প্রকাশ করেছেন মানবজীবনের উদ্ভাসিত আবেগ-অনুভূতি-প্রয়াস, কখনো জ্বলে উঠেছেন তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ রচনায়, কখনো মুখর হয়েছেন গঠনমূলক সমলোচনায়। যাঁর অশেষ অনুপ্রেরণায় শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন তিনি হলেন তাঁর পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক, বাংলা ভাষা-সাহিত্যের জ্ঞানতাপস, প্রগতিশীল লেখক আহমদ শরীফ।

হুমায়ুন আজাদ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়, নারীকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্যে ব্যাপক গবেষণার ফসল হিসেবে রচনা করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী গ্রন্থ ‘নারী’।

মৌলবাদী, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তাঁকে চিরতরে সরিয়ে দেবার জন্য ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণের বাইরে চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তাঁর দেহকে, অল্পের জন্যে ফিরে এসেছিলেন মৃত্যু থেকে। তাঁর উপর আঘাতের প্রতিবাদে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ ও সমগ্র বাঙালি জাতি। মৌলবাদী, ধর্মান্ধরা তাঁকে বাঁচতে দিতে চায়নি ভিন্নধর্মী ও বাস্তব অনুসন্ধানী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উপন্যাস ‘পাক সার জামিন সাদ বাদ’ গ্রন্থ রচনার কারণে। সেখানে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীলদের ধর্মের ক্যানভাসে অন্যায়-অনাচার-ধর্ষণ-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ এবং বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাস্তব চিত্র ।

দূরদর্শী মনীষা ও বাস্তববাদী দর্শনের আলোকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আসলে এই বাঙালি জাতির গন্তব্য কোথায়? তাই গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন, চেতনাহীন ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করতে কলমের অমিত শক্তি দিয়ে মানুষের মগজে মুত্যু পয়ৃন্ত করে গেছেন প্রচণ্ড আঘাতের পর আঘাত।

নিজের সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে বিচিত্র রকমভাবে সাজিয়ে ছিলেন জীবনকে। সবসময় ছিলেন বিজ্ঞানবাদী, যুক্তিবাদী, প্রথাবিরোধী, যাঁর প্রদর্শিত পথে হাঁটতে পারে চেতনাশীল ও সত্যানুসন্ধানী প্রকৃত শিক্ষাভিমুখী তরুণ প্রজন্ম। চারপাশের অস্থিতিশীল, বর্বর, হতাশাগ্রস্ত পরিবেশে বসবাস করেও সবার মধ্যে ও নিজের ভেতরে আশার প্রদীপ  জ্বালানোর সংকল্পে  অটুট ছিলেন সবসময়। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাদমুখী সমাজ-রাষ্ট্রের বদ্ধ শিকল থেকে মানুষকে মুক্তবুদ্ধির জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন করতে তাঁর রচিত যে গ্রন্থগুলো বাস্তবতার আলোকে নতুন কালের সন্ধান দেবে এর মধ্যে অন্যতম  আমার অবিশ্বাস, মহাবিশ্ব, সব কিছু নষ্টদের অধিকার যাবে, সীমাবদ্ধতার সূত্র, আমাদের শহরে একদল দেবদূত, ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল, রাজনীতিবিদগণ, সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে, আব্বুকে মনে পড়ে, শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম ?, প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে, হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ, শ্রেষ্ঠ কবিতা, আততায়ীদের সাথে কথোপকথন, সাক্ষাৎকার, আমার নতুন জন্ম, একুশ আমাদের অঘোষিত স্বাধীনতা দিবস (শেষের দুটি গ্রন্থ মৃত্যুর পর প্রকাশিত) ।

বুকভরা আঘাত-যন্ত্রণা সহ্য করার পরেও শুধু মানুষকে আলোকিত নতুন দিগন্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বেঁচে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন, তবু তাঁকে চিরবিদায় হতে হয়েছে জীবন থেকে। একুশে বইমেলায় হামলার প্রায় ছয় মাস পর ৭ আগস্ট, ২০০৪ তথাকথিত গণতন্ত্রের রূপধারী সরকারের ষড়যন্ত্রে তাঁকে পেন-এর আমন্ত্রণে পাঠানো হয়েছিল জার্মানির মিউনিখ শহরে কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর বৃত্তিমূলক গবেষণায়। পাঁচ দিন পর, ১২ আগস্ট, ২০০৪ (বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী) হিটলারের দেশে তাঁকে চিরতরে বিদায় নিতে হলো আকস্মিকভাবে। জার্মানির মিউনিখস্থ ফ্লাটের নিজ শয়নকক্ষেই তাঁকে পাওয়া গেয়েছিল মৃত অবস্থায়। এখনো তাঁর আকস্মিক মৃত্যু প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে মুক্তচেতনার মানুষদের! ঘোরতর সন্দেহ জাগে তাঁর মৃত্যু ঐ কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের উপসংহার কি না?

বাতাসের প্রকোপে প্রদীপ নেভার আগে শেষবারের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে; মনে হয় সেই আগুনে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে চারপাশ। দেশমাতৃকার প্রতি অশেষ ভালবাসা-শ্রদ্ধায় হুমায়ুন আজাদও জ্বলে উঠতে চেয়েছিলেন পুনরায় সত্য প্রকাশে অটল থেকে অন্ধকারের কালো হাতগুলোকে চিরতরে গুঁড়িয়ে দিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে জ্ঞানচর্চার জন্যে বাংলাদেশের দম আটকানো, ত্রাসগ্রস্ত, বিপদগ্রস্ত পরিবেশ থেকে সরে এসে শেষবারের মতো হলেও জ্বলার পরম আকাঙ্ক্ষা হয়ত তাঁর মনে ছিল। তাই হয়ত বৃত্তি দিয়ে তাঁকে জার্মানিতে পাঠানো ষড়যন্ত্র মনে না হয়ে তাঁর উপলব্ধিবোধে জীবন-আশ্রয়ের শেষ স্থল হিশেবেই জেগেছিল।

কিন্তু এখনো তাঁর ওপর সেই হামলার সঠিক বিচার শেষ হয়নি। যেসব ধর্মীয় ভণ্ড, যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেকে হুমায়ুন আজাদকে বহুবার বিভিন্ন সভা-জলসায় ‘মুরতাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে, এমনকি তাঁর উপর বর্বরোচিত হামলার পর জাতীয় সংসদে পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে হামলাকে সাধুবাদ জানিয়েছে, সেসবের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কেন থেমে আছে ওদের অন্যায়ের বিচার? ওদের সঠিকভাবে জ্ঞিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেরিয়ে পড়বে থলের বিড়াল! কারণ, এটা স্পষ্ট যে, শর্ষের ভেতরেই ভূতকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে!

একটি স্বাধীন দেশে প্রত্যেক নাগরিক অন্যায়ের সঠিক বিচার পাবার অধিকার রাখে! তাহলে কেনই বা হুমায়ুন আজাদের মতো বাঙালি জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানের ওপর ঘৃণ্য, পাশবিক হামলার আক্রমণকারীদের শাস্তি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ?

বিভিন্ন সময় হত্যার হুমকির সম্মুখীন হয়েও জীবনকালে আপসহীনভাবে সত্য ও স্পষ্ট কথা বলতে কখনো পিছপা হননি হুমায়ুন আজাদ। তাই সত্য যতদিন বেঁচে থাকবে পৃথিবীর বুকে, ততদিন সত্যের মাঝেই মুক্তচেতনার মানসলোকে বেঁচে থাকবেন বঙ্গজননীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান হুমায়ুন আজাদ।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

বাংলাদেশ সময় ১৩৫০ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।