ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

করোনা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ৩, ২০২০
করোনা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয় করোনাজয়ী ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন

বরিশাল: করোনা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়। ভয় নয়, সাহসিকতা আর সচেতনতার সাথে করোনাকে পরাজিত করা সম্ভব। এমনই দাবি চিকিৎসকদের। যার সাথে রয়েছে হাজারো যুক্তি। তা না হলে আক্রান্তরাও কিভাবে সুস্থ হচ্ছেন?

সম্প্রতি বরিশালে সুস্থ হয়ে ওঠা একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যদিও তিনি দ্বিতীয় বারের মতো আবারো করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

তবে নিয়ম মেনে চললে সুস্থ হওয়া সম্ভব যেমন দাবি তার, তেমনি এবারেও সুস্থ হয়ে আবার মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন তিনি। সেসাথে বাবা-মায়ের অনুপ্রেরনায় মানুষের সেবা করার মধ্য দিয়েই তার রঙিন স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজটিও চালিয়ে যাবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম দফায় সুস্থ হওয়া নিয়ে তার পোস্টটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

‘অনেকেই জানতে চেয়েছেন কিভাবে হল, কি কি করেছি, কেমন আছি।  

করোনা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়। ভয় নয়, সাহসিকতা আর সচেতনতার সাথে করোনাকে পরাজিত করা সম্ভব। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

আমি ডা. মুহাম্মাদ শিহাব উদ্দিন, মেডিকেল অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বাবুগঞ্জ, বরিশাল।  

গত ১৩ এপ্রিল হসপিটালে ইমার্জেন্সি ইভনিং ডিউটিরত অবস্থায় জানতে পারি হসপিটালের ১ জন নার্স, ১ জন পিওন এবং আরো ভয়ের ব্যাপার ছিল যে একজন রোগী যেকিনা করোনার উপসর্গ নয় বরং মারামারি করে জেনারেল ওয়ার্ডে ভর্তি, তাদের কোভিড-১৯ রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। বুঝতে বাকি ছিলনা যে অলরেডি ঘটনা কতটা খারাপ হয়ে গেছে। হঠাৎ এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত খবরে পুরো হসপিটাল যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমারও মাথায় কাজ করছিল না। কিন্তু কছুই করার ছিল না, তখনও ইমার্জেন্সি রোগী রিসিভ করছিলাম। UHFPO স্যারকে ধন্যবাদ যে তিনি দ্রততম সময়ের মধ্যে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে হসপিটাল লকডাউন ঘোষণা করেন।  

পরবর্তীতে মাথা ঠাণ্ডা করে প্লান করলাম কিভাবে নিজেকে আর নিজের ফ্যামিলিকে রক্ষা করা যায়। আমার বাসায় মা বাবা ভাইয়া ভাবি থাকেন, তাদের নিয়েই বেশি চিন্তা হচ্ছিল। আমার যেহেতু এখনো টেস্ট হয়নি তাই নিশ্চিত নই যে আমার শরীরে করোনা আছে কি নেই। যদি থেকে থাকে তাহলে হয়তো অলরেডি তাদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে আর যদি নাও ছড়ায় বাসায় সবার সাথে থাকলে ছড়াবে। তাই ঠিক করলাম বাসায় থাকব না। কিন্তু থাকব কোথায়? ভাইয়াকে ফোনে সব বলার পর বুঝতে পারে এবং রাতের মধ্যেই আমার জন্য উপরের ফ্লোরে হাফ কমপ্লিট একটা ফ্ল্যাট এ কোনোমতে থাকার একটা ব্যবস্থা করে।

যদিও তখনও পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই যে, আমার করোনা পজিটিভ। তবুও পরের দিন সকালে যথাযথ প্রটেকশন নিয়ে আমি বাসায় ফিরি যাতে আমার থাকলেও ফেরার পথে অন্য কারোর মধ্যে না ছড়ায়। প্রথমে গ্যারেজে বসেই সাবান দিয়ে গোসল করি, কাপড়গুলো পলিথিন ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিই। আগে থেকেই পুরো সিড়িতে ব্লিচিং পাউডার গোলানো পানি দিয়ে ধুয়ে রাখতে বলি। তারপর সরাসরি চলে যাই আমার জন্য রেডি করে রাখা উপরের ফ্লোরের সেই রুমে। শুরু হয়ে গেল আমার হোম আইসোলেশন।

নিজের শরীরকে ঠিক রাখার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিলাম এবং বাসার সবাইকেও বললাম, যেমন- প্রতিদিন ১টা করে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট, ২টা ভিটামিন-সি ট্যাবলেট আর বেশি পরিমাণে ফল ও পানি খাওয়া। গরম পানি আর আদা চা খেতাম বেশি এবং গরম পানি দিয়ে অন্তত ৩ বার কুলকুচি করা। প্রতিদিন ২ বেলা ব্যায়াম করা। জ্বর, কাশি আর ডায়রিয়া ছিল, তার জন্য কিছু মেডিসিন খাওয়া। প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করা। আর প্রতিদিনের কাপড় প্রতিদিন ধুয়ে ফেলা। রুটিন মেনে ঘুমানো, খাওয়া ও নামায পড়া।

খাবার আমার রুমের দরজার বাইরে রেখে যেত আমি নিয়ে খেতাম, আর আমার কাছে যে জিনিসপত্র পাঠানো হতো তার কোনোটাই বাসায় ফেরত দিতাম না যাতে কোনোভাবেই সংক্রমণের সম্ভাবনা না থাকে।

১৬ তারিখ জানতে পারি হসপিটালের আরো তিন জন স্টাফ ও ২ জন রোগীর কোভিড পজিটিভ এসেছে। কিছু জটিলতার কারণে দেরি হলেও পরবর্তীতে স্যারদের সহযোগিতায় ১৮ এপ্রিল আমার বাসায় এসে স্যাম্পল নিয়ে যায়। ২০ তারিখ আমি জানতে পারি আমার কোভিড-১৯ পজিটিভ। পজিটিভ রিপোর্ট-এর জন্য যদিও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম, তবু্ও আসলেই পজিটিভ শোনার পর কিছু সময়ের জন্য নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। যাই হোক নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে এরপর কি করা উচিৎ তাই ভাবছিলাম।  

আলাদা রুম হলেও বাসায় থাকাটা পরিবার এর জন্য রিস্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে ভেবে ২৩ তারিখ সকালে শের-ই-বাংলা মেডিকেলের আইসোলেশন-এ চলে যাই। বাসায় যে পদক্ষেপ নিয়েছিলাম সেভাবেই হসপিটালেও নিলাম।

মহান আল্লাহ তায়ালার রহমতে এবং সকলের দোয়ায় খুব দ্রুতই আমার ফলোআপ রিপোর্ট নেগেটিভ আসে এবং আমি ২৭ তারিখ হসপিটাল থেকে বাসায় চলে আসি। বাসার সবার রিপোর্টও নেগেটিভ আসে। যেহেতু হসপিটালে অন্যান্য করোনা রোগীদের সাথে থেকে এসেছি তাই বাসায় ফিরে আবারও ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে আছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া যে, তিনি শারীরিক ও মানাসিকভাবে আমাকে এবং আমার পরিবারের সবাইকে সুস্থ রেখেছেন।  

সবাই সবার জন্য দোয়া করবেন, ভালো থাকবেন। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৯ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০২০
এমএস/এমকেআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।