ঢাকা, সোমবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ মে ২০২৪, ১১ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

নিয়মবহির্ভূতভাবে খোদ ইউপি সদস্যের নামেই ভিজিডি কার্ড

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, মে ২, ২০২০
নিয়মবহির্ভূতভাবে খোদ ইউপি সদস্যের নামেই ভিজিডি কার্ড

কুষ্টিয়া: খোদ ইউপি সদস্যের নামেই ভিজিডির কার্ড করা হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ইউপি সদস্যের নামে কার্ড ইস্যু করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠেছে। তিনি সংরক্ষিত নারী মহিলা সদস্য শারমিন সুলতানার নামে নিয়ম না মেনে ভিজিডির কার্ড ইস্যু করেছেন।

এছাড়া ওই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে এক কার্ডধারীর কার্ড চার বছর ধরে নিজের কাছেও রাখেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অপর এক ভাতাভোগী নারীর এক বছরের চাল আত্মসাৎ- এর অভিযোগও উঠেছে। এই নিয়ে এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

জানা যায়, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের (১, ২ ও ৩ নং ওয়ার্ড) মহিলা ইউপি সদস্য শারমিন সুলতানা।  গত ২০১৯ সালের ১১ মার্চ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া মাসিক ৩০ কেজি খাদ্যশস্যের (চাল) ভিজিডি’র কার্ড নিয়মবহির্ভূভাবে নিজ নামে করে নিয়েছেন। তার কার্ড নম্বর- ০৬।  কোনো জনপ্রতিনিধি নামে এ ভিজিডির কার্ড দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি অবৈধভাবে ইউপি চেয়ারম্যানের জোগসাজসে এ কার্ড নিজ নামে করে চাউল উত্তোলন করে আসছেন।

ইউপি সদস্য শারমিন সুলতানা’র প্রতিবেশী বৈরাগীর চর এলাকার জামাল সরদার। বয়স প্রায় পঞ্চাশের বেশি। ২০১৬ সালে তার নামে খাদ্য অধিদপ্তরের সুলভ মূল্যের (ওএমএস) ১০ টাকা কেজি দরে চাউলের কার্ড ইস্যু করা হয়। তবে সে কার্ড চার বছর ধরে হাতেও পায়নি, কিংবা তা সম্পর্কে জানতেনও না জামাল সরদার।

সম্প্রতি ওএমএস, ভিজিডি ও ত্রাণের বিষয়ে অনিয়ম ঠেকাতে সেনাবাহিনীর তৎপরতা শুরু হচ্ছে, এমন খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল ভুক্তভোগি জামাল সরদারের বাড়িতে গিয়ে কার্ড বুঝিয়ে দিয়ে আসেন শারমিন সুলতানা।

জামাল সরদার বাংলানিউজকে জানান, চার বছর আগে ওএমএস এর কার্ড করে দেওয়ার কথা বলে ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ও ছবি নিয়েছিল শারমিন মেম্বার। তিনি বলেছিলেন আমার কার্ড হয়নি। এর পর গত মাসের ১৫ তারিখ সকালে এসে মেম্বার আমাকে কার্ড দিয়ে গেছে। চার বছর ধরে আমার কার্ড দিয়ে চাল তুলে নিয়েছেন। তিনি এ ঘটনার বিচার চান।

২ নং ওয়ার্ডের জিয়ারুল ইসলামের স্ত্রী মানছুরা খাতুনের অভিযোগও একই রকমের। তার নামে ২০১৯ সালে ভিজিডির কার্ড হলেও হাতে পাননি তিনি। যদিও গত ১ বছর ধরে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল ওঠানো হয়েছে, তার নামীয় কার্ড থেকে। তার ভিজিডি কার্ডের নম্বর-০৪।

ভোক্তভোগী মানছুরা খাতুন বাংলানিউজকে জানান, ২০১৯ সালে মহিলা মেম্বার শারমিন সুলতানা আমাকে ভিজিডির কার্ড করে দেওয়ার কথা বলেন। তার কথা অনুসারে আমার ছবি এবং ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি দেওয়া হয় তাকে। এরপর কার্ডের জন্য বহুবার ইউনিয়ন পরিষদে গেলেও কার্ড হয়নি বলে জানিয়ে দেন চেয়ারম্যান শাহ আলমগীরসহ পরিষদের অন্য সবাই।

তবে তার ওই কার্ডে গত ১২ মাস ধরে টিপসই দিয়ে ভিজিডির চাল তোলা হয়। সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ১ বছর পর মানছুরা খাতুনের নামে ইস্যুকৃত কার্ডটি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলগীর যোগসাজসে এই ইউনিয়নের এমন অনিয়ম করা হয় বলে ভুক্তভোগী ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় সকল সদস্যই ভাগ বাটোয়ারা করে নিজেদের নিকট আত্মীয়ও একই পরিবারের লোকজনদের কার্ড দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মহিলা ইউপি সদস্য শারমিন সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, আমার নামে ভিজিডির মহিলা অধিদপ্তরের কার্ড রয়েছে। আমি নিয়মিত চাল পায়। আমি অসহায় এবং বিধবা নারী, আমার উপরে চেয়ারম্যানের নেক নজর আছে। তাই সে কার্ড করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ চক্রান্ত করছেন। আমার বিরুদ্ধে তারা মিথ্যা অভিযোগ করছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নয়ন আলী বাংলানিউজকে জানান, গত কয়েকদিন আগে জামাল সরদারকে এক বস্তা চাউল আর কার্ড দিয়ে আসতে যায় মহিলা ইউপি সদস্য শারমিন সুলতানা। এ সময় জামাল সরদার কার্ডটিতে একাধিক টিপ স্বাক্ষর দেখে কার্ডটি নিতে অস্বীকার করে। এজন্য এলাকায় সমালোচনার সৃষ্টি হয়।

অভিযোগ এই ইউনিয়নের শুধু মহিলা সদস্যদের বিরুদ্ধেই না। বিভিন্ন সময়ে বরাদ্ধকৃত সরকারি সহায়তা, ভিজিডি এবং ওএমএস এর কার্ড স্বজনপ্রীতি করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

২ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নাসির উদ্দীন। তার বিরুদ্ধেও রয়েছে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। তিনি নিজের স্ত্রী, মা, বোনসহ নিকট আত্মীয়দের করে দিয়েছেন ভিজিডির কার্ডসহ ও এমএসএর কার্ড।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করে নাসির উদ্দীন বাংলানিউজকে জানান, আমার ভাই, ভাই এর বৌ, এবং আমার স্ত্রীর নামে ভিজিডির কার্ড আছে। তবে আমার নামে নেই। আমার পরিবারে তিনজনের নামে কার্ড রয়েছে। তারা হলেন- আমার স্ত্রী, মা এবং আমার বিধবা বোন। চেয়ারম্যান ভাগ করে দিয়েছিলো আমরা সেগুলো করে নিয়েছি।

এ ব্যপারে জানতে চাইলে মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ-আলমগীর বাংলানিউজকে জানান, মহিলা ইউপি সদস্যের নামে ভিজিডির কার্ড করা যাবে কিনা সেটা আমাদের জানা ছিলো না। অনেক মেম্বাররাই সে সময় না বুঝে এমনটি করেছে।

জনপ্রতিনিধির নামেই খোদ ভিজিডির কার্ড কিভাবে হলো, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা মহিলা অধিদপ্তরের বিষয়। যদি নিয়মে না থাকে তাহলে তারা অনুমোদন দিলো কি করে। তারা বাতিল করে দিতে পারতো।

তিনি বলেন, এই ইউনিয়নের অধিকাংশ মেম্বারই গরিব। এদের এসব নিয়ম-অনিময় দেখতে গেলে প্রায় সকলেরই সমস্যা হয়ে যাবে। খুঁজতে গেলে প্রায় সবাই ফেঁসে যাবে। যেমন ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাসির মেম্বারের ৪টা ভিজিডির মধ্যে ৪টায় তার পরিবারে। তার স্ত্রী, মা, ভাবির নামে ও বোনের নামে। আমার ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বারে মাতৃত্বকালীন কার্ড, অথচ তার ছেলের বয়স ১০ বছর। কিন্তু তার স্ত্রী মাতৃত্বকালীন ভাতা তোলেন, তার ভাবির নামে করেছেন কার্ড। এমন অনেক আছে। তবে ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাহ আলম এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যপারে ঐ ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি সদস্যের বিরুদ্ধেই সরকারি বরাদ্ধকৃত সামগ্রী, ভাতা প্রদানের স্বজনপ্রতি ও আত্মসাৎ এর অভিযোগ পাওয়া গেছে।  ইউপি সদস্যগণ একে অপরকে দায়ী করছেন।

দৌলতপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ইশরাত জাহান বাংলানিউজকে জানান, কোনো জনপ্রতিনিধি অথবা সরকারি কর্মচারীর নিজ নামে ভিজিডিসহ এ ধরনের কার্ড ইস্যু করার নিয়ম নেই। যতই অসচ্ছল হোক এটি আইনসম্মত নয়। আপনাদের নির্দেশনা দেওয়া ছিল যেন এ ধরনের অনিয়ম না করা হয়।

এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার বাংলানিউজকে জানান, এ বিষয়ে আমার তেমন কিছু বলার নেই। যদি কেউ অনিয়ম করেন, তা প্রমানিত হয়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৬ ঘণ্টা, মে ০২, ২০২০
ওএফবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।