ঢাকা, রবিবার, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৯ মে ২০২৪, ১০ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

নির্জন নিস্তব্ধ রমনার বটমূল-চারুকলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২০
নির্জন নিস্তব্ধ রমনার বটমূল-চারুকলা

ঢাকা: পহেলা বৈশাখের সকাল। ঘর ছেড়ে পথে পা রাখলেই মেলে ধরে এক অনিন্দ্য আনন্দ। পথ এগোতেই রমনার বটমূল থেকে কানে এসে লাগে শুদ্ধ সংগীতের সুর। বছরের প্রথম দিন সকাল বেলা সেই সুর হৃদয়কে করে শুদ্ধ। প্রাণ সঞ্চার করে হাজারও বাঙালি প্রাণে। একটু পরেই তার উল্লাস গিয়ে মিশে চারুকলা অনুষদে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি প্রমাণ করে অশুভ দূর করতে আমরা এক এবং একত্রিত। তবে এবারে সেই সুর একটু ভিন্ন। অশুভতা দূর করতে সকলে একত্রিত ঠিকই, তবে তা পুরোটাই ভিন্ন আঙ্গিকে।

নতুন বছরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গানে গানে রমনার বটমূল থেকে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে আসছে ছায়ানট। ১৯৬৭ সালে সূচনার পর থেকে এটি দেশে নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

২০০১ সালে জঙ্গিদের বোমা হামলার পরও বন্ধ হয়নি এই আয়োজন। কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে রমনার বটমূলে নেই সেই কলরব।

একই দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদেও। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের সকাল বেলা যে জায়গাটি লাখ লাখ মানুষের কলরবে মুখরিত হয়, এখন সেখানেও ভর করেছে নির্জনতা। শাহবাগ থেকে টিএসসি অনেকটাই দেখা যায় একদৃষ্টে।
নির্জন নিস্তব্ধ চারুকলা অনুষদ এলাকা, ছবি: জিএম মুজিবুরমঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর রমনার বটমূল এবং চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখা গেছে, সুনশান ও নিস্তব্ধ রমনার বটমূল এলাকার পুরোটাই। তালা ঝুলছে রমনা পার্কে প্রবেশের প্রধান গেটগুলোতে। প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি কাউকেই। আর করোনা ভাইরাসজনিত দুর্যোগের সময় রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন না করে বরং বিপন্ন ও দুস্থ মানুষকে অন্ন যোগানোর কাজে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছায়ানট। একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রাও।

এ বিষয়ে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির সবচেয়ে বড় প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। রমনার বটমূলে ঐতিহ্যের আয়োজন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রস্তুত হচ্ছিল ছায়ানট। কিন্তু বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব যখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে দুর্গত জনগণের পাশে দাঁড়ানোকেই বেশি জরুরি মনে করছে ছায়ানট।
তালাবদ্ধ রমনা পার্কের গেট, ছবি: জিএম মুজিবুরতিনি আরও জানান, জনসমাগম সংক্রান্ত ঝুঁকির কারণে ছায়ানট রমনার বটমূলে নিয়মিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও মিলনমেলার আয়োজন থেকে সরে এসেছে। তবে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সীমিত আকারে নববর্ষকে স্বাগত জানাবার একটি উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছায়ানট। রমনা বটমূলে ধারণ করা গত কয়েকটি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নির্বাচিত ভিডিও দিয়ে সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠানটি। তাতে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে ছায়ানট সভাপতি সন্‌জীদা খাতুনের সমাপনী কথনও। পুরো অনুষ্ঠানটি বিটিভির সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে পয়লা বৈশাখ সকাল ৭টায় সম্প্রচার করা হয়।

এই আয়োজনে ছায়ানট সভাপতি বলেন, বাংলা নববর্ষ উদযাপন নিয়তই মানুষে-মানুষে, মানুষে-প্রকৃতিতে অভিনব এক সংযোগ সৃষ্টি করা। নতুন দিনের আশা নিয়ে নববর্ষ ফিরে ফিরে আসে বাঙালির জীবনে। কিন্তু আজ নতুন বছরের বার্তা যেন নতুন আশাকে ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। জাতির জীবনে আজ ঘোর দুর্দিন। সমগ্র বিশ্বসমাজ আজ বিধ্বংসী মহামারিতে আক্রান্ত। উৎসবের দিন নয় আজ। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করবার দিন। নিজে নিরাপদ থাকার পাশাপাশি সবাইকে নিরাপদ রাখার সময়। এই সর্বব্যাপী বিপদে আক্রান্ত বিরূপ বিশ্বে মানুষ একা হয়ে পড়েছে। আবার বিশ্ববাসী আজ একই সংগ্রামের সহযাত্রী হয়ে মিলেমিশে একাকার।

তিনি বলেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সভ্যতার যে সংকট দেখে রবীন্দ্রনাথ শিহরিত হয়েছিলেন, আজকের সংকট তার চেয়েও বহু বিস্তৃত। পৃথিবীর গভীর-গভীরতর অসুখে আমরা এ-ও জানি বিপুল ধ্বংসলীলা আসন্ন হলেও, সেকথাই একমাত্র সত্য নয়। মানবকল্যাণের জন্য আমরা ঐকান্তিক চেষ্টা এবং ঐকান্তিক মিলনের শপথে ঐক্যবদ্ধ হব আজ। মহাবিশ্বের প্রতিটি মানুষ পরস্পর অদৃশ্য ঐক্যসূত্রে বাঁধা। সভ্যতা, মানবতা ও প্রকৃতির নিবিড় মেলবন্ধনে আমরা আস্থা রাখি। কামনা করি বিচ্ছিন্নতা ও বন্দিত্ব পেরিয়ে নতুন উপলব্ধিতে নতুন বিশ্ব গড়বার। প্রেরণা সঞ্চারিত হবে সবার মধ্যে। মহা-সংকট বয়ে আনবে মহা-পরিবর্তন। কেননা, মানুষই পারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আলোর পথের অভিযাত্রী হতে।
সুনশান নীরবতা রমনা পার্কে, ছবি: জিএম মুজিবুরছায়ানট সভপাতি সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর ঘরে ঘরে যত মানুষ আছে, সবার জন্য শুভকামনা জানাই আমরা। জয় আমাদের হবেই। সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা ফিরে উচ্চারণ করব আজ– ‘জয় হোক মানুষের, ওই চিরজীবিতের’।

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ের চারুকলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলা নববর্ষকে পেয়েছি, যখন বিশ্বে আনন্দ উৎসব আয়োজন করার মতো পরিস্থিত বিরাজ করছে না। বরং এক অত্যন্ত কঠিন মর্মান্তিক পরিবেশের সামনে দাঁড়িয়ে আজকে আমাদের বছরের এই প্রথম দিনটি উদযাপন করতে হচ্ছে। আমরা আমাদের এই সময়ে যে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, সেই লড়াইয়ের ধরনটাই হচ্ছে জিততে গেলে আমাদের ঘরে অবস্থান করতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম এবং আমরা জয়ী হয়েছিলাম। এই করোনার বিরুদ্ধে আমাদের যে যুদ্ধ তার জন্য আমাদের ঘরে অবস্থান করতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

এসময় তিনি সবাইকে নিজ ঘরে বসে নিজস্ব আয়োজনে বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগ ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন>> ছায়ানটের সুরে সুরে বর্ষবরণের সকাল শুরু

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২০
এইচএমএস/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।