ঢাকা, সোমবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দাবি পূরণ না হলে প্রত্যাবাসন চান না রোহিঙ্গারা

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
দাবি পূরণ না হলে প্রত্যাবাসন চান না রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার: নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য মিয়ানমারের ক্লিয়ারেন্স পাওয়া তিন হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে ২১ জন বা ২১টি পরিবারের প্রধান মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। 

বুধবার (২১ আগস্ট) সকাল থেকে আবারও টেকনাফের শালবন এলাকায় ২৬ নম্বর ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ কার্যক্রম চলবে।

মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) প্রথমদিন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) এবং জাতীসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধির কাছে সাক্ষাৎকারে দেওয়া বেশিরভাগ রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, তাদের দাবি পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরতে চান না।

জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ মোহাম্মদ খালেদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রথমদিন প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত ২১টি পরিবারের প্রধান সাক্ষাৎকারে তাদের মতামত জানিয়েছেন। তাদের মতামত একটি ফরমে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। শরণার্থী শিবিরে তৈরি করা বিশেষ আটটি ঘরে রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।  

মঙ্গলবারও যথারীতি সাক্ষাৎকার কার্য়ক্রম চলবে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের তালিকায় থাকা তিন হাজার ৪৫০ জনের মধ্যে তিন হাজার ৩১০ জনই জাদিমুরা ও শালবাগান শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। তাই বুধবারও এক্যাম্পে তাদের মতামত নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

তবে সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া বেশ কজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রোহিঙ্গা তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং নিজ ভিটে-বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি পূরণ করা না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরতে চান না বলে মত দিয়েছেন।

এদের মধ্যে, সাবেকুনন্নাহার (২৫) বাংলানিউজকে বলেন, আমার কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, অামি মিয়ানমারে ফিরতে চাই কিনা? জবাবে আমি- না বলেছি। কারণ হিসাবে বলেছি- সেখানে আমার ভাইকে গলাকেটে হত্যা করা হয়েছে। দাবি পূরণে আগে সেখানে গেলে আবারও আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হবে। সেদেশে যেসব রোহিঙ্গা আছে, তাদের অনেকে কারাগার ও ক্যাম্পে বন্দি। আর তাই সেখানে গেলে আমাদেরও ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হবে।

মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য ছাড়পত্র পাওয়া মংডুর আবু ছিদ্দিক (৩০) বাংলানিউজকে বলেন, সাক্ষাৎকারে আমাকে মিয়ানমারে ফিরে যাবো কিনা জানতে চাইলে, আমি বলেছি- নাগরিকত্ব নিশ্চিত হলে, নিজের ভিটে-বাড়ি ফিরে পেলে এবং রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিচার পেলে তদার পর যাবো। এর আগে নয়।

‘যেখানে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি, সেখানে আবার কেন মরতে যাবো। সেখানে  বর্তমানে রাখাইনে যুদ্ধ চলছে। যাওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। ’ যোগ করেন ছিদ্দিক।

আবু তাহের ওরফে সোনা মিয়া (৪০) বলেন, ইউএনএইচসিআর আর ক্যাম্প ইনচার্জের প্রতিনিধিরা ঘরে এসে আমাকে ডেকে নিয়েছে। তবে তাদের জানিয়ে দিয়েছি- আমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নই।

সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া ২১ পরিবার প্রধানের মধ্যে ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ বজরুস আলমও অংশ নেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রধান দাবি তিনটি। নাগরিকত্ব দেয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আমাদের নিজের ভিটে-বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া। এসবের পাশাপাশি মিয়ানমারের মাব্রাইয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি থাকা এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার মুক্তির দাবিও জানাই আমরা। এসব দাবি পূরণ না হওয়ার আগে আমরা প্রত্যাবাসন চাইনা।

এদিকে সাক্ষাৎকার গ্রহণ কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি বাড়াতে ইউএনএইচসিআর এবং আরআরআরসি কার্যালয়ের ১০টি দল সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে যান। এসময় কিছু রোহিঙ্গা তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনে।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কমর্কর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বাংলানিউজকে বলেন, এটি তেমন কিছু নয়, কিছু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে থাকায় তারা ব্যর্থ হয়। এরপর পরই ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

শরণার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, স্বেচ্ছায় স্বপ্রণোদিত হয়ে যে ২১টি পরিবারের প্রধান সাক্ষাৎকার দিতে এসেছে এটাই একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত।

গতবারের চেয়ে এবারের পরিস্থিতি অনেক ভালো জানিয়ে আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, গতবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা হলে সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পগুলোতে এক ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এসময় অনেক রোহিঙ্গা তাদের ঘর-বাড়ি ছেলে পালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবার সেই পরিস্থিতি হয়নি। কারণ, আমরা তাদের বার বার আশ্বস্থ করার চেষ্টা করেছি, গতবার যেমন কাউকে জোর করা হয়নি, ঠিক এবারো কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবেনা। যারা স্বেচ্ছায় ফিরতে রাজি হবেন, কেবল তাদেরই ফেরত পাঠানো হবে বলে যোগ করেন আবুল কালাম।

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়। এমনকি এর আগে ও পরে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ৩২টি অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দিতে বিভিন্নভাবে কূটনীতিক তৎপরতার শুরু করে বাংলাদেশ।  

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গঠিত দু’দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সিদ্বান্ত মতে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’দেশ প্রক্রিয়া শুরু করলেও রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। এরপর থেকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যায়। এমনকি রোহিঙ্গা আসার পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তজার্তিকভাবে কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা হলেও এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।  

এর প্রায় ১৮ মাস পর বাংলাদেশের পাঠানো প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা থেকে সম্প্রতি আবারও ৩ হাজার ৪৫০জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। এবং আগামী ২২ আগস্ট  প্রত্যাবাসন শুরু করতে সম্মত হয় দুই দেশ।

উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে ‘ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি টিম-কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছেন মিয়ানমার সরকার কর্তৃক গঠিত ‘ইনডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি টিম’-এর সদস্যরা।

মঙ্গলবার সকাল থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত তারা উখিয়ার কুতুপালং,বালুখালী ও জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।

এর অাগে মিয়ানমারের তদন্ত দলটি সোমবার (২০ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পৌঁছে দুপুরে কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালামের কার্যালয়ে বৈঠক করেন। মঙ্গলবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান তারা।

ফিলিপাইনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোজারিও মানালোর তেতৃত্বে চার সদস্যর এ দলে মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান মিয়া থেইন, জাতিসংঘে জাপানের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি কেনজো ওশিমা ও ইউনিসেফের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অন তুন থেট ছিলেন।

জানা গেছে, সকাল ১০টার দিকে সড়কপথে উখিয়ার বালুখালী শিবিরের ৯ নম্বর ক্যাম্পে পৌঁছে তারা প্রথমে বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে যান। পরে দলের সেখান থেকে পাশের জামতলী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এসময় বালুখালী শিবিরে ক্যাম্প ইনচার্জ শেখ হাফিজুল ইসলামের কার্যালয়ে আধা ঘণ্টা বৈঠক করেন তারা। এসময় ক্যাম্প ইনচার্জ তাদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
এসবি/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।