ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফেরা হলো না আনিকার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৮
আইসক্রিম কিনে বাড়ি ফেরা হলো না আনিকার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আনিকা ও তার পরিবারের সদস্যরা

রাজশাহী: বড় বোন মিতুর সঙ্গে স্কুলের শোকদিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল শারমিনা আশরাফিয়া আনিকা (১৩)। স্কুল থেকে ফেরার পথে নওদাপাড়া মোড়ে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল আনিকা। আইসক্রিম কিনেছিল ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি। এর আগেই ঘাতক বাস দোকানে ঢুকে তার প্রাণ কেড়ে নেয়।

এতে শেষ হয়ে যায় আরও একটি স্বপ্ন! অকালেই নিভে যায় আরও একটি প্রাণপ্রদীপ। তার শোকে মা শাহনাজ বেগম এখন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

অশ্রুহীন দু’চোখে যেনো ভর করেছে বুক ফাটা বোবা কান্না। কোনো সান্ত্বনা আর আশ্বাসই যেনো তার কানে যাচ্ছে না। একমাত্র মেয়েকে এভাবে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন আনিকার মা শাহানাজ বেগম।  

বুধবার (১৫ আগস্ট) দুপুরে দোকানে বাস ঢুকে চাপা দেয় স্কুল ছাত্রী আনিকাকে। এর পরপরই তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান সেখানে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়েছে।  

আনিকা মহানগরীর শাহ মখদুম থানার ভাড়ালিপাড়া এলাকার রুস্তম আলীর সৎ মেয়ে। শাহানাজ বেগমের স্বামী মারা যাওয়ার পর রুস্তম আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় তার। এরপর থেকে সৎ বাবার সংসারেই থাকতো আনিকা।  

রুস্তম আলীর আগের ঘরের মেয়ে মিতু অষ্টম শ্রেণিতে একই স্কুলে পড়ে। এই ঘটনার সময় সঙ্গে থাকলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় মিতু। তবে ঘটনার পর সে সুস্থ থাকলেও এখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। নওদাপাড়ায় তার বাবা রুস্তম আলীর ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। ঘটনার পর তিনি দুর্ঘটনার মূল হোতা ওই বাস চালককে খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার পর ওই স্কুলের সাধারণ ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। সহপাঠীরা এ সময় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং জড়িত বাস চালককে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। পরে শিক্ষকরা তাদের সান্ত্বনা দিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেন।  

এর আগে রাজশাহীর নওদাপাড়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বাস রাস্তার পার্শ্ববর্তী দোকানে ঢুকে পড়লে ঘটনাস্থলে ৩ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আরও পাঁচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।  

বেলা সোয়া ১২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- নগরের শাহ মখদুম থানার ভাড়ালিপাড়া এলাকার রুস্তম আলীর মেয়ে ও নওদাপাড়া গার্লস স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী শারমিনা আশরাফিয়া আনিকা (১৩), বোয়ালিয়া থানার ম্যাচ ফ্যাক্টরি এলাকার মো. ইসলামের ছেলে ইসমাঈল হোসেন টিংকু (২৫) ও পবা মঠপুকুর এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে সবুজ (৩০)।

আহতরা হলেন- রাজশাহী কলেজের দর্শন বিভাগের ছাত্র জুলিয়ান মুর্মু (২০), নওদাপাড়া এলাকার রিমা বেগম (৪৫), মিঠু (২৫), মালদাহ কলোনি এলাকার সজিব হোসেন (৩৫) ও পবার সারংপুর এলাকার আসমত আলী (৩৫)। আহতরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩, ৮ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।  

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজশাহী থেকে নওগাঁ অভিমুখে যাওয়ার পথে অ্যারো বেঙ্গল (রাজ মেট্রো-জ-০৪-০০০৪) নামের বেপরোয়া গতির একটি খালি বাস নওদাপাড়া এলাকায় এসে নিয়ন্ত্রণ হারায়। বাসটি পোস্টাল একাডেমি গেট পার হয়ে প্রথমে একটি মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে চাপা দেয়। এক পর্যায়ে ওই মোটরসাইকেলটিকে টেনে আরও কিছু দূর নিয়ে যায়।

এ সময় পরপর দুটি ব্যাটারিচালিত যাত্রীবাহী অটোরিকশাকে ধাক্কা দিয়ে ঘাতক বাসটি নওদাপাড়া বাজার রাস্তার বাঁ পাশে থাকা সবুজ-সাথী অ্যান্ড লাইব্রেরির সানসেট ভেঙে পার্শ্ববর্তী জাহাঙ্গীর ট্রেডার্সে ঢুকে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেলের দুই আরোহী টিংকু ও সবুজ এবং দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা অপর স্কুলছাত্রী আনিকা নিহত হন।

ঘটনার পর রাজশাহীর আম চত্বর এলাকায় বিক্ষোভ করেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ সময় কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন বিক্ষুব্ধরা। এতে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রাজশাহী-নওগাঁ রুটে বাসসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে।  

বিক্ষুব্ধদের অভিযোগ- অ্যারো বেঙ্গল নামের ওই বাসটি খালি ছিল। বাসটি রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটের। মহানগরীর রেলগেট হয়ে বাসটিকে নওদাপাড়া টার্মিনালে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আর এ সময় বাসের হেলপার বাসটি চালাচ্ছিলেন। যে কারণে বেপরোয়া গতির ওই বাসটি নওদাপাড়া মোড়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটায়। তবে ঘটনার পর কৌশলে পালিয়ে যাওয়ায় বাসের ‘চালককে’ আটক করা যায়নি।

পরে পুলিশ বিক্ষুব্ধদের সরিয়ে দিলে ওই সড়কে আবারও যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এর আগে বাসটিকে আটক করে রেকার দিয়ে টেনে শাহ মখদুম থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।  

রাজশাহীর শাহ মখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) জিল্লুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নিহতদের মধ্যে টিংকু ডিশলাইনের কাজ করে বলে কেবল অপারেটর জহিরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন। আর সবুজ টিংকুর সঙ্গে ছিলেন। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে নওদাপাড়ার দিকে আসার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তাদের মরদেহ উদ্ধার করে থানায় রাখা হয়েছে।  

ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলের মধ্যে নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। এছাড়া বিক্ষুব্ধদের সরিয়ে দেওয়ায় ওই সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বর্তমানে বাসটি যে চালিয়ে যাচ্ছিলো তাকে খোঁজা হচ্ছে। এ ব্যাপারে থানায় মামলা করা হবে বলেও জানান শাহ মখদুম থানার এই পুলিশ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৮
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।