ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

‘আমরা নিজেরাই বক্ষব্যাধি ডেকে আনছি’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৮
‘আমরা নিজেরাই বক্ষব্যাধি ডেকে আনছি’ আলোচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামালসহ অন্যরা। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: মানুষের বক্ষব্যাধি বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। সারাক্ষণ ঘরে এসি চলে। সেজন্য ঘরের জানালা খোলে না, সবসময় জানালা বন্ধ থাকার কারণে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। এতে শরীর প্রয়োজনীয় অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে রোগ ফিরে আসে বারবার। এজন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। 

এ কথা বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। শনিবার (২১ জুলাই) রাজধানীর বারিধারার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের কনফারেন্স হলে দৈনিক কালের কণ্ঠ ও ওরিয়ন গ্রুপের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বক্ষব্যাধি চিকিৎসা পরিস্থিতি: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন তিনি।


 
দৈনিক কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল।  

আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় যক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. সামিউল ইসলাম, টিবি হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবু রায়হান, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক প্রফেসর ডা. মো. শাহেদুর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক ডা. মির্জা মোহাম্মদ হিরণ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. একেএম একরামুল হক,  মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রধান ডা. আদনান ইউসুফ চৌধুরী, চিকিৎসক নেতা ডা. মো. সাইদুল ইসলাম এবং ওরিয়ন ফার্মার গ্রুপের প্রোডাক্ট ম্যানেজার গোলাম জিলানী মাহবুবে আলম প্রমুখ।  

অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরাই আমাদের প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলেছি, বিষয়টি এরকম। জানালা বন্ধ করে এসি চালানোর কারণে আমাদের অনেকগুলো রোগ এসি মেশিন নিয়ে নেয়। আমরা দীর্ঘ সময় জানালা বন্ধ করে রাখার কারণে সেসব রোগ আবার ফিরে আসে আমাদের মাঝে। কাজেই আমরা আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। অর্থাৎ যখন ঘরের জানালা বন্ধ করছি, প্রকৃতির আলো প্রবেশ করতে দিচ্ছি না, তখন সরাসরি না হলেও আমরা আরামের বিনিময়ে অসুস্থতা ডেকে আনছি। এগুলোই বাস্তবতা। ’

‘কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে বিভিন্ন ধরনের বক্ষব্যাধি আসছে, সেটা স্বীকার করে নিতে হবে। এটা উন্নয়নের একটি বিষয়। তবে উন্নয়ন স্থিতাবস্থায় আসলে এটি কমে যাবে বলে আশা করতে পারি। ’
 
দেশে গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্য ফেসবুক তহবিল আহ্বানের বিষয়টি উল্লেখ করে ডা. আজাদ বলেন, ‘যেসব রোগী টাকার অভাবে চিকিৎসা পাচ্ছে না, সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহ দিচ্ছি এগুলো আমাদের নজরে আনার জন্য। আনার পরে আমরা যেন সক্রিয় ব্যবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে পারি। ’
 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা এখন রোগ প্রতিরোধের দিকে জোর দিচ্ছি। আমরা ভবন করেছি, যন্ত্রপ‍াতি ক্রয় করেছি। যদিও এখনো জনবল দিতে পারি না, এ সমস্যা রয়েই গেছে। আদালতের নির্দেশে ১৯৮৫ সালের সামরিক শাসনামলের নিয়োগ বিধি বাতিল করে নতুন নিয়োগ বিধিতে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। চিকিৎসকের ঘাটতি মেটাতে প্রধানমন্ত্রী ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগের অনুমতি দিয়েছেন। ৩ আগস্ট ৫ হাজার নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এটি হলে জনবলের ঘাটতি অনেক পূরণ হয়ে যাবে। ’
 
চিকিৎসকদের ঢাকায় আবাস গাড়ার প্রবণতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে ঢাকায় থাকার প্রবণতা বেশি। কেউ বাইরে যেতে চান না। আমরা যদি এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, কিছু যদিও মোটিভেশন আসে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবো। ’
 
বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের চিকিৎসক ও জনবল এখনো কাজের ক্ষেত্রে সচেষ্ট নয় উল্লেখ করে ডা. আজ‍াদ বলেন, ‘যারা দুর্গম অঞ্চলে কাজ করেন, ভালো কাজ করেন, তাদের যে সম্মানী, একইভাবে যারা শহরে কাজ করেন ভালো কাজ করেন না, তাদেরও একই সম্মানী।  এ কারণে আমরা ভালো কাজের দিকে যথেষ্ট মনোযোগী করতে পারছি না।  
 
‘চিকিৎসা সেবায় আমরা ইউরোপিয়ান মডেল প্রবর্তন করার চেষ্টা করছি। এজন্য বিদেশ থেকে কিছু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য বিমা চালু করা যায় কি-না এসব বিষয়ে কর্মশালা করবো। কারণ সহস্রাব্দ উন্নয়ন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবার স্বাস্থ্য বিমার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। এজন্য জনগণকে পকেট থেকে কিছু অর্থ ব্যয় করতে হবে। আর সরকারের উদ্যোগকে জনগণের সমর্থন দিতে হবে। ’
 
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বিদেশ থেকে চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল নিয়ে আসছে। এটার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা কড়াকড়ি আরোপ করায় হাসপাতাল মালিকরা বলছেন আমরা রোগীদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে চেয়েছিলাম। সেটা পারছি না। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, যারা বিদেশ যাওয়ার তারা যাবেই। ’

কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা হিসেবে কালের কণ্ঠ অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের উন্নয়ন ও মানুষকে সচেতন করার জন্য নানা কাজ করছি আমরা।  

কালের কণ্ঠ সম্পাদক বলেন, একটা সময় প্রচলিত ছিল, ‘যার হয় যক্ষ্মা , তার নাই রক্ষা’। তখন আমরা সত্যিই যক্ষ্মা রোগীদের বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। বক্ষব্যাধির মধ্যে আরও অনেক প্রাণঘাতী অসুখ-বিসুখ রয়েছে। আমরা তার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গঠনের কাজ করছি। কিছুদিন আগেও বক্ষব্যাধির চিকিৎসা পাওয়া ছিল বেশ দুষ্কর। এখন বক্ষব্যাধির চিকিৎসা সুলভ হয়েছে বলা যায়। বিশেষায়িত চিকিৎসকদের কাছে গেলে রোগমুক্তির একটা নিশ্চয়তাও পাওয়া যায়। আমরা বিশ্বাস করি, সচেতন হলে বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগসহ নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। সচেতনতাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা তাই জনসচেতনতা গঠনের জন্য নানা কিছু করছি।  
 
কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, জন্মলগ্ন থেকেই কালের কণ্ঠ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্যখাতকে। আমাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যবিষয়ক আয়োজন রয়েছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতের বিভিন্ন খবরাখবরকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করি।  

তিনি বলেন, আমাদের দেশে বক্ষব্যাধির মূল কারণ হলো বায়দূষণ। বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা শহর। এখানে বায়দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। আমাদের দেশে গাছ-পালাও কম। শহরে আরও কম। ফলে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তার প্রভাবে মানুষ নানা অসুখ-বিসুখে ভুগছে। বক্ষব্যাধি রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় উন্নত চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। আশার কথা, আমাদের দেশে বক্ষব্যাধির চিকিৎসা সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎকও বেড়েছে। আমরা এ চিকিৎসা সেবায় আরও এগিয়ে যেতে চাই।  

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. একেএম একরামুল হক বলেন, জনবলের অভাবে আমাদের অনেক কাজ আটকে আছে। ২০ কোটি মানুষের দেশে ২০ জন সার্জন নেই। প্রতিদিন ঢাকায় ছোট বড় ২৯ হাজার অপারেশন হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।  
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ধুমপান নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ক্যান্সারসহ অনেক জটিল রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। ধুমপানের চিকিৎসায় অনীহা রয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোতে।  
 
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবু রায়হান বলেন, যানবাহনের কালো ধোয়া, ধুলাবালি ও ধুমপানের কারণে বক্ষব্যাধি হচ্ছে। এসব থেকে প্রতিকার পাওয়া গেলে এই ধরনের রোগ কমে যাবে।  
 
ওরিয়ন ফার্মার প্রোডাক্ট ম্যানেজার গোলাম জিলানী মাহবুবে আলম বলেন, বক্ষব্যাধির অন্যতম কারণ হলো ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ ও ধূমপান। এ অবস্থায় বক্ষব্যাধি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। এ অবস্থায় বক্ষব্যাধির চিকিৎসায় নানা উন্নত ওষুধ ও গবেষণা কাজ করছে ওরিয়ন ফার্মা। আমরা বিশ্বাস করি, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশও বক্ষব্যাধি নিয়ন্ত্রণে ও চিকিৎসায় বেশ এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৮
এসই/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।